শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫ ১৩ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ২৭ জুন ২০২৫
আমাদের প্রতি বৈষম্যের অবসান হোক
সুধীর বরণ মাঝি
প্রকাশ: বুধবার, ৩ মে, ২০২৩, ১২:২৩ PM আপডেট: ০৩.০৫.২০২৩ ১২:২৫ PM

এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোন কিছুই স্থীর নয়। সবকিছুই পরিবর্তনশীল, গতিশীল। শুধুমাত্র কলেজের শরীরচর্চা শিক্ষকের পদটি ছাড়া। যার শুরু এবং অবসর একই স্থানে। ক্ষেত্রে দিন যায় দিন আসে, মাস যায় মাস আসে, বছর যায় বছর আসে, যুগের পর যুগ। কিন্তু অনৈতিক নিয়মের বেড়াজালে আমরা একই স্থানে স্থির থাকি। আমরা শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে কলেজে নিয়োগপ্রাপ্ত। আমাদের পদবি শরীরচর্চা শিক্ষক। শরীরচর্চা শিক্ষক পদে নিয়োগ, শরীরচর্চা শিক্ষক পদে কর্মরত আবার শরীরচর্চা শিক্ষক পদে থেকেই চাকরি থেকে অবসর। যা আমাদের প্রতি চরম অবহেলা এবং অবিচার। এটা আমাদের জন্য লজ্জাজনক এবং সেই সাথে অপমানজনকও বটে। একই যোগত্যা নিয়ে যারা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন তারা পদোন্নতির মাধ্যমে সহকারী প্রধান শিক্ষক, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য পদে পদোন্নতির সুযোগ পান। কিন্তু আমরা যারা কলেজে শরীরচর্চা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাই তাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। যত বিপত্তি আমাদের বেলায়। ২০১৮ সালের পূর্ব পর্যন্ত কলেজ পর্যায়ের শরীরচর্চা শিক্ষকরা ছিলেন তৃতীয় শ্রেণি পদমর্যদায় এবং বেতন ভোগ করতেন দ্বিতীয় শ্রেণির। আর এখন মামলার মাধ্যমে মহামান্য হাইকোর্টের আদেশ বলে কলেজ পর্যায়ের শরীরচর্চা শিক্ষকগণ  দ্বিতীয় শ্রেণি পদমর্যদা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির বেতন স্কেল লাভ করেন। কলেজে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়ার বিধান থাকলেও শরীরচর্চা পদে নিয়োগপ্রাপ্তদেও ক্ষেত্রে পদোন্নতির কোনো বিধান নেই। যতটুকু জানি বর্তমান সময়ে কলেজে শরীরচর্চা শিক্ষক পদে কর্মরত শিক্ষকদের প্রায় ৯০ ভাগ শিক্ষকই শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। অন্যান্য দপ্তরে তাদের চেয়ে কম যোগ্যতা নিয়ে এসএসসির পর শধুমাত্র তিন বছরের ডিপ্লোমা করে কলেজ শরীরচর্চা শিক্ষকদের চেয়েও অনেক বেশি সুযোগ-সুবিধা ও পদমর্যাদা ভোগ করেন। যত বিপত্তি, যত অভিযোগ শরীরচর্চা শিক্ষকদের বেলায়।

শারীরিক ও মানসিক সুস্থ জাতি গঠনে শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা এবং  শরীর চর্চা শিক্ষকদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি জাতীয় অনুষ্ঠানে একজন শরীর চর্চা শক্ষক অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তারা শিক্ষার্থীদের মধ্যে জাতীয় চেতনা গড়ে তোলেন, দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করেন।  আমাদের শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে এবং জাতির জাতীয় উন্নয়নে জন্য স্কুল, কলেজগুলোতে শারীরিক শিক্ষা অধিক প্রয়োজন। দীর্ঘস্থায়ী সুখী জীবনের মূল চাবিকাটি হলো শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলা। শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলা প্রাতিষ্ঠানিক শ্রেণির সাথে সমান অবস্থানে থাকা উচিত। শারীরিক শিক্ষা মূলত জীবনের শিক্ষা। শারীরিক শিক্ষা ছাড়া সাধারণ শিক্ষার পূর্ণতা আসে না। শারীরিক শিক্ষা নিজেকে রক্ষা করতে শেখায়, সঠিক সঙ্গী নির্বাচন করতে, পরাজয়কে মেনে নিয়ে নতুনভাবে জয়ের জন্য প্রস্তুত হতে শেখায় খেলাধুলার পরদর্শিতার মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশসহ পুষ্টি, স্বাস্থ্য, প্রাথমিক চিকিৎসার প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর জ্ঞানদান করে।

একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধ জাতি গঠনে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ সবল যুবসমাজ প্রয়োজন। যে সমস্তু গুণ থাকলে দেশের প্রতিটি নাগরিক শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হয় ও নিছক ভাবাবেগ পরিহার করতে পারে এবং সুস্থ সবল ও দায়িত্বজ্ঞান সম্পন্ন নাগরিক হয়ে গড়ে উঠে। শারীরিক শিক্ষা মানুষকে এ গুণগুলো অর্জনে সহায়তা করে। সময়ের দাবীর সাথে আমাদেরও দাবি শারীরিক শিক্ষা ও খেলাধুলাকে পূর্ণাঙ্গ বিষয় হিসেবে চালু করে এই বিষয়ের শিক্ষকদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করুণ, শিক্ষকদের পদোন্নতির বিধান করুন। এতে শিক্ষকগণ যেমন সম্মানিত হবে, তেমনি জাতিও শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ হয়ে বেড়ে উঠবে। আমাদের দেশের উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিপিএড, সম্মান এবং মার্স্টাস কোর্স চালু থাকলেও  স্কুল এবং কলেজ পর্যায়ে শারীরিকি শিক্ষা ও খেলাধুলা বিষয়টি এখনো অবহেলিত, উপেক্ষিত। কলেজ পর্যায়ে শারীরিক শিক্ষা বিষয়টি চালু করা এখন সময়ের চাহিদায় পরিণত হয়েছে।  শারীরিক শিক্ষা একধরনের বিজ্ঞান। যা প্রতিমুহূর্তে বিকশিত ও সমৃদ্ধ হচ্ছে। কিন্তু এ বিষয়ের কলেজ শিক্ষকরা ঠিক একস্থানেই থেকে যাচ্ছেন।  বিকশিত এবং সমৃদ্ধ জ্ঞানের সাথে কলেজ শারীরিকি শিক্ষার শিক্ষকদের পদোন্নতি এবং নতুন নতুন কলাকৌশলের সাথে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন।

আমরা জানি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাঁর গোটা পরিবার খেলাধুলাপ্রিয়, খেলাধুলার সাথে সর্ম্পকৃত এবং পৃষ্ঠপোষক করা একটি পরিবার। বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও খেলাধুলাকে প্রচণ্ড ভালোবাসেন এবং খেলাধুলাকে সর্বাধিক গুরুত্ব ও সহযোগিতা করেন। তাঁর সময়েই খেলাধুলার সর্বাধিক বিকাশ লাভ করে। আর ঠিক এই সময়েই শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলা স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে অবহেলিত থাকবে, উপেক্ষিত থাকবে এটা সত্যিই আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।

আমরা দেখি পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই সুস্থ জাতি গঠনের লক্ষ্যে শারীরিক শিক্ষা এবং খেলাধুলা বিষয়কে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে চালু রাখ রাখা হয়েছে। কলেজ পর্যায়ে একজন শরীরচর্চা শিক্ষক কলেজের প্রশাসনিক কার্যক্রম, শিক্ষার্থীদের শৃঙ্খলা রক্ষায় দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলা, ইংরেজি এবং আইসিটি বিষয়ের শিক্ষকের বাইরে শারীরিক ও খেলাধুলাই বিষয়ের শিক্ষকই একমাত্র শিক্ষক যিনি সকল ছাত্রদের কাছে সমানভাবে পরিচিত।

একজন শরীরচর্চা শিক্ষক ছাত্রদের শুধুমাত্র খেলাধুলাই শেখান না, তিনি ছাত্রদের শেখান স্বাস্থ্য, পরিবেশ, জীবনমান, হেরে যাওয়াকে মেনে নিয়ে জয়ের জন্য নতুন নতুন উদ্যোমে  শুরু  সম্পর্কে। তিনি ছাত্রদের শেখান কীভাবে বড় মানুষ হতে হয়, কীভাবে স্বপ্ন দেখতে হয় এবং স্বপ্নপূরণে সততা এবং দক্ষতার সাথে পরিশ্রম করতে হয়। তিনি ছাত্রদের আরও শেখান দেশপ্রেমিক মানুষ হতে, নেতৃত্ব দিতে, কীভাবে বিপদে ধৈর্য্য ধরে হাল ধরতে হয়, সততা, নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে। একজন শরীরচর্চা শিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। প্রতিষ্ঠানের সমস্ত শিক্ষার্থীর কাছে তিনি অতিপরিচিত সদালাপী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একজন বন্ধুরূপী শিক্ষক। শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত অনেক সুবিধা-অসুবিধার কথা নির্ভয়ে তুলে ধরতে পারে যা অন্যান্য শিক্ষকের কাছে অকপটে বলতে দ্বিধাবোধ করে।

আর আমরা সেই শরীরচর্চা শিক্ষকরা এতোটাই হতভাগা যে, আমাদের হাহাকার , আমাদের আর্তনাদ কেউ শুনে না। কেউ বুঝে না আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। অন্যদের পদোন্নতির সুযোগ থাকলেও আমাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ নাই। কলেজ পর্যায়ে সব শিক্ষকের প্রারম্ভিক পদ ‘প্রভাষক ’ হলেও শরীরচর্চা শিক্ষকগণ এই ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার। এ কারণে আমরা পদবঞ্চিত। বেতন-ভাতা যাই হউক না কেন, মর্যাদার দিক থেকে আমরা এক ধাপ নিচে অবস্থান করছি। ফলে মানসিক হীনমন্যতার মধ্যে আমাদের দিনাতিপাত করতে হয়।

যদি স্বাভাবিক ভাষায় বলি, তবে বলতে এইভাবে কলেজ শারীরিক শিক্ষকদের পদোন্নতি সময়ের দাবি এবং এটা তাদের নৈতিক অধিকার।  আমাদের প্রতি বৈষম্যের অবসান হউক। তাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রীসহ ঊর্ধ্বতন সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলছি আমাদের হাহাকার, আমাদের আর্তনাদ, আমাদের চিৎকার শুনুন এবং লাঘবে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করুন। এতে দেশ জাতি সবারই মঙ্গল হবে বলে বিশ্বাস করি।

লেখক :  শিক্ষক, হাইমচর সরকারি মহাবিদ্যালয়, হাইমচর, চাঁদপুর

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত