সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫ ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
প্রতিশোধ নেওয়ার নান্দনিকতা
এম এ কবীর
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৬ মে, ২০২৩, ১১:০৭ AM

সর্বানাশা পদ্মার আকাশে ঝলমলে রৌদ্র আর হালকা মিষ্টি বৃষ্টির খেলা ছিল। আকাশ ছিল নীল আর সাদা ভেলায় মোড়ানো, যেন আষাঢ়ে শরতের মেঘ বেড়াতে এসেছে। ভোর কাটতে না কাটতেই মাওয়ার আকাশ উজ্জ্বল হতে থাকে। পদ্মায় যেন দুঃখ মোচনের দিন। তাই প্রকৃতিতেও রং ধরেছিল। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লাখো মানুষ পদ্মার দু’পাড়ে নিরাপত্তাবেষ্টনীর বাইরে অধীর অপেক্ষায় ছিল। দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বপ্নপূরণের এই ক্ষণটি দেখতে শুধু সুবিধাভোগী জেলাগুলোরই নয়, সারাদেশ থেকে ভিড় করে অসংখ্য মানুষ। বহু কাক্সিক্ষত পদ্মাসেতুর দুয়ার খুলবে। সুধীসমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই সেতু শুধু সেতু নয়, শুধু ইট-সিমেন্ট-কংক্রিটের কাঠামো নয়, এই সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব। সক্ষমতার, মর্যাদার প্রতীক।’

প্রখ্যাত ভারতীয় ইতিহাসবিদ রণজিৎ গুহ লিখেছেন,  প্রতিবাদ মনুষ্যত্বের ধর্ম। এদিক থেকেই জীবজগতে মানুষের অনন্যতা, সে কেঁচো নয়, মেরুদণ্ড সোজা করে সে প্রতিবাদ করতে জানে। ঘোর স্বৈরাচারী সমাজেও প্রতিবাদ নীরব হয়ে থাকে না। যেমন, আমাদের পল্লিগাথা, পল্লিগীতি ও মঙ্গলকাব্যে পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে নারী-কণ্ঠের প্রতিবাদ বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুমূল্য সম্পদ বলে গণ্য হয়। বস্তুত, প্রতিবাদী ভূমিকাতেই মানুষ যুগে যুগে ইতিহাসের নায়ক হয়ে ওঠে; বিশেষ করে যখন একই যুগের এক পর্ব থেকে পর্বান্তরে পালাবদল হয়। যে শাসিত এত দিন বশ্যতা স্বীকার করে সমাজের ভার বহন করছিল, সে-ই তখন মাথা তুলে দাঁড়ায়, প্রভুশক্তি বিপন্ন বোধ করে। শাসকদের অভিধানে সেই বিপন্ন মুহূর্তগুলোর পরিচয় পাওয়া যায় বিপ্লব, বিদ্রোহ, অরাজকতা, শান্তিভঙ্গ, বিশৃঙ্খলা ইত্যাদি নামে। কিন্তু যে নামেই হোক, তীব্রতা ও বিস্তারের মাত্রা অনুযায়ী নামগুলোতে শাসনকর্তাদের অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠাই ব্যক্ত হয়। ওই সব নামের পরিভাষায় তারা যেন বলছে, হায় হায়, আইন অমান্য করা হল, যে আইন ছাড়া সমাজের সংহতি রক্ষা করা যায় না, সেই আইন ভাঙা হচ্ছে। তাদের দিক থেকে কথাটায় ভুল নেই। আইন ছাড়া শাসন চলবে কী করে? কিন্তু প্রতিবাদীর পক্ষেও তো অন্যায় আইন মেনে নেওয়া শক্ত। মেনে নিলে তার নিজের মনুষ্যত্ব নিজের কাছেই অপমানিত হবে। এই উভয়সংকটের সমাধান স্বৈরতন্ত্রে বেশ সহজ। কেননা, তার ভিত্তি বাহুবলে। তাই নির্দ্বিধায় হিংসার হাতিয়ারগুলো দিয়ে আইনের মান্যতা বজায় রাখা সম্ভব। বস্তুত, বাহুবলই যে আইনের উৎস, সে সত্য স্বৈরতন্ত্রী শাসকরা গোপন রাখার চেষ্টা করেন না। বরং তার দ্বারা শাসিতের মনে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করা প্রশাসনিক কর্তব্য বলেই গণ্য হয়ে থাকে।

কখনও কখনও জনমতের আদালতে সমগ্র সরকার ও শাসক দলকেই অভিযুক্তের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে, যদি নাগরিক অধিকার সম্পর্কে তাদের অবজ্ঞা ও অবহেলা শাসিতদের কাছে অসহ্য হয়ে ওঠে। রাজনীতিতেও বাহুবলই ক্ষমতার চরম নির্ণায়ক। তবে গণতন্ত্রে তার প্রয়োগ শাসিতের সম্মতি-সাপেক্ষ। এখানেই স্বৈরতন্ত্রের সঙ্গে এর মূলগত পার্থক্য। সে জন্যই আইন কী হবে এবং কীভাবে ব্যবহার করা হবে, তা নিয়ে রাজনীতিতে নানা মতের ও নানা পথের এত জটিলতা। সে জটিলতার কেন্দ্রীয় সমস্যা ভারসাম্যের। সম্মতি ও প্রতিবাদের এক পাল্লা যাতে অন্যটার চেয়ে বেশি ভারী হয়ে না পড়ে, সে বিষয়ে গণতন্ত্রের হুঁশিয়ারিতে ঢিলেমি অমার্জনীয়। ব্রিটেন ও ভারতের মতো পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রে তাই সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসক দলকে সতর্ক থাকতে হয়, যাতে গণভোটে নির্বাচিত কোনও প্রতিষ্ঠানে বিরোধী পক্ষের সম্মান ক্ষুণ্ন না হয়। এর জন্য অনেক প্রতীকী বিধিব্যবস্থাও আছে। আনুষ্ঠানিকভাবে সেগুলো মেনে না চললে শাসকগোষ্ঠীই জনসাধারণের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হয়। এ থেকেই বোঝা যায় যে, আইনসম্মত প্রতিবাদ গণতন্ত্রে অশ্রদ্ধেয় নয়। তাদের সম্পর্ক বৈরিতার নয়, আনুকূল্যের। কারণ, সংসদীয় আদর্শে শাসক ও বিরোধী উভয় দলই নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধি। সুতরাং, নির্বাচকদের ভালো-মন্দ দু’পক্ষেরই দায়িত্ব, এবং সে দায়িত্বে তারা একে অন্যের পরিপূরক।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের অংশীদারিত্বের ৫০ বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসকে পদ্মা বহুমুখী সেতুর একটি ছবি উপহার দেন।  ছবিটির বার্তা বহুবিধ এবং অনেকেই মনে করছেন, এটি মধুর প্রতিশোধ। কারণ ২০১২ সালে পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে ১২০ কোটি ডলারের ঋণ বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক; যদিও বিশ্বব্যাংক তার দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি এবং ২০১৭ সালে কানাডার আদালতেও তা প্রমাণ করতে পারেনি। পরে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হয় পদ্মাসেতু, যা গত বছরের ২৫ জুন উদ্বোধন করা হয়।

বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে এ সুদীর্ঘ সময়ে এর আগে বা পরে তেমন তিক্ততা দেখা যায়নি। বঙ্গবন্ধু বহুমুখী সেতু বা যমুনা সেতুতে অর্থায়ন করেছিল সংস্থাটি। এমনকি পদ্মাসেতুকাণ্ডের পর বাংলাদেশের উন্নয়নমূলক কর্মযজ্ঞে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকা আরও বেড়েছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর চলমান সফরেই আঞ্চলিক বাণিজ্য ও যোগাযোগ, দুর্যোগ প্রস্তুতি ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার পাঁচটি উন্নয়ন প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ২২৫ কোটি মার্কিন ডলার তথা প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। পদ্মাসেতুর অর্থায়নে ২০১০ সালে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক। সে অনুযায়ী এ সেতুর জন্য ২০১১ সালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর করে সরকার। একই বছর জাইকা, আইডিবি ও এডিবির সঙ্গেও পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। এরই মধ্যে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে আসে দুর্নীতির অভিযোগ। সেতু নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ ছিল সংস্থাটির। অবশেষে ২০১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। নিয়ম অনুসারে অন্যান্য সংস্থাও সেখান থেকে সরে আসে। এরপর প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে বক্তব্য দিয়ে পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ উড়িয়ে দেন এবং তখনই নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ঘোষণা দেন। অবশেষে বাংলাদেশ তার সক্ষমতা দেখিয়েছে।

পদ্মাসেতুর নির্মাণ বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য জরুরি ছিল। এটি বলা চলে, ১৯টি জেলাকে যুক্ত করেছে। এর ফলে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কৃষি, পর্যটন ও শিল্প বিকাশের অবারিত সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পদ্মাসেতুর সঙ্গে ইতোমধ্যে রেললাইনও সংযুক্ত হয়েছে। সড়কপথের পাশাপাশি রেলপথ চালু হওয়ার মাধ্যমে যোগাযোগের নতুন দিগন্তে সামগ্রিক অর্থনীতি ও মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। সে জন্য মানুষের স্বার্থেই সেতুটি জরুরি ছিল। আর বিশ্বব্যাংককে যে বার্তা দেয়ার দরকার ছিল, সেটা গতবছর পদ্মাসেতু উদ্বোধনের মাধ্যমেই সংস্থাটি পেয়ে গেছে। তবু  প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে পদ্মাসেতুর ছবি নিয়ে গেছেন। এ উপহারের মধ্যে রয়েছে প্রতিশোধের বার্তাও। বিশ্বব্যাংক পদ্মাসেতুর ছবিটি দেখে তাদের ভুল বুঝুক এবং বাংলাদেশের সঙ্গে তারা যে অন্যায্য কাজ করেছে; তা যেন অন্যদের সঙ্গে না ঘটে এটাই কামনা।

লেখক :  সভাপতি, ঝিনাইদহ জেলা রিপোর্টার্স ইউনিটি, ঝিনাইদহ

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত