বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে সবার জন্য সুস্বাস্থ্য। কিন্ত দেশের বেশির ভাগ চিকিৎসকের কাছেই নীতি-নৈতিকতা, মানবিক মূল্যবোধ বা দায়িত্ববোধের পরিচয় পাওয়া যায় না। ওষুধ নিয়েও চলছে নানা ধরনের অনিয়ম। মানহীন অসংখ্য ওষুধ কম্পানি দেশে গড়ে উঠেছে। এসব কম্পানির ওষুধ রোগ সারানোর পরিবর্তে মানবদেহে নানা রকম সমস্যা সৃষ্টি করছে। স্বাস্থ্য খাতে তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে পারলেই এ ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব।
উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় চিকিৎসাসেবায় সর্বাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের পাশাপাশি সার্বক্ষণিক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। আমাদের দেশে বেসরকারি হাসপাতালগুলো এ রকম সেবা প্রদানের চেষ্টা করলেও দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো সরকারি হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। তাই সরকারি হাসপাতাল পরিচালনায় আরোবেশি পরিকল্পিত ভূমিকা গ্রহণ প্রয়োজন। এজন্য চিকিৎসকদের কর্মস্থলে উপস্থিতির বিষয়টি নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে অবহেলা করলে পুরো চিকিৎসা খাতই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। কারণ চিকিৎসকের অনুপস্থিতিতে নার্সরা রোগীদের সেবা দেন। এক্ষেত্রে যথাযথ দক্ষতার ঘাটতিতে ভুল চিকিৎসার উদাহরণ দেখা যায়। চিকিৎসাসেবা মূলত একটি মানবিক পেশা। অসুস্থ মানুষের সেবা করার মহান ব্রত নিয়েই এ পেশায় আসতে হয়। নিছক অর্থ উপার্জনের জন্য ডাক্তারি পেশায় এলে এ পেশার মর্যাদা ক্ষুণ্ন হবে। একজন চিকিৎসকের অবশ্যই টাকা উপার্জনের অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে আগে মূল কর্মস্থলকে প্রাধান্য দেয়া নৈতিক দায়িত্ব। সরকারি হাসপাতাল বাদ দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে বেশি শ্রম দেয়া নৈতিকতার কোনো সংজ্ঞার ভেতর পড়ে না। তাই উপযুক্ত কারণ ছাড়া কর্মস্থলে অনুপস্থিতির যে অভিযোগ রয়েছে, তা সত্য হলে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার।এজন্য সরকারকেই জনগণের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়।
সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গুলোয় পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম ও জনবলের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান আধুনিক নগর রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য। এক্ষেত্রে যেহেতু দেশের সিংহভাগ মানুষ এখনো সরকারি স্বাস্থ্যসেবার ওপর নির্ভর করে, সে হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোয় যথাযথ চিকিৎসা হচ্ছে কিনা তা যাচাই করতে হবে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকরা যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করেন না-এ অভিযোগ অনেক পুরনো। বর্তমান সময়ে ডিজিটাল হাজিরা মেশিন থাকার পরও কেন এমনটি হচ্ছে সেটি খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। আবার সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে অভিযোগের সত্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করার পরিপ্রেক্ষিতে নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা জরুরি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ থাকার পরও শুধু চিকিৎসকের অনুপস্থিতি স্বাস্থ্যসুরক্ষায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসকের উপস্থিতির হার অর্ধেকেরও কম। দীর্ঘদিন ধরেই এমনটি কেন হচ্ছে? এর সদুত্তর খুঁজে পাওয়া জরুরি। রাজধানী ও বিভাগীয় শহরের বাইরে জেলা-উপজেলায় সরকারি চিকিৎসকের অনুপস্থিতির হার তুলনামূলক বেশি। অর্থাৎ যেখানে চিকিৎসকদের উপস্থিতি অত্যধিক জরুরি, সেখানেই চিকিৎসক পাওয়া যায় না। এমনটি অব্যাহত থাকলে ঢাকামুখী চিকিৎসার যে স্রোত তা বিকেন্দ্রীকরণ অসম্ভব হয়ে যাবে। এমনকি জরুরি অবস্থায় একজন মুমূর্ষু রোগীর যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করা যাবে না। আবার রাজধানী ঢাকায়ও চিকিৎসকদের উপস্থিতির হার হতাশাব্যঞ্জক। তিন বছর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এক অভিযানে এ হার ৪০ শতাংশ বলে জানা যায়। তার মানে প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীতেও সরকারি হাসপাতালে যথাযথ চিকিৎসাসেবা মেলে না।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সরকারি স্বাস্থ্যপ্রতিষ্ঠানে চিকিৎসকের উপস্থিতির হার প্রায় ৮০ শতাংশ দাবি করা হচ্ছে। এমনকি জরুরি বিভাগে কখনো চিকিৎসক অনুপস্থিত থাকেন না-এ কথার সত্যতাও খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। এছাড়া চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত অন্য কর্মীদের ঘাটতি দূর করতে প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের অধিকাংশ মানুষ জেলা শহরে বাস করলেও জেলা পর্যায়ে সব রোগের চিকিৎসা নিশ্চিত করা যায়নি এখন পর্যন্ত। গুরুত্বপূর্ণ অনেক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। যার ফলে বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ে। এতে স্বাভাবিক চিকিৎসা কার্যক্রম ব্যাহত হয়। অন্যদিকে আরেক পরিসংখ্যানে দেখাচ্ছে বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবার প্রায় ৬৩ শতাংশ চিকিৎসা বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত প্রদান করছে। সরকারি হাসপাতালে শয্যা সংকট, জনবলের অপ্রতুলতার কারণে মানুষ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে এগিয়েছে। আর সেজন্যই বেড়েছে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা।
কিন্তু এতে করে সমস্যার সমাধান আসেনি। বেশির ভাগ বেসরকারি হাসপাতাল সাধারণ মানুষের জন্য ব্যয়বহুল এবং এদের অনেকের মান নিয়ে প্রশ্ন আছে। তাছাড়া নিজেদের সার্বিকভাবে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা মানসম্পন্ন ও উন্নত করতে না পারা এবং জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার ক্ষেত্রে দাতাদের নির্দেশিত উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রভাব থাকায় স্বাস্থ্যের মতো সেবাখাত বেসরকারিকরণ প্রক্রিয়ায় যেতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে বাড়ছে অর্থনৈতিক বৈষম্য। দেশের স্বাস্থ্যখাতকে বেসরকারিকরণ স্বাস্থ্যসেবাকে পণ্যে পরিণত করেছে। সাধারণ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্যসেবা যথাযথভাবে পাচ্ছে না বলেই বাধ্য হয়ে অনেকেই বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে যেখানে চিকিৎসাসেবা প্রত্যাশীরা চিকিৎসার নামে তাদের কাছে জিম্মি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী, আমাদের দেশের প্রায় ৫২ লাখ মানুষ প্রতি বছর নিজ পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে দরিদ্র হচ্ছে।
আর বড় ধরনের আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে প্রায় সোয়া দুই কোটি মানুষ। প্রতিদিন বাড়ছে ডাক্তারি পরামর্শের ফি, চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ। চিকিৎসা সেবায় লাগামহীন ব্যয়ের বৃদ্ধির চিত্র দেখায় দেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের গবেষণা তথ্য। সেখানে বলা হচ্ছে, দেশে চিকিৎসা খাতে মানুষের ব্যয় ৪৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। বর্তমানে একজন রোগীর পেছনে যে ব্যয় হয়, তার ৭৩ শতাংশই সেবাগ্রহীতা ব্যক্তিকে বহন করতে হয়। চিকিৎসার এ ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতি বছর দেশে ৮৬ লাখ মানুষ আর্থিক সমস্যায় পড়ে। আর ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ অর্থাৎ প্রায় তিন কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেয়া থেকে বিরত থাকে। বিশ্লেষকদের মতে, কভিড-পরবর্তী দুই বছরে এ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে অন্তত ৫০ হাজার কোটি টাকা ওপরে।যেকোনো দেশের জনসাধারণের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম চাহিদা ও অধিকার হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবা বা স্বাস্থ্যসুরক্ষা। একটি দেশের অগ্রযাত্রায় সুবিন্যস্ত ও সুপরিকল্পিত স্বাস্থ্যসেবা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসুরক্ষার বিষয়টি আমাদের সংবিধানেও উল্লেখ আছে। জনগণের স্বাস্থ্যসুরক্ষা সরকারের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল। একটি দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে না চললে তার সরাসরি ফলাফল ভোগ করতে হয় সে দেশের সাধারণ মানুষকে। বাংলাদেশে তার যথেষ্ট প্রমাণ আমরা দেখেছি কভিড মহামারীর সময়। বিগত বছরগুলোয় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশে অনেক হাসপাতাল-ক্লিনিক নির্মাণ, বহু চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগসহ অত্যাধুনিক সব চিকিৎসা যন্ত্রপাতি কেনা থাকলেও। মহামারি শুরুর পর দেখা গেল এত কিছুর পরও হাসপাতালগুলোয় নেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা, নেই পর্যাপ্ত আইসিইউ ব্যবস্থা। আর তীব্রভাবে প্রকাশ পেয়েছে প্রশিক্ষিত জনবলের প্রবল সংকট। মূলত এমন দৈন্যদশা দেখে সারা দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার চিত্র সহজেই অনুমান করা যায়। স্বাস্থ্যসেবা খাতের মান উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে বার বার আলোচনা-সমালোচনা হলেও লক্ষণীয় পরিবর্তন আনতে আমরা এখনো সক্ষম হইনি।
এমনকি চিকিৎসাসেবায় যেভাবে লাগাতার লাগামহীন ভাবে ব্যয় বেড়েছে সে ব্যাপারেও যথাযথ নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন আনতে আমরা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। তবে স্বাস্থ্য খাতে উন্নয়নের জন্য যে একদম কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি তা বলা যাবে না, তবে আমরা সমন্বিত ও সার্বিকভাবে স্বাস্থ্যসেবা খাতকে অতিমাত্রার বাণিজ্যিকী করণ, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কবল থেকে রক্ষা করতে পারিনি। এজন্যই স্বাস্থ্যসেবা খাতের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য আজও পূরণ হয়নি। বর্তমানে ক্রমবর্ধমান রোগের কারণে জনগণকে মানসম্মত চিকিৎসাসেবা প্রদান সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটা সত্যি।
কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যকে শুধু চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিয়েও আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন সম্পূর্ণ নতুনভাবে স্বাস্থ্যনীতিকে দেখা, যা স্বাস্থ্যসেবার মৌলিক প্রয়োজন হিসেবে দেখে দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে কার্যকর ও সক্ষম করে তুলতে পারবে নীতিগত পরিবর্তন ও তার প্রায়োগিক পরিবর্তন না করা হলে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতকে বদলানো সম্ভব নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী, একটি ভালোমানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দেশের জাতীয় বাজেটের কমপক্ষে ১৫ শতাংশ বরাদ্দ হওয়া উচিত। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের বাজেটে টাকার পরিমাণ ক্রমে বাড়লেও তা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুপাতে নয়। সবার জন্য চিকিৎসাসেবা যেন পায় আর তা যেন সাশ্রয়ী হয় সেভাবে ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করে, স্বাস্থ্যখাতে যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ বাড়াতে হবে। সেবার মানোন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণ করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় এগোতে হবে। তাহলে স্বাস্থ্যখাতের প্রকৃত উন্নয়ন করা সক্ষম।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট
-বাবু/এ.এস