বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫ ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
নেত্রকোনা সীমান্তে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে চোরাকারবারিরা
সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণে রাজস্ব
সোহেল খান দূর্জয়, নেত্রকোনা
প্রকাশ: শুক্রবার, ২ জুন, ২০২৩, ২:৫০ PM আপডেট: ০২.০৬.২০২৩ ২:৫৩ PM
বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত চোরাচালানের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে নেত্রকোনার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা উপজেলার সকল সীমান্তবর্তী এলাকা। কিছুদিন আগেও যেখানে মাথায় বস্তা নিয়ে রাতের আঁধারে লুকিয়ে-চাপিয়ে চোরাচালানের পণ্য বহন করত চোরাকারবারিরা, সেই তারাই এখন দিনে-দুপুরে ট্রাক, কাভার্ডভ্যানে করে সীমান্তে পণ্য আনা-নেওয়া করে। প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার মালামাল আসা-যাওয়া করে এই দুই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে। এতে করে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।

কলমাকান্দা আনন্দপুর রোডের রফিক স্মাগলার নামে এলাকায় পরিচিত। সে বহুবছর ধরে সীমান্তে চোরাচালান ব্যবসায় জড়িত। যখন যে মৌসমে যা কিছু বডার দিয়ে আমদানি হয় সবকিছুর সাথেই জড়িত সে। এই অবৈধ চোরাচালান করতে গিয়ে কয়েকবার জেলও কেটেছে সে। তার ব্যক্তি পরিচিতির রেকর্ড খুঁজাখুঁজি করে দেখলে অনেক কিছুই বেরিয়ে আসবে। এলাকায় এখন এক নামেই সবাই তাকে চিনে রফিক স্মাগলার নামে। লোকমুখে শুনা যায়, সে এখন ভয়ংকর মানুষ! তার ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলে না। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, এই স্মাগলার রফিক নাকি স্থানীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে উধ্বর্তন কর্তৃপক্ষ সকলের সাথে লাইন ক্লিয়ার করে এই স্মাগলিং ব্যবসা চালিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। তাকে কাট ব্যবসায়িক নামেও কিছু কিছু লোক এলাকায় চিনে। ভদ্র বেশে ছদ্ম আবরণে এই রফিক স্মাগলার কালাচক্রের গডফাদার।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রীতিমতো বানের পানির মতো এই দুই উপজেলার সীমান্ত দিয়ে আসছে ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন প্রকার মাদক; মদ ও বিয়ার; নিম্নমানের চা পাতা, গাড়ির টায়ার, গরম মসলাসহ বিভিন্ন ভারতীয় পণ্য। আসছে প্রচুর পরিমাণে ভারতীয় গরু ও চিনি। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে আমদানি করা চীনা রসুন, বুট, ছোলা, ডাল ও ইলিশ মাছ। সূত্রগুলো জানায়, এই দুই উপজেলার গরু বাজারগুলোর গড় ইজারার পরিমাণ যেখানে চার-পাঁচ লাখ টাকা, সেখানে ভারতীয় গরু আসার কারণে সীমান্ত একটি ইউনিয়নের এক বাজারের ইজারাই ২৫ লাখ টাকা। যেখানে ভারতীয় চা পাতা আসতে কেউ শোনেনি, সেখানে এখন প্রতি মাসেই অন্তত ১০ লাখ টাকার চা পাতা এই সীমান্ত দিয়ে অবৈধভাবে আসছে।

দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা সীমান্ত দিয়ে ব্যাপক হারে চোরাচালান বেড়ে যাওয়া নিয়ে এলাকায় চাপা ক্ষোভ রয়েছে মানুষের মধ্যে। কিন্তু চোরাচালানের সঙ্গে উল্লেখ যোগ্য অনেক জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতারাসহ প্রভাবশালীরা জড়িত থাকায় কেউ মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না।

সর্বশেষ গত বুধবার রাত ১০টায় কলমাকান্দা উপজেলার লেংগুরা সীমান্ত এলাকার কালাপানি গ্রাম থেকে চীন থেকে বাংলাদেশে আমদানি করা রসুনের একটি চালান ভারতে পাচার করে চোরাকারবারিরা।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এই দুই উপজেলার সীমান্তে চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন রবার্ট নেখরেক, মজিদ ও তাদের দলবল সীমান্তে চোরাচালান সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। ভারত থেকে আনার পর প্রতিটি গরুর বিপরীতে বিভিন্ন সংস্থাকে দেড় হাজার টাকা কমিশন দেওয়া হয়। এর ভাগ পান সরকারি দলের অনেক পাতি নেতাও। আর চা পাতার জন্য প্রতি বস্তায় দিতে হয় ৫০০ টাকা। প্রভাবশালী কেউ যথাযথ ভাগ না পেলে প্রায়ই বাকিবতণ্ডার ঘটনাও ঘটে।

এই দুই উপজেলা দিয়ে আমদানি-রপ্তানির সঙ্গে জড়িত এক ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্বাধীনতার পর এভাবে কোনো সময় দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা সীমান্তে চোরাচালানের ঘটনা ঘটেনি। একসময় ছিঁচকে চোরাকারবারিরা মাথায় করে সামান্য মালা আনা-নেওয়া করলেও এখন বড় বড় গাড়ি ব্যবহার করা হয় চোরাচালানে। প্রশাসন নজর দিলে এভাবে চোরাচালান সম্ভব হতো না।

তিনি আরও জানান, এই দুই উপজেলার বিভিন্ন বাজারে ভারত থেকে নিয়ে আসা গরু বিক্রি হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকাররা এসে এখান থেকে গরু নিয়ে যায়। এদিকে ভারত থেকে চোরাই পথে নিয়ে আসা নিম্নমানের চা পাতার জন্য হুমকিতে রয়েছে দেশের উৎপাদিত চা। আবার চীন থেকে আমদানি করা রসুন ভারতে চলে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে এই পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে দিনদিনই।

স্থানীয় এক জনপ্রতিনিধি নাম প্রকাশ না করে বলেছেন, দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা পর্যন্ত সীমান্ত অঞ্চল পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার কারণেই পাচারকাজ সহজ হয়ে যায়। এই দুই উপজেলার সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন রংছাতি,খারনৈ, লেংগুরা, কুল্লাগড়া  ইউনিয়নের কতিপয় ‘ওপর মহলের’ আশীর্বাদপুষ্ট নেতা এসব চোরাচালান সিন্ডিকেটের হোতা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দুই উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে জমা হয় ভারতীয় চা পাতা। এসব গ্রাম থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের ক্রেতারা চা পাতা কিনে নেয়। জানা গেছে, লেংগুরা সীমান্তের কালাপানি সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার কেজি চা পাতা দেশে প্রবেশ করে, যা পরে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলা, চট্টগ্রাম, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। চা পাতা চালানের জন্য নিরাপদ রুট হিসেবে এই সড়ক গুলো ব্যবহার করা হয়।

এ ব্যাপারে স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, ‘ভারত থেকে চোরাই পথে যে চা পাতা আসে, তা নিম্নমানের। এসব পাতা আমাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় কম দামে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে আমাদের দেশীয় চা পাতার দাম পড়ে যাচ্ছে। কুল্লাগড়া ইউনিয়নের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি বলেন, ‘এখান দিয়ে সব সময়ই চোরাচালান হয়ে আসছে। প্রশাসনের সঙ্গে আমরাও চেষ্টা করি অবৈধ মালামাল আটকাতে। কিন্তু দুর্গম পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় চোরাকারবারিদের দমানো যাচ্ছে না।

এ ব্যাপারে কথা বলতে নেত্রকোনা ৩১ বিজিবির অধিনায়ক লে কর্নেল আরিফুর রহমানের সাথে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কারণ তিনি এই প্রতিনিধির ফোন রিসিভ করেননি।

বাবু/জেএম 
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত