বুধবার ১৮ জুন ২০২৫ ৪ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ১৮ জুন ২০২৫
বিশ্বনেতৃত্বের জন্য চীনের করণীয়
রেজাউল করিম
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২৩, ৬:০৩ PM

চীনকে বিশ্বনেতৃত্বের জন্য আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চীন, ভারত ও রাশিয়াকে এক প্লাটফরমে দাঁড়াতে হবে। এর সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোকে পাশে দাঁড় করাতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমেরিকার সঙ্গে রয়েছে ইউরোপ, ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা। এরা অর্থনীতি ও সামরিক উভয় দিকে মহাপ্রতাপশালী। পশ্চিমারা জানে. চীন হতে যাচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষ। তাই চীনকে আটকাতে তারা ভারতকে কাছে টানছে। চীন-ভারত যুদ্ধ হলে পশ্চিমারা ভারতের পক্ষে যুদ্ধ করবে। তারা এখন যেটা করছে ইউক্রেনে। তাই চীনকে বিশ্বনেতৃত্ব দিতে হলে ভারতকে সঙ্গী করতে হবে, তার সাথে যুদ্ধের মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। সে সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে চীন ভীতি রয়েছে তা দূর করতে হবে।

আমেরিকা নিজেকে গণতন্ত্রের ধারক বাহক ও রক্ষক মনে করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মাঝে-মধ্যে গণতান্ত্রিক দেশসমূহকে নিয়ে সম্মেলনের আয়োজন করে গণতন্ত্রের সবক দেন। কিন্তু বহির্বিশ্বে আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি কি গণতান্ত্রিক? গণতন্ত্রে প্রতিপক্ষ থাকবে, ভিন্ন মত পথ থাকবে, মানুষ সেখান থেকে ভালোটা বেছে নেবে। আমেরিকা কি বিশ্বে তার প্রতিপক্ষ রাখতে চায়? মোটেও না। আমেরিকার প্রতিপক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতন্ত্র। সমাজতন্ত্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে মোকাবেলা করতে সে ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠা করে ন্যাটো। ন্যাটো একটি সামরিক জোট। তার পাল্টা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে গঠিত হয় ওয়ারসো প্যাক্ট। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেল, সমাজতন্ত্র বিদায় নিল। ওয়ারশো প্যাক্টের অস্তিত্ব বিলুপ্ত হলো। কিন্তু ন্যাটো বহাল রইল, আরো মোটাতাজা হলো। মোটাতাজাকরণ এখনো চলছে। উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে কেউ তার প্রতিপক্ষ হতে চাইলে তাকে অঙ্কুরেই বিনাশ করে দেওয়া।

আমেরিকার সেই উদ্দেশ্যকে চ্যালেঞ্জ করতে গিয়ে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে ন্যাটোর বেড়াজালে আটকে গেছে। এ অবস্থায় বিশ্ব বহু মেরকরণের দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্ববাসী আমেরিকার একক কর্তৃত্ব থেকে মুক্তি চায়। আমেরিকা তার ডলার বাণিজ্য দিয়ে সারা বিশ্বকে শুষে খাচ্ছে। আমেরিকার স্বার্থের অনুকূলে নয় এমন রাষ্ট্র বা শাসককে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের তকমা লাগিয়ে তাকে হয়রানি করা, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা দেওয়া তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। আমেরিকাই তার প্রয়োজনে উগ্রবাদী ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠী সৃষ্টি করে। আবার প্রয়োজন ফুড়িয়ে গেলে তার উপরে বোম্বিং করে। স্বার্থই আমেরিকার নীতি, গণতন্ত্র ও মানবতা তার বুলি। পৃথিবীতে সবচেয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে আমেরিকার দ্বারা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার হচ্ছে প্রধান মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী। আর তাকে দেওয়া হয়েছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার। কে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাবে তা আমেরিকার ইচ্ছাতেই ঘোষিত হয়। জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এমনকি আন্তর্জাতিক আদালত সবই আমেরিকার অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হয়।

এমতাবস্থায় চীন বিশ্ব নেতৃত্বে এগিয়ে আসছে। এটা একটা আশার আলো। বিশ্ববাসীরও প্রত্যাশা বিশ্ব নেতৃত্বে চীন এগিয়ে আসুক এবং আমেরিকার একক কর্তৃত্ব থেকে বিশ্বকে মুক্তি দিক। এক্ষেত্রে চীনকে উদার, সহনশীল ও মানবিক হতে হবে। তার আইল ঠেলার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে। জল ও স্থল দিক দিয়ে একুশটি দেশের সাথে চীনের সীমান্ত রয়েছে। তাদের প্রায় দেশের সাথে সীমান্ত বিরোধ রয়েছে। তন্মধ্যে ভারতের সাথে চীনের সীমান্ত বিরোধ তুঙ্গে রয়েছে। এ নিয়ে ভারতের সাথে চীনের কয়েক দফা যুদ্ধ হয়েছে। ১৯৬২ সালে চীন অতর্কিত ভারত আক্রমণ করে কাশ্মির ও লাদাখের বিশাল অংশ দখল করে সিয়া চীন নাম দিয়েছে। বিগত শতকের পঞ্চাশের দশকে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌএনলাই, চেয়ারম্যান মাওসেতুং, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, মিসরের জামার আবদুল নাসের, যুগোশ্লাভিয়ার মার্শাল টিটো প্রমুখ গড়ে তুলেন ন্যাম। ন্যাম ছিল জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (Non Aligned Movement). চৌএনলাই জওহরলাল নেহরুকে দাদা বলে সম্বোধন করতেন। তিনি নেহরুকে ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে দেননি যে, তিনি তার পিঠে ছুড়িকাঘাত করতে পারেন। চীনের ভারত আক্রমণে জওহরলাল নেহরু হতভম্ব হয়ে যান এবং ঐ দুশ্চিন্তায় অবশেষে ঐ বছরেই তিনি মারা যান। ১৯১৪ সালে ভারত ও তিব্বতের মধ্যে ম্যাকমোহন লাইন দ্বারা সীমান্ত চিহ্নিত হয়। ব্রিটিশ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ম্যাকমোহনের নাম অনুসারে এ সীমান্ত লাইনের নাম হয় ম্যাকমোহন লাইন। ১৯৫১ সালে চীন তিব্বত দখল করে নেওয়ার পর থেকে চীন উক্ত সীমান্ত লাইন মানতে নারাজ। তারপর থেকে চীন ও ভারতের মধ্যে সীমান্ত বিরোধ লেগেই আছে।

আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যকে ইরান ও সৌদি বলয়ে ভাগ করে রেখেছিল। চীনের মধ্যস্থতায় ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে সম্প্রীতি সম্ভব হয়েছে। এতে করে মধ্য প্রাচ্যে সম্প্রীতির হাওয়া বইছে। সৌদির সাথে সিরিয়ার ও কাতারের এবং কাতারের সাথে বাহরাইনের, সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে ইরানের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ অবসানের আভাস মিলছে। কেননা ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহী শিয়াদের সমর্থন দেয় ইরান। আর সৌদি আরব সমর্থন দেয় হুতিবিরোধী সুন্নি সরকারকে। হুতিদের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত সৌদি আরব। এখন ইরান ও সৌদির মধ্যে বন্ধুত্ব হওয়ায় ইয়েমেন যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটতে চলেছে। এখানে চীনের ভূমিকা ইতিবাচক। এ রকম ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে চীন বিশ্বের অন্যান্য বিরোধ মীমাংসায় ভূমিকা রাখতে পারে।

ভারত ও চীনে বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ লোক (১৪০+১৪০= ২৮০ কোটি) বসবাস করে। দু’দেশে একে অপরের জন্য রয়েছে বিশাল বাণিজ্য যা দু’দেশের অর্থনীতির জন্য অপরিহার্য। অর্থনীতির জন্য দু’দেশের সুসম্পর্ক একান্ত প্রয়োজন। চীনকে বিশ্বনেতৃত্বের জন্য আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। সে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় চীন, ভারত ও রাশিয়াকে এক প্লাটফরমে দাঁড়াতে হবে। এর সঙ্গে মুসলিম দেশগুলোকে পাশে দাঁড় করাতে হবে। মনে রাখতে হবে, আমেরিকার সঙ্গে রয়েছে ইউরোপ, ইসরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, কানাডা। এরা অর্থনীতি ও সামরিক উভয় দিকে মহাপ্রতাপশালী। পশ্চিমারা জানে. চীন হতে যাচ্ছে তাদের প্রতিপক্ষ। তাই চীনকে আটকাতে তারা ভারতকে কাছে টানছে। চীন-ভারত যুদ্ধ হলে পশ্চিমারা ভারতের পক্ষে যুদ্ধ করবে। তারা এখন যেটা করছে ইউক্রেনে। তাই চীনকে বিশ্বনেতৃত্ব দিতে হলে ভারতকে সঙ্গী করতে হবে, তার সাথে যুদ্ধের মনোভাব ত্যাগ করতে হবে। সে সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোতে যে চীন ভীতি রয়েছে তা দূর করতে হবে।

জাপানকেও কাছে টানতে হবে। জাপানে পারমানবিক বোমা ফেলেছে আমেরিকা। সেই আমেরিকার সাথে জাপানের বন্ধুত্ব হতে পারে না। জাপান বাধ্য হয়ে আমেরিকার গোলামি করছে। জাপান নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পেলে আমেরিকার গোলামি করার কথা নয়। ইউরোপের দেশগুলো শত শত বছর যুদ্ধ করেছে, দুই দু’টো বিশ্বযুদ্ধে সম্মুখীন হয়েছে। তারপরেও যদি তারা একীভূত হতে পারে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করতে পারে, একই মুদ্রা ইউরো গ্রহণ করতে পারে, তবে চীন, ভারত, জাপান, ভিয়েতনাম, কোরিয়া কেন পারবে না? সকলকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। প্রত্যেক দেশের সংবিধানকে সমুন্নত ও শ্রদ্ধা জানাতে হবে। হোক সে সংবিধান রাজতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক বা গণতান্ত্রিক। মায়ানমারের মতো সংবিধান লংঘনকারী কোনো সরকারকে আশ্রয়-প্রশ্রয় বা স্বীকৃতি দেওয়া যাবে না। প্রয়োজনে ন্যাটোর বিকল্প জোট গঠন করতে হবে। ইউরোপকে বুঝাতে হবে যে, এক সময় আমেরিকা ছিল ইউরোপের কলোনি। আজ তারা হয়েছে আমেরিকার কলোনি।

আমেরিকার নেতৃত্বকে খর্ব করতে হলে ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। ডলারের বিকল্প মুদ্রা বের করতে হবে। ব্রিক (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা) বিকল্প হতে পারে। ব্রিক দেশগুলো মিলে বিকল্প মুদ্রা বের করতে পারে। ব্রিকের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। ডলার বাদ দিয়ে নিজ নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য হতে পারে। অবশ্য এ কাজটি স্বল্পাকারে হলেও শুরু হয়েছে। চীন, রাশিয়া, ইরান, ভারত, ব্রাজিল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রভৃতি দেশের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় লেনদেন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন দেশের মধ্যে এ লেনদেন ছড়িয়ে দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে না পারলে আমেরিকার কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করা কঠিন হবে। ধীরে ধীরে মুদ্রার সংখ্যা কমিয়ে অভিন্ন মুদ্রার দিকে যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় বিশ্বকে একক মুদ্রায় নিয়ে আসতে পারলে। 
বর্তমান বিশ্ব আমেরিকার একক নেতৃত্বের কারণে নুঁইয়ে পড়েছে। পৃথিবীতে ক্ষমতার ভারসাম্য দরকার। এ জন্য বিশ্বব্যবস্থায় বহু মেরুকরণ জরুরি। বিশ্বের মানুষ আমেরিকার উপর বিরক্ত। তারা বিকল্প নেতৃত্ব খুঁজছে। এ মুহূর্তে চীন হতে পারে বিকল্প নেতৃত্ব। চীন একা না পারলে ব্রিক এর মাধ্যমে তা করতে পারে। বিশেষ করে চীন, রাশিয়া ও ভারত একই সমান্তরালে না পৌঁছতে পারলে আমেরিকাকে মোকাবেলা করা বড়ই কঠিন।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত