চট্টগ্রাম নগরীর আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটা কিংবা পাহাড় ধসের ঘটনায় বারবার যে ব্যক্তির নাম আসে তিনি স্থানীয় কাউন্সিলর জহুরুল আলম জসিম। অভিযোগ রয়েছেন ২০০৭ সালে মাত্র আড়াই হাজার টাকা বেতনে একটি বেসরকারি কারখানায় সুপারভাইজার পদে চাকরি করা জসিম শত শত একর পাহাড় কেটে বসতি বানিয়ে প্লট বিক্রি ও বাসা ভাড়া দিয়ে এখন কয়েক শতকোটি টাকার মালিক।
স্থানীয়দের অভিযোগ, অবৈধভাবে পাহাড় কাটার অভিযোগে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা থাকলেও কোনো কিছুর পরোয়া না করেই নিত্য নতুন পাহাড় কাটার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে কাউন্সিলর জসিম। গত ১১ ফেব্রুয়ারি পাহাড় কেটে সড়ক তৈরির কাজ চালানোর সময় বেলতলী ঘোনায় এলাকায় ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পাহাড় কাটার প্রমাণ পান জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উমর ফারুক। মূলত কাউন্সিলর জসিমের নেতৃত্বে এই পাহাড় কাটার কাজ পরিচালিত হলেও সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড পান পাহাড় কাটায় নিয়োজিত স্ক্যাবেটরের চালক শাহজাহান (৪০)। এভাবেই প্রতিবার শ্রমিক, চালক ও দারোয়ানদের ওপর দায় চাপিয়ে নিজেকে ধরাছেঁয়ার বাইরে থাকছে জসিম।
সরেজমিন বেলতলী ঘোনা এলাকা ঘুরে দেখা গেছে পাহাড় কেটে ও ছড়া ভরাট করে কাউন্সিলর জসিমের নির্মাণাধীন বিভিন্ন স্থাপনা। বেলতলী ঘোনার পাহাড় অনেকটাই নিশ্চিহ্ন করে ফেলা হয়েছে। লেকসিটি এলাকায় পাহাড় ও কালির ছড়া ভরাট করে নির্মিত আবাসিক এলাকার সাথে সংযোগ সড়ক করতে এই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাহাড় কেটে সেখানে কাউন্সিলর জসিমের বাবা একেএম আবিউল হকের নামে প্রথমিক বিদ্যালয়ের সাইনবোর্ড দেখা গেছে। একই এলাকায় পাহাড় কেটে ইউএনডিপির অর্থায়নে সৌচাগার করা হয়েছে।
উচ্চ আদালতের নির্দেশ থাকা সত্ত্বে এই পাহাড় কাটার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে সাংবাদিক ও পরিবেশ ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আলীউর রহমান ক্ষোভপ্রকাশ করে বলেন, পাহাড় কেটে এখানে রাস্তা করার অনুমতি চসিক বা কাউন্সিলর জসীমকে কে দিয়েছে সেটাও খতিয়ে দেখা উচিত।
তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে জাল দলিল তৈরি করে সরকারি পাহাড়কে ব্যক্তি মালিকানার জমি বানিয়ে ফেলা। এক দশক আগেও যেটা পাহাড় ছিল আজ সেটা সমতল জমি। গত ২৬ জানুয়ারি নগরীর আকবর শাহ থানার উত্তর পাহাড়তলীর সুপারি বাগান এলাকায় পাহাড় কাটা ও পাহাড় কেটে খাল ভরাটের স্থান পরিদর্শনে যাওয়া বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের গাড়িতে হামলা করেন কাউন্সিলর জসিমের লোকজন। এই ঘটনায় তিনি বাদী হয়ে নগরীর আকবর শাহ থানায় একটি মামলা করেন। এই মামলায় তিন নম্বর আসামি আবু নোমানকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠালেও কাউন্সিলর জসিম বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে।
জানা গেছে ২০১৫ সালের ২৮ মে পাহাড় কাটার অভিযোগে কাউন্সিলর জসিমের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। মামলাটি করেন পরিদর্শক নানজীন সুলতানা। এছাড়া পাহাড় কাটার দায়ে ২০২১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কাউন্সিলর জসিমের স্ত্রী তাছলিমা বেগমকে ২০ হাজার টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এরপর পাহাড় কাটার ঘটনায় ২০২২ সালের ১০ আগস্ট কাউন্সিলর জসিম এবং তার স্ত্রী তাছলিমা বেগমসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর।

এ বিষয়ে কাউন্সিলর জহুরুল হক জসিমের বক্তব্য জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোন ও ম্যাসেঞ্জারে ক্ষুদেবার্তা (এসএমএস) পাঠানো হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
এদিকে, চট্টগ্রামে পাহাড় ধসে একজনের মুত্যুর ঘটনার পর আকবরশাহ এলাকায় পাহাড় কাটা বন্ধ এবং পাহাড় ও খালখেকোদের শাস্তির দাবিতে মানববন্ধন করেছে মাদক, সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন নামের স্থানীয় একটি সংগঠন। মানববন্ধন থেকে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. জহুরুল আলম জসিমকে গ্রেপ্তারে ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার আকবরশাহ এলাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের সামনে এ মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ও আমরা আকবরশাহবাসীর ব্যানারে এতে অংশ নেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
মানববন্ধনে বক্তারা বলেন, পার্বত্য এলাকা হিসেবে আকবরশাহ ছিল নন্দিত। কিন্তু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কাউন্সিলর জসিম ও তার বাহিনীর সরাসরি মদদে পাহাড় সাবাড় হয়ে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের নাম ভাঙিয়ে এবং দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব করছে এই বাহিনী। গত বছরও পাহাড় ধসে চারজন নিহতের পর এবার বর্ষার আগেই একজন মারা গিয়েছে। এর দায়ে কেন তার বিরুদ্ধে খুনের মামলা হলো না তা আকবরশাহবাসী জানতে চায়। আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে তাকে গ্রেপ্তার করা না হলে প্রয়োজনে সড়ক অবরোধ করা হবে।
মাদক সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার মোর্শেদ কচির সভাপতিত্বে মানববন্ধনে উপস্থিত ছিলেন কমিটির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট জামাল উদ্দিন, সদস্য সচিব কাজী আলতাফ হোসেন, যুগ্ম আহ্বায়ক এরশাদ মামুন, মহিলা কাউন্সিলর নুরজাহান বেগম রুবি, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) চট্টগ্রাম প্রধান মুনিরা রুবা, মাদক সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলনের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. লোকমান আলী প্রমুখ।
বাবু/এসআর