বাল্যবিয়ে বাংলাদেশে একটি গুরুতর সামাজিক সমস্যা। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানে বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। ইউনিসেফ-এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ৫৯ শতাংশ মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়, ২২ শতাংশের ১৫ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়। বাল্যবিয়ে মেয়েদের উপর স্বাস্থ্যসমস্যাসহ বিভিন্ন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাল্যবিয়ের কারণে তাদের শিক্ষার সুযোগ সীমিত হওয়া, পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধিসহ নানা ধরনের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়।

সম্প্রতি প্রকাশিত জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ)-এর এক প্রতিবেদন অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এখনো বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। ওই প্রতিবেদন অনুসারে, দেশের ৫১ শতাংশ মেয়ের বয়স ১৮ বছর হওয়ার আগেই বিয়ে হয়ে যায়। ‘৮ বিলিয়ন লাইভস, ইনফিনিট পসিবিলিটিস : দ্য কেস ফর রাইটস অ্যান্ড চয়েসস’ শিরোনামের প্রতিবেদনটি ১৯ এপ্রিল বিশ্বব্যাপী প্রকাশিত হয়েছে। প্রতিবেদনটি ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের বাল্যবিবাহের তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, মালদ্বীপে বাল্যবিয়ের হার দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে কমÑ মাত্র ২ শতাংশ। এছাড়া শ্রীলঙ্কায় ১০ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৮ শতাংশ, ভারতে ২৩ শতাংশ, ভুটানে ২৬ শতাংশ, আফগানিস্তানে ২৮ শতাংশ এবং নেপালে ৩৩ শতাংশ বাল্যবিবাহ ঘটছে।

এছাড়া বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান একধাপ উন্নতি করে পঞ্চম স্থানে রয়েছে। গতবছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। নতুন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ বুরকিনা ফাসোর অবস্থানও পঞ্চম। আফ্রিকার আরও পাঁচটি দেশ শীর্ষ চারটি স্থান দখল করে আছে। বাল্যবিয়ের হার সবচেয়ে বেশি নাইজারে। নাইজারে বাল্যবিয়ের হার ৭৬ শতাংশ। সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক এবং চাদ যৌথভাবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে যেখানে বাল্যবিয়ের হার ৬১ শতাংশ। এর পরে রয়েছে মালি (৫৪ শতাংশ), মোজাম্বিক (৫৩ শতাংশ) এবং দক্ষিণ সুদান (৫২ শতাংশ)। সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লিথুয়ানিয়া, যুক্তরাজ্য এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে বাল্যবিবাহ নেই।

ইউএনএফপিএর বাংলাদেশ প্রতিনিধি ক্রিস্টিন ব্লকুস উল্লেখ করেন যে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বাল্যবিয়ে হয়। বাংলাদেশে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মায়েরা প্রতি হাজারে ৭৪টি সন্তানের জন্ম দেন। বাল্যবিবাহ মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ায়।

বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের বেশ কিছু জটিল ও আন্তঃসম্পর্কিত কারণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে দারিদ্র্য, লিঙ্গবৈষম্য, শিক্ষার অভাব, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি, সীমিত আইনি সুরক্ষা, সংঘাত ও স্থানচ্যুতি ইত্যাদি।

বাংলাদেশের অনেক পরিবার অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তাদের মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেয়। বাল্যবিয়েকে প্রায়ই আর্থিক বোঝা কমানোর এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা উন্নত করার উপায় হিসেবে দেখা হয়। প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক রীতিনীতি এবং লিঙ্গবৈষম্য কন্যাসন্তান ও নারীদের অবমূল্যায়নের দিকে নিয়ে যায়। বাল্যবিয়ে প্রায়ই মেয়েদের সতীত্ব ও সম্মান রক্ষার উপায় হিসেবে দেখা হয় এবং তাদের স্বাধীনতা ও চলাফেরা সীমিত করা হয়।

শিক্ষার অভাব এবং বাল্যবিয়ের নেতিবাচক পরিণতি সম্পর্কে সচেতনতার অভাব এর প্রসারে ভূমিকা রাখে। গ্রামাঞ্চলের অনেক পরিবার তাদের মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং সামগ্রিক সুস্থতার উপর বাল্যবিয়ের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব সম্পর্কে অবগত নয়। সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতি বাল্যবিয়ের ধারণাকে প্রচার করে, বিশেষ করে কন্যাশিশুদের ক্ষেত্রে। এই নিয়মগুলো প্রায়শই ধর্মীয় নেতা, সমাজের প্রবীণ এবং পরিবারের সদস্যদের দ্বারা জোরালোভাবে সমর্থন করা হয়। যদিও বাংলাদেশে বাল্যবিয়ে বে-আইনি, তবুও মেয়েদের বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করার আইনগুলো প্রায়ই প্রয়োগ করা হয় না বা দুর্বলভাবে প্রয়োগ করা হয়। সংঘাত ও বাস্তুচ্যুতির সময়ে, বাল্যবিয়ে বৃদ্ধি পেতে পারে কারণ পরিবারগুলো তাদের মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতা ও অস্থিরতা থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে।

বাল্যবিয়ে পারিবাকির জীবনে বেশ কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যে সব মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয় তাদেরসহ শিশুমৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে, সেইসাথে গর্ভাবস্থা এবং প্রসবের সাথে সম্পর্কিত জটিলতার ঝুঁকি থাকে। তারা তাদের স্বামীর কাছ থেকে শারীরিক ও যৌন সহিংসতার শিকার হতে পারে।

যে সকল মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয় তারা প্রায়ই স্কুল ছেড়ে দেয়, যা তাদের শিক্ষা এবং ব্যক্তিগত বিকাশের সুযোগ সীমিত করে। এটি দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের চক্রকে স্থায়ী করতে অবদান রাখতে পাওে, মেয়েদের অর্থনৈতিক সুযোগে প্রবেশ সীমিত করতে পারে এবং আর্থিক স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষমতা হ্রাস করতে পারে। এটি দারিদ্র্য এবং লিঙ্গবৈষম্যের চক্রকে স্থায়ী করতে পারে। যেসব মেয়ের অল্প বয়সে বিয়ে হয় তাদের প্রায়ই সীমিত সামাজিক সমর্থন থাকে এবং তারা তাদের পরিবার এবং সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন হতে পারে। বাল্যবিবাহ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন হতাশা, উদ্বেগ এবং চাপ, বিশেষ করে যদি মেয়েটিকে বিয়েতে বাধ্য করা হয়। মেয়েদের পছন্দ এবং তাদের জীবনের পথ বেছে নেওয়ার সুযোগ সীমিত করে। তারা শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হওয়ার আগে প্রাপ্তবয়স্কদের ভূমিকা এবং দায়িত্ব নিতে বাধ্য হতে পারে, যা তাদের শারীরিক এবং মানসিক সুস্থতার উপর প্রভাব ফেলতে পারে। সামগ্রিকভাবে, বাল্যবিয়ে মেয়েদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক সুযোগ, মানসিক স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতার উপর উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ করার জন্য একটি ব্যাপক সংস্কার পদ্ধতির প্রয়োজন যা এই অন্তর্নিহিত কারণগুলো মোকাবিলা করে এবং বিয়ে বিলম্বিত করতে  মেয়েদের সামগ্রিক সুস্থতার উন্নতি করতে সহায়তা করে। সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকার বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের লক্ষ্যে বেশ কিছু আইন প্রণয়ন করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন, যা ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের এবং ২১ বছরের কম বয়সী ছেলেদের বিয়ে নিষিদ্ধ করে। তবে, এই আইনগুলো প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় যেখানে বাল্যবিয়ে বেশি। বাল্যবিয়ের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সমাজের মানুষকে সচেতন করার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্রচারণা শুরু করেছে এবং মেয়েদের শিক্ষায় বিনিয়োগের মতো বিকল্প অভ্যাসগুলো প্রচার অব্যাহত রেখেছে। সরকার বাল্যবিয়ে নিরুৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন অর্থনৈতিক প্রণোদনা বাস্তবায়ন করেছে। যেমন মেয়েদের উপবৃত্তি, ছোট ব্যবসা শুরু করার জন্য প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান।

বাল্যবিয়ে সম্পর্কে মনোভাব এবং সামাজিক রীতিনীতি পরিবর্তন করতে জনসাধারণের সচেতনতা বৃদ্ধির প্রচারণা সাহায্য করতে পারে। এই প্রচারাভিযানে ধর্মীয় নেতা, সম্প্রদায়ের প্রবীণ এবং অন্যান্য প্রভাবশালী স্টেকহোল্ডারদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায় শিক্ষা। তাই, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ প্রদান, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায় নারীর ক্ষমতায়নে সাহায্য করতে পারে।

অর্থনৈতিক দুর্দশা বাল্যবিয়ের অন্যতম প্রধান কারণ। দরিদ্র এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মেয়েদের অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া বন্ধ করতে পারে। মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর নির্ধারণ করা আছে; তা যথাযথভাবে অনুসরণ করা এবং এ আইন লঙ্ঘনকারীদের শাস্তি প্রদান নিশ্চিত করতে হবে; কাউন্সেলিং, স্বাস্থ্যসেবা এবং আইনি সহায়তার প্রবেশাধিকার সহজলভ্য করতে হবে। ক্ষতিগ্রস্ত মেয়েদের প্রতিরোধ, সুরক্ষা এবং সহায়তার জন্য বিভিন্ন ধরনের কমর্সূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।