গত ১৬ মে বান্দরবান জেলায় দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সশস্ত্র গোষ্ঠী কুকি-চিন-এর হামলায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুইজন সৈনিক নিহত এবং দুই কর্মকর্তা আহত হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ‘কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি’ (কেএনএ)-এর বিরুদ্ধে একটি অভিযানের সময় ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বিস্ফোরণ ও চারদিক থেকে অ্যামবুশ-এর শিকার হয় সেনাবাহিনীর দলটি। কুকি-চিনের হামলার এই ঘটনাটি ঘটেছে যখন মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই সম্প্রদায় এবং উপজাতীয় কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিগত সংঘাত চলমান। এ ঘটনার পর, কেএনএ’র একজন সদস্য এবং কেএনএ’র সাথে সংযোগ রাখার অভিযোগে একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে পরিচিত বিচ্ছিন্নতাবাদী দলটি বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলার অধিকাংশ এলাকা জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্র গঠনের জন্য রাজনৈতিক ও সামরিক তৎপরতা চালাচ্ছে। কুকি-চিন আর্মি (কেএনএ) মূলত সশস্ত্র উইং, যাদের মূল রাজনৈতিক ফ্রন্ট হলো কেএনএফ। ২০১৭ সাল থেকে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনে পরিণত হলেও কেএনএফ প্রাথমিকভাবে একটি স্বেচ্ছাসেবী উন্নয়ন সংস্থা হিসেবে শুরু হয়েছিল। ইতোমধ্যে তারা রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি, বিলাইছড়ি, রোয়াংছড়ি এবং বন্দরবানের উপকণ্ঠে চিম্বুক পাহাড়কে ঘিরে রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ ৯টি উপজেলা নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত ‘কুকি-চিন রাজ্য’ ঘোষণা করেছে। তারা প্রস্তাবিত রাষ্ট্রের একটি মানচিত্র ও একটি পতাকা প্রকাশ করেছে এবং তাদের প্রস্তাবিত রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের জন্য লড়াই করার ঘোষণা দিয়েছে।
রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই ৩টি জেলা নিয়ে গঠিত পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রত্যন্ত অঞ্চল বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সশস্ত্র সংগঠনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। কুকি-চিনের বিরুদ্ধে বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায় জামাআতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বিয়াহ নামে একটি ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। সশস্ত্র কার্যক্রম পরিচালনার ব্যয়ের একটি অংশ তারা এখান থেকে প্রাপ্ত অর্থের মাধ্যমে নির্বাহ করতো। পরবর্তীতে র্যাব জানায়, পার্বত্য অঞ্চলে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর কয়েকটি প্রশিক্ষণ শিবিরে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আত্মগোপনে থাকা কমপক্ষে ৩৮ জঙ্গি প্রশিক্ষণ পেয়েছে।
সীমান্তবর্তী দুর্গম অঞ্চলে এ ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠীর উপস্থিতি শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংগঠনটি একটি জটিল এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় অবস্থিত, যেখানে বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং মিজোরামের সীমান্ত রয়েছে। বাংলাদেশের সাথে মিজোরামের ৩১৮ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এছাড়াও মিজোরামের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী দল রয়েছে। কেএনএফ প্রতিবেশী দেশের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর সাথে সংযোগ স্থাপন করাসহ কিছু গ্রুপের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছে। তথ্যানুযায়ী, দেশের ভেতরে-বাইরে কমপক্ষে ৩ থেকে ৪ হাজার প্রশিক্ষিত কেএনএ সদস্য রয়েছে।
স্থানীয়ভাবে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত কেএনএফ কুকি-চিন গোষ্ঠীর অন্তর্গত বম, পাংখুয়া, লুসাই, খুমি, ম্রো এবং খিয়াং ৬টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত। কুকি-চিন-মিজো হল তিব্বতী-বার্মা ভাষা গোষ্ঠীর বিভিন্ন জাতিগত সম্প্রদায়ের একটি ভৌগলিক গুচ্ছ, যারা মিয়ানমারের চিন এবং ভারতের মিজোরামের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের সাথে ভারতের মিজোরাম, আসাম, মণিপুর এবং নাগাল্যান্ড রাজ্যের পাহাড়ি এলাকায়ও তারা বাস করে। জাতিগত মিলের কারণে, সীমান্তের ওপারের লোকদের প্রভাবিত করে সমর্থন পাওয়া একএনএফ-এর পক্ষে সহজ অত্যন্ত সহজ। ইতোমধ্যে তারা মিজোরামের জনতা ও সরকারের সুদৃষ্টি প্রাপ্ত হয়েছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, ১১ নভেম্বর সেনাবাহিনী পার্বত্য অঞ্চলে অভিযান শুরু করার পর থেকে কুকি-চিন উপজাতির ৫০০ জনেরও বেশি সদস্য সীমান্ত পেরিয়ে মিজোরামে আশ্রয় নিয়েছে।
সম্প্রতি ভারতের মণিপুর রাজ্যে চলমান সহিংসতার মধ্যে কুকি-চিন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা আরও বেড়েছে। সেখানকার কুকি জনগোষ্ঠী মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেইদের সাথে বিরোধের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ। এদিকে মিজোরামের মুখ্যমন্ত্রী জোরামথাঙ্গা কুকিদের পক্ষে একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যার তীব্র নিন্দা করেছেন মণিপুরের মেইতিরা। অর্থাৎ তাদের জাতিগত ঐক্য এবং চেতনা যে বেশ শক্তিশালী তা বোঝা যায়।
এছাড়াও স্বাধীনতার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন সক্রিয় রয়েছে। সংঘর্ষ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফলে পাহাড়ে ভয়ে মানুষ অনুপ্রবেশ করে। নিয়মিত হত্যা, অপহরণ ও চাঁদাবাজির পাশাপাশি পাহাড়ে অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের রাজত্ব গড়ে তুলেছে এসব দল। এতে ভারত ও মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে গাঁজা, ইয়াবা, হেরোইন এবং আইসসহ বিপজ্জনক মাদক চোরাচালানের অন্যতম প্রধান রুটে পরিণত হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল। এছাড়াও একএনএফ জঙ্গীগোষ্ঠীর প্রশিক্ষণ প্রদান করায় দেশের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িক জঙ্গিদের তৎপরতা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
তাই এ ধরনের আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীকে প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরাী বাহিনীর তৎপরতা জোরদার করা ও সীমান্তে নজরদারি বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো ও গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এ ধরনের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে দমনের একটি কার্যকর উপায় হতে পারে।
লেখক : গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক
-বাবু/এ.এস