সাধারণভাবে সব দ্রব্যের দামই ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। একেই আমরা নাম দিয়েছি মূল্যস্ফীতি। রাজনৈতিক অর্থনীতির দৃষ্টিতে এর আরেকটি অর্থ হচ্ছে ‘জনগণের আয়’ দ্রব্যের দামের তুলনায় অপর্যাপ্ত। তখন সেটা আর দ্রব্যমূল্যের সমস্যা বলে বিবেচিত হবে না; পরিণত হবে আয় বণ্টনের সমস্যায়। যেমন এ কথা অনায়াসে তখন বলা যাবে যে, ‘বড়লোকদের’ কিছু টাকা দরিদ্রদের হাতে চলে গেলে বড়লোকরা তখন পোলাও খেয়ে পেট খারাপ না করে ভাত খেয়ে আগের চেয়ে ভালোই থাকবেন। অন্যদিকে, ওই টাকা পেয়ে দরিদ্ররা এখন যেমন একদম না খেয়ে আছেন, তখন আর না খেয়ে থাকবেন না। অন্তত ভাতটুকু খেয়ে বেঁচে থাকবেন।
সর্বজনীন এই সহজ সমাধান মোটেও সহজসাধ্য নয়। কারণ আয় বণ্টন ব্যবস্থা না বদলে দ্রব্যমূল্য সমস্যার এমন অভিনব সমাধান সম্ভব না। আয়বণ্টন আবার নির্ভর করে উৎপাদন পদ্ধতিতে কোন শ্রেণির কী ধরনের এবং কতটুকু আধিপত্য তার ওপর। এজন্যই সমাজে সম্পদের মালিক বা দক্ষ লোকদের আয় বেশি হয়ে থাকে এবং তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অত বেশি চিন্তিত থাকেন না। তাদের মোট আয়ের বেশিরভাগ অংশ ব্যয়িত হয় নানা উচ্চতর সেবার জন্য অথবা পুঁজিদ্রব্য বা টেকসই ভোগ্যদ্রব্য ক্রয়ের জন্য। ফলে চালের দাম বাড়লে বড়লোকদের চিন্তা নেই, কিন্তু মার্সিডিজ গাড়ি বা টিভির দাম বাড়লে চিন্তা বেশি। তাই খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির সাম্প্রতিক সমস্যাটি নিয়ে দেশের দরিদ্র জনগণই বেশি চিন্তিত এবং তাদের জন্য সমাধানই খুঁজে বের করতে হবে।
সরকার এ কথা জানে যে, খাদ্যমূল্য যদি বৃদ্ধি পায় তাহলে নিম্ন-আয়ের লোকেরা তৎক্ষণাৎ প্রকৃত আয় হ্রাসের সম্মুখীন হন। তখন বাধ্য হয়ে তাদের ভোগ কমাতে হয়। এই সহজ সত্যটি সানেম নামক গবেষণা সংস্থার সাম্প্রতিক জরিপ থেকে বেরিয়ে এসেছে। সানেমের মতে, সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আসলে দরিদ্রদের আয়ের ওপর এক ধরনের ‘নিষ্ঠুর কর’ আরোপন। অর্থনীতিবিদ, বিশেষ করে প্রগতিশীল অর্থনীতিবিদরা সাধারণত বলে থাকেন, মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নিষ্ঠুরতম ‘কর’।
সানেমের তথ্য থেকে শুধু নয়, পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য থেকেই দেখা যায়, ফেব্রুয়ারি ২০২২ সালে পয়েন্ট টু পয়েন্ট (অর্থাৎ ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) মুদ্রাস্ফীতির হার ছিল মাত্র ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ। অথচ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে এসে দেখা যাচ্ছে, এ হারটা হয়েছে ৮ দশমিক ৭৪ শতাংশ। সর্বশেষ হিসাবে দেখা যায়, তা দাঁড়িয়েছে ৯ শতাংশেরও ওপরে। সানেমের মতে, দরিদ্ররা যেহেতু মূলত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বেশি ক্রয় করেন এবং সেই পণ্যগুলোর দাম যেহেতু তুলনামূলকভাবে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, সে জন্য দরিদ্রদের জন্য কার্যকর মূল্যস্ফীতি হয় তো দুই অঙ্কের মাত্রায় উপনীত হয়ে গেছে।
এই সত্যের ভিত্তিতে সানেম ১ হাজার ৪৪৩টি দরিদ্র পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে যে তথ্য পেয়েছে, তা এমন : ক) ছয় মাস আগের তুলনায় চালের ভোগ কমিয়েছে গড়ে ৩৭ শতাংশ দরিদ্র পরিবার। খ) ডালের ভোগ কমিয়েছে ৪৬ শতাংশ পরিবার। গ) মাংসের ভোগ কমিয়েছে ৯৬ শতাংশ পরিবার। ঘ) মাছের ভোগ কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। ঙ) ডিমের ভোগ কমিয়েছে ৭৭ শতাংশ পরিবার। চ) তেলের ভোগ কমিয়েছে ৮১ শতাংশ পরিবার। চ) অন্যান্য পণ্যের ভোগ কমিয়েছে ৫৯ শতাংশ পরিবার।
মজার ব্যাপার, এই সহজ অবশ্যম্ভাবী তথ্যচিত্রটি সরকারের পছন্দ হয়নি। তারা ‘ধান ভানতে শিবের গীত’ গেয়েছে। সংবাদ সম্মেলন করে বলেছে যে সানেম বিদেশি অর্থে এসব ‘ভ্রান্ত’ গবেষণা ও জরিপ চালিয়ে যাচ্ছে। আমি যতদূর জানি, সানেম পরিচালক ড. সেলিম রায়হানের কাছেও শুনেছি, সংস্থাটি সরকারের হয়েও অতীতে অনেক গবেষণা ও নীতি-পরামর্শ প্রণয়ন করেছে। অনেক সময় সরকার তা সাদরে গ্রহণও করেছে। নির্বাচনের বছরে এসে অপ্রিয় সত্য সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হয়েছে?
আসলে সরকারের উচিত লুটেরা ব্যবসায়ী-সিন্ডিকেটের পূজা না করে অবাধ ভর্তুকিহীন নয়া উদারনৈতিক বাজার দর্শনের অনুসারী না হয়ে দরিদ্রদের সুরক্ষার জন্য তাদের দ্রুত ক্ষুধা থেকে মুক্তি দিয়ে তাদের জন্য খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে আনা। দরিদ্রদের পাবলিক ফুড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম (পিএফডিএস)-এর আওতাভুক্ত করে তাদের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সেটিই হবে প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তা না হলে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জিত হলেও এটি ক্ষুধামুক্তিতে পরিণত হতে পারবে না। রাজনৈতিক গণতন্ত্রও অর্থনৈতিক গণতন্ত্রে পরিণত হবে না।
সানেম প্রকাশিত জরিপ প্রতিবেদনটির ইংরেজি শিরোনামের বাংলা অর্থ হতে পারে এমন ‘বাংলাদেশের দরিদ্রতর পরিবারের জীবিকার ওপর মূল্যস্ফীতির প্রভাব : সানেম পরিচালিত দেশব্যাপী জরিপের ফল’। চলতি বছরের ৯-১৮ মার্চ পরিচালিত এই সময়োচিত জরিপের জন্য সানেমকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
প্রতিবেদনের শেষপর্যায়ে সানেম কিছু আশু করণীয়ের প্রস্তাব করেছে। যেমন বাজারে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ বাড়াতে হবে। সেজন্য অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং বিকল্প আমদানির উৎস খুঁজে বের করতে হবে। খাদ্যপণ্যের দাম কমিয়ে দরিদ্র মানুষের আয়ের নাগালের মধ্যে আনতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে অসুবিধাগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বাড়াতে হবে। যেমন টিসিবি কার্ডের বর্ধিত ব্যবস্থা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কার্যকর সমন্বয় করে সঠিক লোকের জন্য সঠিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা, দুর্নীতি ও অপাত্রে দান বন্ধ করা ইত্যাদি। পাশাপাশি বাজার মনিটরিং জোরদার করা। আশু করণীয়ের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি কাঠামোগত পরিবর্তনের কথাও বিবেচনা করা যেতে পারে।
যেমন- ক. উৎপাদনশীল শ্রমের মালিকদের জন্য ফসলি জমির অভিগম্যতা নিশ্চিত করার জন্য অনুপস্থিত ভূস্বামীদের জমি সরকারের ভূমি-ব্যাংকে নির্দিষ্ট বন্ডের বিনিময়ে অধিগ্রহণ করে পুনর্বণ্টনের ব্যবস্থা করা। অনুপস্থিত ভূস্বামীরা এখন যে হারে নগদ খাজনার বিনিময়ে জমি ভাড়া দিচ্ছেন, সেটাই তাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারি ল্যান্ড ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে করবেন। পরবর্তী সময়ে সরকার তা উৎপাদনশীল শ্রমের মালিকদের কাছে কৃষি উপকরণ বা ঋণ পুঁজিসহ অর্পণ করবে। এভাবে সামাজিক অসমতা দূর হবে। ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। জমির পরিকল্পিত ব্যবহার নিশ্চিত হবে। এটি হবে এক নতুন ধরনের রক্তপাতহীন ভূমি সংস্কার। খ. বাজার বা সরবরাহ ব্যবস্থায় উল্লম্বিক সংশ্লেষণের মাধ্যমে উৎপাদক থেকে ক্রেতা পর্যন্ত নানা ধরনের বিপণন সমবায় তৈরির মাধ্যমে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য থেকে ভোক্তা ও উৎপাদক উভয়কে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। গ. বৃহৎ সিন্ডিকেট, একচেটিয়া আমদানি ব্যবসায়ী, একচেটিয়া বাজার নিয়ন্ত্রক ইত্যাদির বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। ঘ. বাজার দাম সম্পর্কে প্রতিনিয়ত সব তথ্য সবার জন্য নিয়মিত প্রাপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ঙ. গ্রামের ছোট-বড় অসংখ্য এসএমইর জন্য একটি আলাদা ব্যাংক ও আলাদা মন্ত্রণালয় গঠন করে বৃহতের একচেটিয়া আধিপত্য খর্ব করে ক্ষুদ্র ও মাঝারিদের নিয়ে গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতামূলক বাজার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এভাবেই সম্ভব হবে দ্রব্যমূল্য সমস্যার একটি গ্রহণযোগ্য আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক সমাধান।
লেখক : অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
-বাবু/এ.এস