# অনৈতিক সুবিধা নিতে না পারায় কৌশলে হত্যা, বলছে পরিবার
# পরিবার পরিকল্পনা মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা কর্মচারীদের ক্ষোভ ও হতাশা
নরসিংদীর রায়পুরায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে মেডিকেল অফিসার ডা. মনোয়ারুলের হত্যা না আত্মহত্যা এখনো পরিস্কার হয়নি। তবে পুলিশ এটিকে আত্মহত্যা ধরে নিয়ে তদন্ত করছে। একজন ডাক্তার ঢাকায় এসে কেন আত্মহননের পথ বেছে নিল এর কারণ অনুসন্ধানে একাধিক টিম কাজ করছে। তবে পরিবারের দাবি তবে পরিবারের দাবি তাকে কৌশলে হত্যা করা হতে পারে। গুটি কয়েক কর্মকর্তার নিকট পুরো অধিদপ্তর জিম্মি। এখানে ডা. মনোয়ারের নিকট থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে না পারায় আর এ ঘটনা ঘটিয়েছে।
এদিকে তদন্ত হচ্ছে অধিদপ্তর থেকেও। ডা. মনোয়ারকে কেন মানসিক চাপে রাখা হয়েছিল, কেনই বা স্বেচ্ছায় অবসরে যান এগুলো উঠে আসছে তদন্তে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, তদন্তে ডা. মনোয়ারকে যারা বার বার মানসিক চাপে রেখেছিল তাদের কয়েকজনের নাম উঠে আসছে। তদন্ত শেষে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের সুপারিশ করে আবেদন করা হবে।
অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) খান মো: রেজাউল বলেন, আমাদের তদন্ত চলমান। আজ মঙ্গলবার তদন্তের প্রতিবেদন দেয়ার কথা থাকলেও মনে হয় সম্ভব হবেনা। আমরা খুঁটি নাটি সব তদন্তের মধ্যে রাখছি। তার এ ঘটনার পেছনে যাদের ইন্ধন থাকবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এখানে কোন প্রকার ছাড় দেয়া হবেনা।
পুলিশ বলছে, যেহেতু ময়না তদন্ত রিপোর্ট এখনো আসেনি সেহেতু আমরা ঘটনাকে হত্যা বলতে পারিনা। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে মনে হয়েছে এটি আত্মহত্যা। তবে একজন ডাক্তার কেন অধিদপ্তরে এসে আত্মহত্যা করবে সেটির তদন্ত করা হচ্ছে। এখানে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আসবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এদিকে পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির পদে নিয়োগ বাণিজ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় ডা. মনোয়ারুল হককে হত্যা করা হয় বলে দাবি করেছেন স্বজনরা। তাঁরা বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনৈতিক আবদার রক্ষা না করায় তাঁকে শায়েস্তা করতে ফন্দি আঁটা হয়। কৌশলে তাঁর কার্যালয় থেকে ফাইল সরিয়ে বেকায়দায় ফেলা হয়। পরে হিসাব দিতে না পারায় ওঠে অডিট আপত্তি। সেগুলো কাটিয়ে উঠতে চাইলেও বিরুদ্ধে থাকা কর্মকর্তারা সব জটিল করে তুলছিলেন। সর্বশেষ গত সোমবার তিনি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন সচিব। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে গোপন স্থানে আঘাত করে তাঁকে হত্যা করা হয়।
গত মঙ্গলবার (৪ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তর থেকে মনোয়ারুল হকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি নরসিংদীর রায়পুরায় উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনায় তেজগাঁও থানায় একটি অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়েছে।
মৃতের ভাই সাবেক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা মনিরুল হক বলেন, মনোয়ারুল হকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ছিলেন নরসিংদী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক অরবিন্দ দত্ত। তিনি নিম্নপদস্থ কিছু কর্মচারীর নিয়োগের ব্যাপারে সুপারিশ পাঠাতে বলেছিলেন। তবে যাঁদের জন্য সুপারিশ করতে বলা হয়েছিল, তাঁরা উপযুক্ত না হওয়ায় মনোয়ারুল রাজি হননি। তখন তাঁকে বলা হয়, নিয়োগের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থ পাওয়া যাবে। তাঁকেও এর ভাগ দেওয়া হবে। আর সুপারিশ না করলে ফল ভালো হবে না। পরে তিনি বাধ্য হয়ে সেই ব্যক্তিদের নিয়োগে সুপারিশ করেন। তবে কৌশলে উল্লেখ করেন যে, তাঁরা নিয়োগ পাওয়ার মানদণ্ডে উত্তীর্ণ হননি। ফলে এই ফাইল পরে উচ্চ পর্যায় থেকে ফেরত আসে। সেসঙ্গে উপপরিচালককে তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়। এতে তিনি ক্ষিপ্ত হন। পরে ২০২০ সালে করোনাকালে ‘হোম অফিস’ চলছিল। সে সময় তিনি নিজস্ব লোক দিয়ে রায়পুরা কার্যালয় থেকে কিছু ফাইল বের করে অন্যত্র নিয়ে পুড়িয়ে ফেলেন। ২০২১ সালে সে ফাইলগুলো নিরীক্ষা করতে চান উপপরিচালক। সংগত কারণেই সেগুলো পাওয়া যায়নি। পরে ফাইলে থাকা হিসাব ঠিকঠাক দিতে না পারায় মনোয়ারুলের বিরুদ্ধে এক কোটির বেশি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে বিভাগীয় মামলা হয়। ফাইল না পাওয়া গেলেও তদন্তে দেখা যায়, যেসব কর্মচারীর বেতন-ভাতার হিসাব সেখানে ছিল, তারা ঠিকঠাক সেই টাকা পেয়েছেন। তবে ফাইল হারানোকে গাফিলতি হিসেবে বিবেচনা করে তাঁর এক বছরের ইনক্রিমেন্ট স্থগিত করা হয়।
মনিরুল জানান, এসব ঘটনার পর ওই উপপরিচালকের অধীনে কাজ করবেন না উল্লেখ করে ২০২২ সালের শুরু থেকে স্বেচ্ছা অবসরে যাওয়ার জন্য আবেদন করেন মনোয়ারুল। ফাইল অগ্রগামী হতে হলে উপপরিচালকের স্বাক্ষর লাগে। তিনি স্বাক্ষর না করায় প্রক্রিয়া ঝুলে থাকে। পরে পুরোনো অডিট আপত্তির সঙ্গে নতুন করে আরও কিছু টাকার হিসাবের গরমিলের নথি তৈরি করে অবসর আবেদনের ফাইলের সঙ্গে জুড়ে অধিদপ্তরে পাঠানো হয়। এর মধ্যে গত বছরের ডিসেম্বরে তাঁর চাকরির মেয়াদ শেষ হয়। কিন্তু আগের বিষয়টি ঝুলে থাকায় তাঁর বেতন আটকে ছিল। আবার অবসরের আদেশ জারি না হওয়ায় পেনশনও চালু হয়নি। গত সোমবার তিনি এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে মন্ত্রণালয়ে যান। তখন সচিব সব শুনে তাঁর ফাইল এনে দেখেন, নিষ্পত্তি হওয়া পুরোনো অডিট আপত্তি আবারও পেশ করা হয়েছে। তাই তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের তিন দিনের মধ্যে কারণ দর্শাতে বলেন যে, কেন এই আপত্তি অবৈধ ঘোষণা করা হবে না। পর দিন মঙ্গলবার এ প্রক্রিয়ার হালনাগাদ তথ্য পেতে অধিদপ্তরে যান মনোয়ারুল।
এ বিষয়ে নরসিংদী জেলা পরিবার পরিকল্পনা কার্যালয়ের উপপরিচালক অরবিন্দ দত্ত সাংবাদিকদের বলেন, কর্মচারী নিয়োগের জন্য মনোয়ারুল হককে কোনো সুপারিশ করতে বলা হয়নি। কারণ এ জন্য তাঁর সুপারিশের প্রয়োজনই নেই। আর তাঁর অফিসের কিছু ফাইল পাওয়া যাচ্ছিল না। তাঁর ভাষ্য ছিল, অফিস স্থানান্তরের সময় সেগুলো হারিয়ে যায়। ফাইল সরিয়ে ফেলার অভিযোগ অবান্তর। অন্যদিকে ডা. মনোয়ারুলের ঘটনায় মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চরম ক্ষোভ ও হতাশা তৈরী হয়েছে। তারা বলছেন, গুটি কয়েক কর্মকর্তার কারণে পুরো অধিদপ্তর দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। জিম্মি হয়ে আছে তাদের নিকট। তাদের ইচ্ছাই সবকিছু হয়, তারা না চাইলে কিছুই হয়না। সবই তাদের নিকট অসহায়।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে মাঠ পর্যায়ের কয়েকজন ডাক্তার বলেন, মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মহসীন আহমেদ ও অধিদপ্তরেরে সহকারী পরিচালক (পার্সোনাল-১) আব্দুল মান্নানের ইশারায় সবকিছু হয়। তারা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে বদলী, নিয়োগ থেকে শুরু করে সবকিছুই নিয়ন্ত্রন করছেন। ডা. মনোয়ারের বিরুদ্ধে অডিট আপত্তিতেও হাত রয়েছে আব্দুল মান্নানের। সহকারী পরিচালক (কর্ড) মতিউর রহমানসহ হাত রয়েছে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদেরও।
কর্মকর্তারা বলছেন, ধরে নেয়া যাক ডা. মনোয়ার আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু একজন সুস্থ সবল ডাক্তার মানুষকে কতভাবে বিপর্যস্ত করলে সে আত্মহত্যা করতে তার শতভাগই তারা করেছেন। বিশেষ করে তার বিরুদ্ধে কথিত অডিট আপত্তি নিস্পত্তি করতে ৫০ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়ার ঘটনায় ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
তবে ঘুষ চাওয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন দাবি করেছেন উপ-সচিব মহসীন আহমেদ। তিনি বলেন, আমি ওই ডাক্তারকে চিনিইনা। হয়তো সে আমাকে চেনে না। আমি মন্ত্রণালয়ের তারা অধিদপ্তরের আমার বিরুদ্ধে এ ধরনের কথা কেমনে বলে? একই দাবি করে সহকারী পরিচালক (পার্সোনাল-১) আব্দুল মান্নান বলেন, ডাক্তার মনোয়ারকে তিনি চেনেনই না। তার সঙ্গে দাপ্তরিক কোন সম্পর্কই নেই। তবে তার ঘটনা দুঃখজনক।
এদিকে নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে অধিদপ্তরের হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, পারিবারিক সমস্যা ও হতাশার কারণে তিনি আত্মহত্যা করেন বলে আমার মনে হয়। স্বজনের অভিযোগ ভিত্তিহীন। পুলিশ বিষয়টি তদন্ত করছে। তদন্ত শেষে তারাই বিস্তারিত জানাবে।
তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহ আলম বলেন, আমরা খুব নিবিড়ভাবে বিষয়টি তদন্ত করছি। একজন ডাক্তারের এমন মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে আমরা কাজ করছি। আর তার এখনো পোষ্টমর্টেম রিপোর্ট আসেনি। রিপোর্ট আসলে হত্যা না আত্মহত্যা পরিস্কার হওয়া যাবে।
-বাবু/এ.এস