মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫ ২৪ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫
পাক সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ
রেজাউল করিম
প্রকাশ: সোমবার, ১৫ মে, ২০২৩, ৫:০৭ PM

পাকিস্তানের রাজনীতিতে ক্ষমতার মূল উৎস সামরিক বাহিনী। নির্বাচিত বা অনির্বাচিত যে সরকারই হোক না কেন তার এমন কোন ক্ষমতা নেই যে, স্বাধীনভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে পারেন। সেনাবাহিনী যতক্ষণ চাইবে একটি সরকার ততক্ষণ টিকে থাকতে পারবে। পাকিস্তানের বর্তমান বেসামরিক সরকারগুলো হচ্ছে সামরিক বাহিনীর গোলাম। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের রাজনীতিতে কলকাঠি নাড়তে থাকে। রাজনীতিবিদরা ছিলেন ঠুটো জগন্নাথ, হুকুমের দাস। কোন রাজনীতিবিদ হুকুম পালনে ব্যর্থ হলে তার আর রক্ষা নেই এবং রক্ষা ছিলও না। নেতারা ছিলেন সেনাবাহিনীর দয়ার উপর নির্ভরশীল। কেননা পাকিস্তানের কোনো নেতা নির্বাচিত ছিলেন না। ১৯৭০ সালের পূর্বে পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের কোন নির্বাচন হয়নি। জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান যতো দিন জীবিত ও ক্ষমতায় ছিলেন তারা গণতন্ত্রের কথা ভাবেননি। তারা মনে করতেন যে, মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান হয়েছে। এটাই বড় পাওনা। এখানে আবার গণতন্ত্র কী? ব্যক্তিই সব। পদের কোন ক্ষমতা ছিল না।

জিন্নাহ যখন গভর্নর জেনারেল ছিলেন তখন তিনি ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। ১৯৪৮ সালে তিনি মারা যাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী হন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দিন তখন হয়ে যান নিয়মতান্ত্রিক প্রধান। ১৯৫১ সালে লিয়াকত আলী খান আততায়ীর গুলিতে নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন হন প্রধানমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ হন গভর্নর জেনারেল। তখন গোলাম মোহাম্মদ হয়ে যান সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও গোলাম মোহাম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে বরখাস্ত করে জরুরি আইন জারি করেন। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিয়োজিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিযুক্ত করে ডেকে পাঠান। এ মন্ত্রিসভায় সামরিকবাহিনীকে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ পদ দেওয়া হয়। প্রতিরক্ষামন্ত্রী হন সেনাপ্রধান জেনারেল আইয়ুব খান, আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্যা। পাকিস্তানের গণপরিষদ গভর্নর জেনারেলের মন্ত্রিপরিষদ গঠন ও ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা হ্রাস করে একটি বিল পাস করলে গোলাম মোহাম্মদ গণপরিষদ ভেঙে দেন। গোলাম মোহাম্মদ অসুস্থ হয়ে ছুটিতে গেলে ইস্কান্দার মির্জা ভারপ্রাপ্ত গভর্নর জেনারেল হন ৭ আগস্ট ১৯৫৫ সালে। ৬ অক্টোবর ১৯৫৫ সালে তিনি গোলাম মোহাম্মদকে বরখাস্ত করে নিজেই গভর্নর জেনারেল হন। ২৩ মার্চ ১৯৫৬ সালে তিনি হন পাকিস্তানের প্রথম প্রেসিডেন্ট। ৭ অক্টোবর ১৯৫৮ সালে তিনি সামরিক আইন জারি করে সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত করেন। ২০ দিনে মাথায় ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান তাকে এক কাপড়ে লন্ডনে নির্বাসনে পাঠিয়ে নিজেই ক্ষমতা দখল করেন। শুরু হলো সামরিকবাহিনীর প্রত্যক্ষ শাসন। আইয়ুব খানের পরে ক্ষমতায় এলেন সেনাপ্রধান ইয়াহিয়া খান। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও জান্তা সরকার আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানান। শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধে বাঙালি বিজয়ী হন ১৬ ডিসম্বর ১৯৭১ সালে। পাকিস্তান খণ্ডিত হয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

১৯৭১ সালে বাঙালির কাছে পরাজয়ের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনী দেশি-বিদেশি চাপে ক্ষণিকের জন্য রাজনীতি থেকে আড়ালে চলে যায়। কিছুদিন পর সেনাবাহিনী তার স্বমূর্তি ধারণ করে। সেনাপ্রধান জিয়াউল হক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে অপসারিত করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন ৫ জুলাই ১৯৭৭ সালে। তিনি ভুট্টোকে অপসারণ করেই ক্ষান্ত হননি। তিনি তাকে ফাঁসিতে ঝুলান ৪ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে। ১৭ আগস্ট ১৯৮৮ সালে জেনারেল জিয়াউল হক রহস্যজনক বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন। ১৯৮৮ সালে নির্বাচনে জয়ী হয়ে ভুট্টো কন্যা বেনজির ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী হন। আগস্ট ৬ ১৯৯০ সালে তিনি বরখাস্ত হন। এরপর প্রধানমন্ত্রী হন নওয়াজ শরীফ। ১৮ জুলাই ১৯৯৩ সালে তাকে বরখাস্ত করা হয়। তারপর বেনজির ভুট্টো ২য় বার প্রধানমন্ত্রী হন। ৬ নভেম্বর ১৯৯৬ সালে তাকে পুনরায় বরখাস্ত করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭ সালে নওয়াজ শরীফ ২য় বার প্রধানমন্ত্রী হন। ১২ অক্টোবর ১৯৯৯ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশাররফ তাকে আটক করে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং ক্ষমতায় থাকেন ১৮ আগস্ট ২০০৮ পর্যন্ত। তারপরে প্রধানমন্ত্রী হন ইউসুফ রাজা গিলানি, রাজা পারভেজ আশরাফ, নওয়াজ শরীফ, শাহীদ খাকান আব্বাসী, ইমরান খান। এরপরে ১১ এপ্রিল ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী হন শেহবাজ শরীফ। এদের কেউ প্রধানমন্ত্রীর মেয়ার পূর্ণ করতে পারেননি। এদের আগের প্রধানমন্ত্রীগণও পারেননি। কারণ পাকিস্তানের ক্ষমতার কলকাঠি নাড়েন সেনাবাহিনী। তারা যাকে যে কয়দিন মর্জি হয়ে ক্ষমতায় রাখেন তিনি ততোদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেন।

২০১৩ সালে নওয়াজ শরীফ রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে ফেরার সময় তার গাড়িবহর সেনাবাহিনী আটকে দেয়। কারণ সে সময় সে রাস্তা অতিক্রম করছিল সেনাপ্রধানের গাড়ি। যেদেশে সেনাপ্রধানের গাড়ি পার হওয়ার জন্য সরকারপ্রধানের গাড়ি আটকে দেওয়া হয়, সেদেশের সরকার কত অসহায় তা সহজেই অনুমেয়। এ টার্মেও নওয়াজ শরীফ মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। তাকে শুধু ক্ষমতা ছাড়তেই বাধ্য করা হয়নি, তাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করে দেশছাড়া করতে বাধ্য করা হয়। তার দল মুসলিম লীগ নওয়াজকে ক্ষমতায় আনা হলেও এবং তার ভাই শেহবাজ শরীফকে প্রধানমন্ত্রী করা হলেও নওয়াজ শরীফকে কিন্তু পাকিস্তানে ফিরতে দেওয়া হচ্ছে না। কারণ সেনাবাহিনী তার প্রতি নাখোশ।

২০১৮ সালের নির্বাচনে পাক সেনাবাহিনী ইমরান খানের তেহরিক-ই- ইনসাফ পার্টিকে অলিখিত সমর্থন দান করে। ঐ নির্বাচনে তিন লক্ষাধিক সৈন্যকে মাঠে নামিয়ে দেওয়া হয়। সারাদেশে রটে যায়, সেনাবাহিনীর সাথে ইমরান খানের একটা বোঝাপড়া হয়েছে। সুতরাং এবার ক্ষমতায় আসছে ইমরান খান। নির্বাচনে ইমরান খানের জয় হয় এবং তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। বেশ কিছুদিন ভালোই চলছিল। তারপরে ধীরে ধীরে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। সরকার স্বাধীনভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কোনো কাজ করতে পারে না। সব নির্দেশনা আসে ক্যান্টনমেন্ট থেকে। পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারিত হয় সেনা সদরদপ্তর থেকে। পাকিস্তানের সামরিকবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই আরো ভয়াবহ। তারা সরকারের মধ্যে আরেক সরকার। তারা আমেরিকার খুবই অনুগত। আমেরিকার পরামর্শ ও অর্থানুকূল্যে ইসলামি জিহাদি বাহিনীর প্রজনন, উৎপাদন, বিপণন ও রপ্তানিতে আইএসআই-এর সুনাম রয়েছে। তাদেরই সৃষ্টি আফগানিস্তানের মুজাহিদিন, তালেবান বাহিনী। তবে অর্থ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব। আবার জঙ্গি দমনের নাম করে তারা আমেরিকার কাছ থেকে টাকা আনত।

যা-ই হোক নানা বিষয়ে ইমরান খানের সঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। ইমরান খান স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। এটা আমেরিকার ভালো লাগেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুতে ইমরান খান মস্কো সফরে গিয়ে পুতিনের সঙ্গে হাত মেলালে তার সিংহাসন নড়বড়ে হয়ে যায়। মস্কো সফরের দেড় মাসের মাথায় তিনি সিংহাসন হারান। ইমরান খানকে সিংহাসন থেকে বিতাড়িত করেও সেনাবাহিনী নিশ্চিন্ত থাকতে পারছে না। ইমরান খানের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। জরিপ সংস্থা গ্যালাপ এর জরিপ অনুযায়ী ৬১ শতাংশ জনগণ ইমরান খানকে সমর্থন করে। এটাই কাল হয়েছে তার জন্য। সেনাবাহিনীর ইচ্ছা রাজনীতি থেকে তাকে মাইনাস করা। সামনের অক্টোবরে জাতীয় নির্বাচন। সে নির্বাচনে ইমরান খানের বিপুল ভোটে নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তিনি যাতে সে নির্বাচনে অংশ নিতে না পারেন, সেজন্য তার বিরুদ্ধে মামলা হামলা গ্রেফতারি পরোয়ানা হতেই আছে। ৯ মে তারিখে ইমরান খান লাহোর হাইকোর্টে কোনো এক মামলায় আগাম জামিন চাইতে গেলে আধা সামরিক বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে। আদালত তাকে ৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। ১১ মে সুপ্রিমকোর্ট ইমরান খানের আটককে অবৈধ ঘোষণা করেছেন। দেখা যাক, সেনাবাহিন এখন কী করে?

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী রাজনীতির পাশাপাশি অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে। সামরিক বিশ্লেষক আয়েশা সিদ্দিকার মতে, পাকিস্তানের জাতীয় ব্যয়ের প্রায় এক তৃতীয়াংশ খরচ হয় সেনাবাহিনীর পেছনে। আর সেই সাথে দেশটির কৃষি ও শিল্প উৎপাদনসহ সরকারি-বেসরকারি নানা ধরনের ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী তাদের অর্থনৈতিক সুবিধার কথা বিবেচনা করে প্রতিষ্ঠা করে চারটি ফাউন্ডেশন। আর্মি ওয়েলফেয়ার ট্রাস্ট, নৌবাহিনী বেহরিয়া ফাউন্ডেশন, বিমানবাহিনী শাহিন ফাউন্ডেশন এবং পাকিস্তান অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ফাউন্ডেশন। এছাড়া তাদের জন্য রয়েছে বড় অংকের পেনশন ভাতা। এভাবে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের জন্য পাকিস্তান রাজনীতি ও অর্থনিীতির ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটাতে ব্যাহত হচ্ছে।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ, ফরিদপুর

-বাবু/ এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত