বুধবার ৯ জুলাই ২০২৫ ২৫ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ৯ জুলাই ২০২৫
জি-৭ সম্মেলনে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির ব্যবধান
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ২৭ মে, ২০২৩, ১১:৩১ AM

জাপানের হিরোশিমায় বিশ্বের সাত বৃহৎ অর্থনীতির দেশের জোট জি-৭ এর শীর্ষ সম্মেলন সম্প্রতি শেষ হয়েছে। বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তির দেশগুলোর কাছে বিশ্বের প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে। সদ্যসমাপ্ত জি-৭ সম্মেলন চলমান তীব্র অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলা, পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাসকরণ, টেকসই উন্নয়ন, জলবায়ু পরিবর্তন, জ্বালানি ও পরিবেশ, খাদ্যনিরাপত্তা ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্তসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানের সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়েই শেষ হয়েছে। তবে সবচেয়ে নতুন বিষয় হলো এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের নীতি ও নিয়ম প্রবর্তনের গুরুত্বও উঠেছে। বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানবসভ্যতার জন্য হুমকি না ভালো এটা নিয়ে রীতিমতো বিতর্ক চলছে। সুতরাং একটি নীতিমালা থাকা প্রয়োজন এবং তা শক্তভাবে। এবারের আলোচ্যসূচির প্রথম সারিতেই ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। সম্ভবত এটাই ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানা যায়, মূলত রাশিয়াকে কীভাবে চাপে রাখা যায় এ বিষয়টি ছিল দেশগুলোর মধ্যে আলোচনায়। এসেছে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কথা। জানা যায়, জি-৭ এর সব দেশই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, না-কাটা হীরার বাণিজ্য রাশিয়ার সঙ্গে আপাতত বন্ধ রাখা হবে। এই সম্মেলন এমন এক মুহূর্তে অনুষ্ঠিত হয়েছে যখন বিশ্ব রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের ফলে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পৃথিবী এখন বহুমুখী সমস্যায় জর্জরিত। এর মধ্যে রয়েছে অর্থনীতি-জ্বালানি-খাদ্য-শরণার্থী সংকট এবং আবশ্যিকভাবেই পরিবেশ বিপর্যয়। পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকাতেও দেশগুলোর কাছে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রত্যাশা ছিল। পৃথিবী এখন অর্থনৈতিক দুর্দশায় এবং মূল্যস্ফীতির কবলে অর্থনীতি ভুগছে। বিশে^র উন্নত অর্থনীতির সাতটি দেশ ও একটি সংস্থা নিয়ে গঠিত এই জোটের কাছে বিশ্বের প্রত্যাশাও থাকে বেশি। পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেওয়া এবং বিশ্ব অর্থনীতিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য এসব দেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

একটি বিভক্ত বিশ্বের নেতৃত্বের ভবিষ্যতে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে এবং কোন পন্থায় অগ্রসর হবে তার করণীয় নির্ধারণ ছিল গুরুত্বপূর্ণ।

সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং পরিবেশগত দিক থেকে এমন একটি অবস্থা বিরাজ করছে যেখানে সর্বত্রই অস্থিরতা। দ্বন্দ্ব-সংঘাতে প্রাণহানির সাথে সাথে অতীতের তুলনায় বিপুল সংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ইথিওপিয়া, ইয়েমেন করোনা মোকাবেলার সাথে সাথে ব্যাপক হারে খাদ্য সংকটের কবলে পড়েছে। শ্রীলংকার অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। উন্নত বিশে^র দেশগুলোও নেই ভলো অবস্থায়। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ব্যাংকিংখাত নিয়ে ভুগছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির আগুনে পুড়তে হচ্ছে সেখানেও। পৃথিবীকে এসব সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। গতবছরের মূল সমস্যা ছিল করোনা ভাইরাস। এখনও সেই সমস্যা রয়েছেই। এ বছরের বড় সমস্যা হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যা পৃথিবীকে প্রায় থমকে দিয়েছে। জ্বালানি সংকটে টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থা নির্ধারণ করতে চাইছে দেশগুলো।

শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংগঠন হলো জি-৭। এর মধ্যে রয়েছে ফ্রান্স, কানাডা, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র। গত কয়েক দশক ধরেই চাপ প্রয়োগের একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। এটা যেমন কোনো দেশ নিজস্বভাবে করছে, মিত্রগত ভাবেও করা হচ্ছে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, জি-৭ রাশিয়া-ইউক্রেনের এই চলমান সামরিক সংঘাতে ইউক্রেনকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি করেছে। চীনের পরাশক্তিতে উঠে আসায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তবে বেইজিংকে একসাথে কাজ করারও আহ্বান জানিয়েছে জোটটি। জি-৭ বেইজিংকে জলবায়ু, ঝুঁকিপুর্ণ দেশগুলোর ঋণ পুনর্গঠন, বৈশি^ক স্বাস্থ্য এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার বিষয়ে একসাথে কাজ করার আহ্বান জানিয়েছে।

জি-৭ দেশের প্রত্যেকেই অর্থনৈতিক, সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী এবং একত্রিত হয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা ফলপ্রসূ হওয়ার কথা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং রাশিয়াকে কোণঠাসা করতে পশ্চিমা দেশগুলোর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার জেরে টালমাটাল অর্থনীতি। রয়েছে পরমাণু যুদ্ধের সম্ভাবনাও। অবশ্য সমাপণী বক্তব্যে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা বিশ^কে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার না করতে বিশ^কে আহ্বান জানিয়েছেন। আসলে এমন এক স্থানে এই সম্মেলন হচ্ছে যেখানে পরমাণু অস্ত্রের দগদগে স্মৃতি রয়েছে। সম্মেলন থেকে তাই প্রত্যাশা ছিল বিরাজমান বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের।

পৃথিবী ক্ষমতার দ্বন্দ্বে স্পষ্ট দুইভাগে বিভক্ত হতে চলেছে। যেখানে রাশিয়া-চীন ও পশ্চিমা দেশগুলো রয়েছে। মতবিরোধ এবং বর্তমান অশান্ত পরিস্থিতি দূর করতে এই সম্মেলন অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ ছিল। বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ভূরাজনীতি ক্রমেই অস্থিতিশীল এবং পরিবর্তন হচ্ছে। এককভাবে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিন হওয়ায় ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখতে মোড়ল দেশগুলো নিজেদের বলয় তৈরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ফলে গড়ে উঠছে শক্তিশালী বলয়। সেখান থেকেই নিজেদের কর্তৃত্ব খাটানোর চেষ্টায় নিজ নিজ প্রভাব খাটানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। চীন-রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক বরাবরই প্রতিযোগিতামূলক। চীন উঠতি পরাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রাশিয়ার সাথে ইউক্রেন ইস্যুতে ক্রমেই মতবিরোধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যুদ্ধের জন্য এর আগে অত্যাধুনিক অস্ত্রের সাথে ইউক্রেন ট্যাংকও পেয়েছে। এবার যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক এফ-সিক্সটিন যুদ্ধবিমান দিয়ে সহায়তা করতে পশ্চিমা মিত্র দেশগুলোকে সম্মতি দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এটি যুদ্ধের মোড় কোনদিকে ঘুরিয়ে দিবে সেটা এই মুহূর্তে বোঝা না গেলেও যুদ্ধের ময়দানে ইউক্রেন আরও শক্তিশালী হবে এটা নিশ্চিত। আবার এর সাথেই রাশিয়ার সাথে ইউরোপের দ্বান্দ্বিক মনোভাবে আরও তীব্র হতে পারে। এমনকি এটি যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে এবং যুদ্ধকে আরও বিস্তৃত করতে পারে। বিশ^ মোড়ল হওয়ার দৌড়ে যখন পরাশক্তিগুলো ছুটতে থাকে তখন প্রতিযোগিতামূলক পরিস্থিতি নতুন কিছু নয়। বলয় শক্তিশালী করার দৌড়ে চীন এখন অনেক এগিয়ে যাচ্ছে।

জি-৭ নেতাদের পরিকল্পনায় জলবায়ু ইস্যু এবং জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার বিষয়টিও আলোচনা করা হয়েছে।  সাত দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জন করার একটি পরিকল্পনার কথা বলেছে। এ ধরনের পরিকল্পনার কথা গত বছরেও উল্লেখ ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো এর রূপরেখা কী হবে বা এটি কীভাবে অর্জিত হবে সেটি স্পষ্ট নয়। তাছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে কিভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে সেটিও স্পষ্ট নয়। বরং  জলবায়ুগত পরিবর্তনের ফলে আমরা যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি এবং হতে যাচ্ছি যার ফলে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে তা বুঝতে পারছি। ফলে এটি ছিল অন্যতম প্রধান আলোচ্য ইস্যু হওয়া উচিত ছিল। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো উন্নত এবং উন্নত হওয়ার পথে অতিক্রমকারী প্রতিটি দেশকেই এই কার্বন নিঃস্বরণ মাত্রা কমিয়ে আনতে একসাথে কাজ করতে হবে।

গত ২০ মে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তেনিও গুতেরেস বলেছিলেন, জি-৭ এর উচিত প্রধান দেশগুলোর সাথে জলবায়ু পরিবর্তন এবং উন্নয়ন ইস্যুতে সক্রিয় সংলাপ এবং সহযোগিতা করা। যদিও সেটি সেভাবে হয়নি। আবার তাদের কার্বন নিঃস্বরণের মাত্রার ফলে যে জলবায়ু প্রতিক্রিয়ার তৈরি হচ্ছে বা হয়েছে তার ক্ষয়ক্ষতি বহন করতে হচ্ছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র রাষ্টগুলোকে। তাদের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবেলায় আর্থিক ক্ষতিপূরণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার পরিকল্পনা জি-৭ এর মতো উন্নত দেশগুলোর করা উচিত এবং বাস্তবায়ন করা উচিত। সেক্ষেত্রে সবাই একসাথে কাজ না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে সময় প্রয়োজন হবে। শিল্পোন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে আরও ইতিবাচক ভূমিকাই প্রত্যাশা করে। জি-৭ এর শিল্পোন্নত দেশগুলোও চায় এই অবস্থার অবসান হোক।

এজন্য এখন পৃথিবীতে যুদ্ধ, খাদ্য সংকট ইত্যাদি চেপে বসেছে। যুদ্ধ থামাতে হবে। যদিও তা থামার কোনোও লক্ষণই নেই। জি-৭ দেশগুলো এই যুদ্ধে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খরচ চালিয়ে যেতে চায়। পৃথিবী এই সমস্যা থেকে মুক্তি চায়। খাদ্য ও জ্বালানির মতো সংকট থেকে রেহাই চায়। মোট কথা এ দেশসমূহকে পৃথিবীর স্বার্থে কাজ করতে হবে। জি-৭ এর দেশগুলোর ওপর পৃথিবীর আস্থার বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। তবে বাস্তবতা হলো এ সবকে পাশ কাটিয়ে চীন ও রাশিয়ার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ সম্পর্ক এবং তা মোকাবেলার কৌশলই বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। যা আসলে পৃথিবীকে স্বস্তি দেওয়ার মতো যথেষ্ট নয়।  

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

-বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত