মানসম্মত শিক্ষার প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি যারা করে থাকেন তারা হলো শিক্ষক। শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড এটা হলো আমাদের কমন একটি বাক্য। কিন্তু মেরুদণ্ডকে সোজা রাখার জন্য যা করার প্রয়োজন তা আমরা আদৌ করতে পারছি কি না? অথবা এটা বাস্তবায়নে কতটুকু চেষ্টা করছি সেটা ভেবে দেখেছি কি? মুখে অধমরা সবকিছুই করছি আবার অনেক ক্ষেত্রেই কাগজে-কলমে লোক দেখানো। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার মানোন্নয়নে কাজের চেয়ে কথা বলছি বেশি এবং যা চলছে এককথায় তা চাপাবাজি।
আমরা এখনও শিক্ষার ব্যবহৃত অর্থকে ব্যয় হিসেবেই দেখছি কিন্তু ভেবে দেখছি না এটা বিনিয়োগ। আমরা যারা এ শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট না তারা আবার বলছি অনেক হয়েছে কিন্তু কি হয়েছে তা আবার বলতে পারছি না। সবচেয়ে বড় কথা হলো রাষ্ট্রের যাদের এ বিষয়টি নিয়ে ভাবার কথা তারা কতটুকু ভাবছে? বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার স্তরে আবার রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধাপ। শিক্ষাব্যবস্থাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে প্রতিটি স্তরের দিকেই নজর দিতে হবে। আমারা কেবলমাত্র সরকারিকরণ এবং বেতন-ভাতাদি ও অবকাঠামো নির্মাণকেই শিক্ষার উন্নয়ন হিসেবে ভাবছি। কিন্তু একবারও ভেবে দেখছি এসব হলেই কি শিক্ষার মানগত পরিবর্তন হবে? তবে হ্যাঁ এটা মেনে নিতে হবে যে এইসব সুযোগ-সুবিধা শিক্ষার মানগত পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করে। একটা সময় ছিল দেশের মেধাবীরা শিক্ষাকে শ্রেষ্ঠ পেশা হিসেবে গ্রহণ করতো আর্থিক সুবিধা ছাড়াই কিন্তু সময় অনেক পরিবর্তন হয়েছে বদলে গেছে সমাজব্যবস্থা। পরিবর্তন এসেছে মানুষের জীবনযাত্রায়। কেবলমাত্র নেশায় আজ এ জায়গায় কেউ আসছে না কারণ ইতোমধ্যে আমরা শিক্ষা ব্যয়কে খরচ বলে শিক্ষাকে পণ্য বানিয়েছি। তাই রাতারাতি এ জায়গা থেকে ফিরে আসাও সম্ভব নয়। অনেক ক্ষেত্রে যারা এটাকে নেশা হিসেবে নিতে চাইবে তাদের পক্ষেও সম্ভব না কারণ বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা বাস্তবায়ন করা জটিল।
অন্যদিকে সমস্যাটা হল আমাদের দেশের শিক্ষার সকল স্তরে সরকারি এবং বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর সুযোগ সুবিধার মাঝে ব্যাপক ব্যবধান। দেশের মাধ্যমিক স্তরে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষাই সরকারি এবং প্রাইভেট শিক্ষার মধ্যভাগে অবস্থান। যাকে আমরা বলছি এমপিওভূক্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। যে শ্রেণিটায় শিক্ষকরা বেশি বঞ্চিত হচ্ছে যার ফলে সে জায়গায় মেধাবীরা আসতে আগ্রহ প্রকাশ করছে না। এখনও মাঠ পর্যায়ে শিক্ষকদের জরিপ করলে দেখা যাবে শিক্ষকতা চাকরিটা নেহায়াত বিপদে পড়ে এবং বয়সের শেষপর্যায়ে অন্য চাকরি না পেয়ে। অনেক পরিচিত জনকে দেখেছি এমপিওভুক্ত কলেজের চাকুরি ছেড়ে প্রাথমিক স্কুলে যোগ দিয়েছেন কেবল মাত্র সরকারের কোঠায় নাম লিখিয়ে সরকারি সুযোগ-সুবিধা পাবার জন্য। তবে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকতার ক্ষেত্রে আবার ভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। শিক্ষকতার যেসব বিষয়ে প্রাইভেট পড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে তারা আবার আর্থিক দিক দিয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে একথা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চল ও শহরের শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। যার ফলে শিক্ষা এখন শহরমুখী। শহরের শিক্ষাব্যবস্থায় অভিভাবকরা অধিক পরিমাণে বিনিয়োগ করাতে শিক্ষকরাও শহরমুখী। ফলে গ্রামে প্রচণ্ডভাবে পরিমাণে মানসম্মত শিক্ষক সংকট বিদ্যমান।
অন্যদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক সংকট থাকায় শিক্ষার্থীরা অধিক পরিমাণে প্রাইভেটের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষকের অনুপাতের বিষয়টি অনেক জটিল। প্রাইভেট প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য এটি একটি অন্যতম কারণ। রাষ্ট্র থেকে সব ধাপেরই সমান সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা রয়েছে। পাঠ্যক্রম এবং ব্যক্তিজীবনে চলার জন্য শিক্ষক হচ্ছে শিক্ষার্থীর নিকট মডেল স্বরুপ তাই এসব শিক্ষকের জীবনমানের উন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার উন্নয়নও সম্ভব নয়।
এখন কথা হল এসব শিক্ষকের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার জন্য রাষ্ট্র কি ব্যবস্থা নিচ্ছে আবার সামাজিক স্বীকৃতি নিয়ে আমরা কি ভাবছি? দিনকে দিন এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ সেই সাথে কতটুকু এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা সেটাই অনেক বড় প্রশ্ন? মানের দিক দিয়ে কেবলমাত্র এমপিওভূক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পিছিয়ে তা বলা যাবে না। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সরকারি, এমপিওভুক্ত ও প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা একই সিলেবাসে পাঠদান করে থাকে এছাড়াও সরকার কর্তৃক বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করে থাকে তারপরও সুযোগ-সুবিধা ভিন্ন রকমের একটা এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের পীড়া দিয়ে থাকে। একটা সময় নিয়োগ নিয়েও ট্রল করা হতো এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের। এখন অবশ্য এনটিআরসিএর নিয়োগের ফলে এটা ধামাচাপা পড়েছে। এখন নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ হচ্ছে; যার ফলে কিছু মেধাবীদের শিক্ষাব্যবস্থায় আগমন হচ্ছে। তাই সময় হয়েছে এখন সকল প্রকার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করে মেধাবীদের শিক্ষাকে প্রথম পছন্দ হিসেবে বিবেচনা করানো। নিজেদের উন্নয়নের লক্ষে শিক্ষকরা শিক্ষাব্যবস্থাকে সরকারিকরণের দাবি জানিয়ে আসছে অনেক দিন ধরেই কিন্তু সরকার এতে সায় দিচ্ছে না বিভিন্ন সমস্যা দেখিয়ে।
তাই সরকারিকরণ সম্ভব না হলে নিম্নের দাবিগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে এমপিওভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো দরকার। স্বাধীনতা শিক্ষক কর্মচারী ফেডারেশনের দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাড়ি ভাড়া ও চিকিৎসা ভাতা সরকারি শিক্ষক কর্মচারীদের সমপরিমাণ করা, বোর্ড এফিলিয়েশন প্রাপ্ত সব স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলো এমপিওভুক্ত করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন দপ্তর থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধীদের প্রত্যাহার করা, সব শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে ডিভাইস, খাতা-কলমসহ অন্যান্য শিক্ষাসামগ্রী দেওয়া এবং সরকারি উদ্যোগে দুপুরে টিফিনের ব্যবস্থা করা, শূন্যপদের বিপরীতে ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলির ব্যবস্থা করা, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক কর্মচারীদের দুর্দশা লাঘবে শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর বোর্ডের জন্য পর্যাপ্ত টাকা বরাদ্ধ করা এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কমিটিতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করে স্কুলপর্যায়ে ন্যূনতম ডিগ্রি পাস ও কলেজ পর্যায়ে ন্যূনতম মাস্টার্স পাস করা স্বচ্ছ ইমেজের ব্যক্তিদের মনোনয়ন করা।
সময়ের বিবেচনায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠান প্রধান এবং সকল শিক্ষক কর্মচারীদের বদলির ব্যবস্থা করা। এছাড়াও প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সহ-প্রধান এবং সকল স্তরের কর্মচারী নিয়োগ সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেওয়া। এসব নিয়োগ এবং তহবিল ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা গেলে স্থানীয় পর্যায়ে কমিটি গঠনে জটিলতা অনেকাংশেই কমে আসবে বলে মনে হয়। তাই বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হলে সিংগভাগ প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তিতে নজর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। কারণ শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে এ জটিলতা বিরাজ করায় মানসম্পন্ন শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে বাধার সম্মুখিন হতে হচ্ছে।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট
-বাবু/এ.এস