২৯ মে, সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। চট্টগ্রাম নগরীর চাঁদগাও এলাকা থেকে রেইঞ্জার (হিউমেন হলার) করে চকবাজারের বাসায় ফিরছিলেন পঞ্চাশোর্ধ রিতা দে। চকবাজার থানাধীন কাপাসগোলা তৈল পট্টির মোড়ে আসতেই গাড়িতে থাকা ৩-৪ জন গলা থেকে স্বর্ণের চেইন ছিনিয়ে নিয়ে বীরদর্পে হেটে চলে যায়। রিতা দে বলেন, “গাড়িতে আরো যাত্রী ছিল, আমি সবাইকে বলছিলাম ওরা আমার স্বর্ণের চেইন কেড়ে নিচ্ছে.. কিন্তু কেউ সাহায্য তো দূরের কথা টু শব্দটিও করেনি”। এই ঘটনার পর রিতা দের ছেলে অজয় দে সকাল আনুমানিক ১০ টায় সংশ্লিষ্ট চকবাজার থানায় গিয়ে বিষয়টি জানান। যাদের কাজই হলো অপরাধ দমন, আইনের প্রয়োগ করা সেই পুলিশই উল্টো তাকে মামলা না করতে পরামর্শ দিয়ে বিদায় করে দেয়। অজয় দে বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, সেদিন ঘটনাস্থল এলাকায় ডিউটিতে ছিলেন থানার এস আই কামাল হোসেন। তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আমাকে বলেন, “এখানে তো কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা নেই তাছাড়া আশপাশের কেউই তো ঘটনা দেখে নাই। আমি মামলা করতে চাইলে এস আই কামাল আমাকে বলেন, মামলা করলে নানান ঝামেলা। আদালতে দৌড়াদৌড়ি করতে হবে অনেক সমস্যা। এরচেয়ে ভালো আপনি আমার মোবাইল নাম্বারটি রাখুন। আমি আমার সোর্স দিয়ে খোঁজ নিব, দেখি কাউকে পাই কিনা।” বাংলাদেশ বুলেটিন এই বিষয়ে চকবাজার থানার এস আই কামালের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো সদুত্তর না দিয়ে সংযোগ কেটে দেন।
এমন ছিনতাইয়ের ঘটনা চট্টগ্রাম নগরীতে এখন হরহামেশাই হচ্ছে। এসব অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলে বেশীর ভাগ ভূক্তভোগীর অভিযোগ লিপিবদ্ধ করতে অনীহা দেখাচ্ছে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ এলাকার থানাগুলো। বেশীর ভাগ সময় মোবাইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনায় অভিযোগ না নিয়ে হারিয়ে গেছে মর্মে জিডি রেকর্ড করা হচ্ছে। থানা এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভালো দেখাতেই থানা গুলোতে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি ও চাঁদাবাজির মামলা নিতে গড়িমসি করার অভিযোগ উঠেছে। আবার অনেক ভূক্তভোগী বাড়তি ঝামেলা ভেবে ছিনতাই, চুরির মতো অভিযোগ পুলিশকে জানাতে চাননা। আর বেশীর ভাগ চাঁদাবাজির বিষয় গোপনে ম্যানেজ করে ফেলা হচ্ছে। আশরাফ নামের বায়েজিদ এলাকার এক ব্যবসায়ীর ভাষ্য, ১০ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছিল একজন, আমি স্থানীয়দের সহায়তায় ৫ হাজার টাকা দিয়ে বিষয়টা রফাদফা করেছি। যদি থানায় যেতাম তাহলে আমার লাখ টাকার ক্ষতি তো হতোই এরপর এই এলাকায় ব্যবসা করাও সম্ভব হতো না। এসব কারণে সিএমপি’র অপরাধ পরিসংখ্যানে যে পরিমাণ অভিযোগ রেকর্ড হয় নগরীতে সংঘটিত অপরাধের প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়ে বহুগুন বেশী।
সম্প্রতি বাংলাদেশ বুলেটিনের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকের একটি জনপ্রিয় “ডেসপারেটলি সিকিং-চিটাগং” নামক একটি গ্রুপের মাধ্যমে চট্টগ্রাম মহানগরীতে সম্প্রতি কেউ ছিনতাইয়ের শিকার হয়েছেন কিনা? হয়ে থাকলে তারিখ সহ সংক্ষিপ্ত বিবরণ জানতে চাওয়া হয়। সেই পোস্টে ২০ ঘন্টারও কম সময়ে শতাধিক ভুক্তভোগী তাদের অভিজ্ঞতার কথা জানান। অনেকে জিডির কপি এমন কি সিসিটিভি ফুটেজ প্রদর্শন করেন। সেখানে পাওয়া তথ্য বলে দিচ্ছে চট্টগ্রাম নগরীতে ছিনতাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তথ্য বলছে নগরীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলো এখন ছিনতাইকারীদের অভয়ারণ্য। সবচেয়ে বেশী অভিযোগ নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন নিউ মার্কেট মোড় এলাকায়। বিষু চক্রবর্তী জানিয়েছেন, গত বছরের ২৮ নভেম্বর কোতোয়ালি থানার গেইটের বিপরীত পাশের সিডিএ ভবনের সামনে গাড়ি থেকে তিনি ছিনতায়ের শিকার হন। বিস্ময়কর ভাবে সেই ছিনতাইয়ের ঘটনায় জিডি করানো হয় (নং- ২২৭৪ তারিখ- ২৮-১১-২০২২ইং)। ছিনতাইয়ের ঘটনায় জিডি করা প্রসঙ্গে ভিকটিম বলেন, “উনারা (থানার পুলিশ) যে ভাবে বলছে ঐ ভাবে করছি। এখন কি করার।” ভুক্তভোগীদের দেয়া তথ্য মতে নগরীতে ছিনতাই প্রবন এলাকাগুলো হচ্ছে, ষোলশহর দুই নাম্বার গেইট, মুরাদপুর মোড়, বহদ্দার হাট মোড়, টাইগার পাশ, আগ্রাবাদ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এলাকা, চকবাজার, ইপিজেড, পতেঙ্গা, পোর্ট কানেক্টিং সড়ক, টোল রোড়, বায়েজিদ অক্সিজেন, নতুন কর্ণফুলী ব্রিজ এলাকা। মাজিদ নামের একজন জানান, “আগ্রাবাদ মোড়ে প্রতিদিন ১০/১৫ টা মোবাইল ছিনতাই হয়, ঐদিকে গেলে ভুলেও আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করি না। ওরা হচ্ছে ৬/৭ জনের একটা গ্রুপ, এদের ধরতে পারলে সাধারণ মানুষের শান্তি হত।” চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সাবেক সচিব, কবি এলেক্স আলিম জানিয়েছেন, “আমার ছেলে ঋতবান রূপনগর এর সামনে থেকে মোবাইল ছিনতাইয়ের শিকার হয়। ও মোবাইল দিতে না চাইলে ওকে কয়েকজনে মিলে ইসকনের ভিতর দিয়ে কিং অব চিটাগং পর্যন্ত নিয়ে যায়। ইসকনের সিসি ক্যামে সব দেখা গেছে। পুলিশ সেটা দেখে ছিনতাইকারীদের প্রধানকে ধরে আনলেও মোবাইলটি উদ্ধার করে দিতে পারেনি। আমাদেরকে কিছু উপদেশ দিয়েছিলো যাতে রাস্তাঘাটে আমরা মোবাইল নিয়ে সতর্কভাবে চলাফেরা করি। চমৎকার উপদেশ ছিলো সেটি!” মোঃ তানভির আহম্মেদ জানান, ২৯ মে সকাল ৭টাই আমার মোবাইল টি টাইগার পাস মোড় থেকে ছিনতাই হয়। মোবাইলের বক্স থাকা সত্ত্বেও খুলশি থানাকে অভিযোগ করার পরে ও কোন হাদিস দেই নি। আব্দুল খালেক জানিয়েছেন ২৮ মে চট্টগ্রাম মেডিকেলের সামনে থেকে তার দুটি মোবাইল, কানের দুল, চেইন, এন আই ডি কার্ড সহ ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে গেছে।
মাঝে মধ্যে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিভিন্ন থানার ওসি সহ বিভিন্ন অফিসারেরা হারানো মোবাইল সেট খুঁজে বের করে মোবাইল ফোনের মালিককে হস্তান্তরের ছবি শেয়ার করে থাকেন। অতি সম্প্রতি তেমনি একটি হারানো মোবাইল ফিরে পাওয়ার ব্যক্তি বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, সপ্তাহ খানেক আগে রাতে আমার মোবাইলটি চলন্ত বাসের জানালা দিয়ে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আমি থানায় গেলে উনারা মামলা না করে জিডি করান। কদিন আগে আমার মোবাইলে রাখা প্রযুক্তির সহায়তায় আমি জানতে পারি আমার মোবাইল সেটটি এই শহরেরই একটি স্থানে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিষয়টি জিডিতে উল্লেখ থাকা দায়িত্ব প্রাপ্ত অফিসারকে একাধিকবার জানালেও তিনি খোঁজ নিচ্ছেন বলে জানান। পরে এক আত্মীয়ের সহায়তায় পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানানোর দুইদিন পর আমার সেই মোবাইলটি উদ্ধার হয়। আমি থানায় গিয়ে আমার মোবাইল সেটটির ছিনতাইকারীর বিষয়ে জানতে চাইলে সেই অফিসার আমাকে বলেন, “ছিনতাইয়ের নামও মুখে নিয়েন না। তাহলে এই জন্মে আর ফোন ফিরে পাবেন না। কোর্টে উকিল নিয়ে যেতে হবে তার পর অনেক প্রক্রিয়ার পর সেটটি যে ফিরে পারেন সেটা কেউ গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবে না।” পরে হাসিমুখে আমার মোবাইল সেটটি তুলে দেয়ার ছবি তোলা হয়। একাধিক সূত্র বলছে এসব মোবাইল ছিনতাইকারীদের আটক করেই মোবাইল উদ্ধার করা হয়। কিন্তু মামলা না হওয়ায় উৎকোচ নিয়ে এসব ছিনতাইকারীদের আবার ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব ছিনতাইকারী চক্রের সাথে থানার কথিত সোর্সদের বোঝাপোড়া থাকে। বেশীর ভাগ সময় এসব সোর্সরাই ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে মোবাইল ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি মোটা অংকের টাকা আদায় করে থাকে। তবে যেসব ছিনতাইকারীদের উৎকোচ দেয়ার সামর্থ থাকেনা তাদেরকে পেন্ডিং মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়।
নগরীর রেয়াজুদ্দিন বাজারের মোবাইল ফোন বিক্রেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, আমরা দুবাই সহ মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা প্রবাসীদের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন ক্রয় বিক্রয় করে থাকি। হঠাৎ থানার পুলিশ চোরাই মোবাইলের খোঁজে আমাদের দোকানে অভিযান চালায়। কোনো প্রকার চোরাই মোবাইল না পেয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইলের কাগজপত্র দেখতে চেয়ে নানান ধরণের হয়রানি করেন। আরেক ব্যবসায়ী বলেন, কিছু লোভী দোকানদার বেশী লাভের আশায় চোরাই মোবাইল ক্রয়-বিক্রয়ের সাথে জড়িত। তবে তাদের সংখ্যা খুবই কম। দেখা যাবে শতের মধ্যে দুই একজন এমন দোকানীর জন্য আমরা নানামুখি হয়রানীর শিকার হচ্ছি ব্যবসায়ীরা জানান, এখন সেকেন্ড হ্যান্ড মোবাইল বিক্রি করতে এলে আমরা এনআইডি কপি জমা রাখি। তবে বর্তমানে চোরাই বিক্রেতারা চোরাই মোবাইলগুলোর আইএমইআই নাম্বার পরিবর্তন করে ফেলে। ফলে এসব সেট উদ্ধার অসম্ভব হয়ে যায়। এছাড়া যেসকল দামি মোবাইলের এসব নাম্বার পরিবর্তন সম্ভব হয়না সেগুলো খুলে ভিন্ন ভিন্ন পার্টস হিসেবে বিক্রি করা হচ্ছে।
থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হওয়ার পর অভিযোগ কিংবা জিডি নিয়ে কর্তব্যরত অফিসারেরা অনীহা প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে চকবাজার থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. মনজুর কাদের মজুমদার বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, এমন হওয়ার তো কথা না। আমি যেকোনো অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেই। ২৯ মে সকালে কাপাসগোলা তৈল পট্টিতে ছিনতাইয়ের বিষয় এবং এস আই কামালের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে ওসি চকবাজার বলেন, “হ্যা আজ (২৯ মে) সকাল ৮টা থেকে ওখানে এস আই কামাল ডিউটিতে ছিলো। সে কেন এমন কথা বলেছে আমি খোঁজ নিচ্ছি।” এসময় তিনি ভিকটিমকে থানায় পাঠানোর পরামর্শ দেন। বাংলাদেশ বুলেটিনের তৎপরতার পর সেই এস আই কামাল ছিনতাইয়ের শিকার রিতা দে’র ছেলে অজয় দে’কে একাধিকবার ফোন করে থানায় আসতে বলেন মামলা করার জন্য।
এসকল বিষয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশন).আ স ম মাহতাব উদ্দিনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন কোন থানা এলাকায় এসব বেশী হচ্ছে জানতে চান। প্রতিবেদক সম্প্রতি ঘটে যাওয়া একাধিক থানার উদাহারণ তাকে তুলে ধরেন। এরপর তিনি একটি জরুরী প্রেস ব্রিফিং আছে জানিয়ে পরে কথা বলবে জানান। তবে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনারের কাছ থেকে কোন কল পাওয়া যায়নি। পরে এসএমএস এর মাধ্যমে প্রশ্ন করা হলেও কোন জবাব মেলেনি। যেহেতু উর্ধ্বতন কর্মকর্তা কিছু জানাননি তাই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিএমপি’র এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, যে কোন অপরাধ সংঘঠিত হলে সেই সংক্রান্তে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে থানাকে নির্দেশনা দেয়া আছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংঘবদ্ধ ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে, ছিনতাইকৃত মালামাল উদ্ধারও হচ্ছে। প্রতিদিন এসব অপরাধি দমনে আমাদের থানা পুলিশ নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। হয়তো অনেক সময় ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরাই থানায় অভিযোগ করেন না। আর কেউ অভিযোগ নিয়ে গেলে সেই অভিযোগের ধরণ অনুযায়ী অবশ্যই ব্যবস্থা নিবে। যদি কেউ এক্ষেত্রে গাফিলতি করে এবং আমরা যদি তেমন সুস্পষ্ট অভিযোগ পাই তাহলে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে এসব ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের সহায়তা বেশী প্রয়োজন। অনেক সময় পুলিশ হাতেনাতে ছিনতাইকারীকে পাকড়াও করার পর দেখা যায় ভিকটিম নিজেই কোন মামলা করতে ইচ্ছুক নয়। সুতরাং পুলিশকে সহায়তা করাটাও জরুরী বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা।