দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি কম হয়নি এটি অসত্য নয়। কিন্তু এর পাশাপাশি সত্য হচ্ছে, উন্নতির সঙ্গে বাড়ছে বৈষম্যও। আর বৈষম্য থেকে সৃষ্টি হচ্ছে নানারকম সমস্যা। সংবাদপত্রে নানা ধরনের সংঘর্ষের খবর পড়ি। বলা হয় দেশে এখন রাজনীতি নেই। সেটা এই অর্থে যে, দেশে এখন কার্যকর কোনো বিরোধী দল নেই না জাতীয় সংসদে না রাজপথে, অথবা জনপদে। কিন্তু তাই বলে শাসকদলের ভেতর দ্বন্দ্ব থাকবে না এ কেমন কথা? বিরোধ অন্যত্রও ঘটছে। সব খবর পাই না, যা পাই তা কখনও কখনও হাস্যকর এবং করুণও শোনায়।
নিকট অতীতে ঢাকা শহরেই চাঁদার ভাগ না দেওয়ায় খুন হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতা। তিনি ছিলেন ঢাকার বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। সংবাদমাধ্যমে জেনেছিলাম ওই নেতার নাম ফরহাদ এবং তার হত্যাকাণ্ডে নাকি নয়জন জড়িত ছিল। ফরহাদ এলাকা থেকে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন। চাঁদা তুলে ওই নয়জন এবং তাদের প্রবাসী নেতাকে চাঁদার একটা ভাগ দিতেন এমন কথাও শোনা গেছে। কিন্তু এক সময়ে ভাগ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারই নগদ প্রতিফল তার এ প্রাণদান। এদের রাজনৈতিক কাজটা কী ধরনের বুঝতে কোনো অসুবিধা নেই। ভাগাভাগির ঝগড়াটা আসলে ক্ষমতারই দ্বন্দ্ব এবং ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব সর্বত্রই প্রধান হয়ে উঠেছে। কেননা এর বাইরে অন্য আদর্শিক বন্ধনের ভীষণ আকাল পড়েছে।
ক্ষমতার দ্বন্দ্ব থাকে, ক্ষমতার প্রয়োগও ঘটে। ফুটবলজগতে অমর খেলোয়াড় ম্যারাডোনা। জাদুকর বলা হয় তাকে। আসলেই সে রকমই ছিল তার দক্ষতা ও প্রতিভা। কিন্তু তার বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছিল ক্ষমতা অপপ্রয়োগের। ম্যারাডোনার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার বিপুল প্রশংসার পাশাপাশি কিউবার এক নারীর অভিযোগও প্রকাশ পেয়েছিল। এই নারী বলেছিলেন, বিশ বছর আগে বয়স যখন তার ১৭, তখন ম্যারাডোনা তাকে ধর্ষণ করেছেন। মেয়েটি ম্যারাডোনার অসম্ভব রকমের ভক্ত ছিলেন, তার কাছাকাছি থাকতে চাইতেন। এই রকম কৈশোরিক মোহগ্রস্ততার কালে একদিন হোটেলের এক কক্ষে ম্যারাডোনা তার মুখ চেপে ধরে তাকে ধর্ষণ করেন। অভিযোগের সত্য-মিথ্যা আমরা জানি না। তবে একজন পরলোকগত মানুষের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ যে তিনি এনেছেন, সেটা হয়তো ব্যক্তিগত কোনো মুনাফার আশায় নয়Ñ হতে পারে গভীর দুঃখ থেকেই। তবে ক্ষমতাবানদের পক্ষে ক্ষমতা প্রয়োগে উদ্দীপ্ত হওয়া তো অসম্ভব কোনো কাজ নয়, বিশেষ করে যদি ভয় না থাকে ধরা পড়বার, দায় না থাকে জবাবদিহিতার!
অতীতে খেলাধুলায় যে বর্ণবাদ ছিল না, তা নয়। খুবই ছিল। খেলার মাঠে দর্শকরা ভিন্ন বর্ণের খেলোয়াড়দের দুয়ো দিত। তারা ক্ষমতাবান, তাই ক্ষমতা প্রদর্শনের অধিকার তাদের রয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে মাঠে নয় শুধু, দলের ভেতরেও চলছে বর্ণবিদ্বেষ। দুই যুগ ধরে ইংল্যান্ডের ক্রিকেট দলে ক্যাপ্টেনের দায়িত্ব পালন করেছেন নাসের হোসেন; তিনি ভারতীয় বংশোদ্ভূত। দলের ভেতর তিনি বর্ণবিদ্বেষের শিকার হয়েছেন এমন অভিযোগ করেননি। কিন্তু এখনকার খেলোয়াড়রা করছেন। বাধ্য হচ্ছেন করতে। ইয়র্কশায়ার ক্রিকেট ক্লাবের উপমহাদেশীয় খেলোয়াড়রা বলছেন ক্লাবের শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়রা তাদেরকে ‘পাকি’ বলে ঠাট্টা-মস্করা করে। ‘পাকি’ বলতে কেবল যে পাকিস্তানিদের বোঝায় তা নয়, সব উপমহাদেশীয়দেরই সম্বোধনের ওই সম্মাননার ভাগীদার করার রেওয়াজ লন্ডনের পথেঘাটে হামেশাই ঘটে থাকে। এখন সেটা ক্রিকেট ক্লাবের ভেতর ঢুকে পড়েছে। শুধু ইংল্যান্ডই বা কেন, এমনকি ভারতের দুজন সাবেক খেলোয়াড়ও নিকট অতীতে ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন যে, গাত্রবর্ণ কালো বলে তারা নিজেদের অর্থাৎ ভারতীয়দের দলের ভেতরেই অপমানিত বোধ করেছেন। মোট কথাটা দাঁড়াচ্ছে এই উন্নতি ঘটছে বিপুল পরিমাণে, কিন্তু বৈষম্যও বাড়ছে। ক্ষমতাবানরা আরও ক্ষমতাবান হচ্ছেন, ক্ষমতাবঞ্চিতদেরকে বর্ধিত পরিমাণে বঞ্চিত করে। কোনো এক জায়গাতে নয়, সর্বত্র।
যেমন বাংলাদেশে হাতি নিধনের ঘটনা ঘটেছে। খুব দূরের বিষয় নয়। সেটাও উন্নতির কারণেই ঘটেছে। বনভূমি যারা জবরদখল করেছে, তারা নিজেদের চাষাবাদের সুবিধার জন্য হাতির চলাচল থামানো দরকার ভেবে বিদ্যুতের তার বসিয়েছে এবং তাতে স্পৃষ্ট হয়ে হাতি মারা গেছে। আবার পেশাদার লোকও লাগানো হচ্ছে হাতি মারবার জন্য এমন অভিযোগও উঠেছিল। পাশাপশি এমন আশঙ্কা নাকি দেখা দিয়েছে যে, উন্নতির মাশুল গুনতে গিয়ে বাংলাদেশকে হয়তো হস্তীশূন্যই হতে হবে এক সময়ে। ধরা যাক, এলিভেটেড এক্সপ্রেস হাইওয়ে নির্মাণের ব্যাপারটা। উন্নতির জন্য এই উন্নত চলাচল ব্যবস্থা খুবই দরকার। কিন্তু এর মাশুল তো দিতে হচ্ছে ওই নির্মাণযজ্ঞের নিচে চলাচলকারী নিরীহ মানুষদেরকেই। ঢাকা মহানগরে এমন কাজ বেশ সাড়ম্বরে চলেছে, কিন্তু নিচে যে অবস্থা ক্রমেই হয়ে উঠছে ঝুঁকিপূর্ণ, সেদিকে নজর দেবার অবসর নেই নির্মাণকর্তাদের। সম্প্রতি ঢাকার মহাখালীর রেললাইন অতিক্রমকালে এক কিশোরের মাথায় রডবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনাটি এরই নজির। অতীতে এমন ঘটনা ঢাকা ও চট্টগ্রামে আরও ঘটেছে অর্থাৎ অপঘাতে মানুষ মারা গেছে। প্রতিকারহীনতার কারণে পরবর্তীতে আরও মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এর দায় কার। নিশ্চয়ই জবাবটা কঠিন কিছু নয়।
শুনেছিলাম গাইবান্ধা উপজেলার গোবিন্দগঞ্জে এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোন প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ভালো কথা। কিন্তু তাতে যে দেড় হাজার সাঁওতাল পরিবার বাস্তুহারা হবে, তাদের দেখবে কে? তারা যাবে কোথায়? খাবে কী? তা হলে? ভরসা কোথায়? ভরসা দেখা যাচ্ছে তরুণরাই। কিন্তু তরুণরা তো ভালো নেই। এ বছর বাংলাদেশের যে তরুণদের এসএসসি পরীক্ষা দেবার কথা ছিল তাদের ভেতর একটা উল্লেখযোগ্য অংশ পরীক্ষা দিতে আসেনি। ঝরে আগেও পড়ত। ধারণা করা হচ্ছে এদের অধিকাংশই মেয়ে। এই মেয়েদের অনেকেরই হয়তো বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে, কারও কারও ক্ষেত্রে হয়তো অভিভাবকদের সামর্থ্য নেই পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাবার। ছেলেরাও অনেকেই আসেনি। তাদের অভিভাবকরাও হয়তো সঙ্গতিহীন হয়ে পড়েছেন। ছেলেদের কেউ কেউ হয়তো সামান্য হলেও উপার্জনের কাজে যুক্ত হয়ে গেছে।
তবুও তরুণরাই পারবে। আর পারবেন সেই বয়স্করাও, যাদের ভেতর তারুণ্য রয়েছে। আছে উৎসাহ-উদ্দীপনা, সৃষ্টিশীলতা এবং প্রতিবাদের সাহস। এগুলো সবই তারুণ্যের গুণ। কিছুদিন আগের ঘটনা। দিনাজপুরের যে স্কুলছাত্রীটি বাবা-মা তাকে জোর করে বিয়ে দিচ্ছেন দেখে দৌড়ে থানায় চলে গেল এবং আশ্রয় চেয়েছিল, তার সেই সাহসটা তারুণ্যেরই। জলবায়ু সম্মেলনে তরুণদের বিক্ষোভের ঘটনা তারুণ্যেরই প্রকাশ। তারুণ্য সেখানে সমবেত হয়েছে, সমষ্টিবদ্ধ হয়েছে। ঢাকায় নিরাপদ সড়কের দাবি তরুণরাই করছে। ব্যক্তির সাহসের মূল্য আছে। কিন্তু সেই সাহস অনেক অনেক শক্তিশালী হয় যদি অনেকে থাকে এক সঙ্গে। তখন তা দুর্দমনীয় হয়ে ওঠে। যেকোনো প্রতিবাদ-প্রতিরোধে জরুরি হলো সমর্থন। জনসমর্থনটাই আসলে বড় ব্যাপার এখানে। সমর্থন আছে। সারা বিশ্বই এখন পুঁজিবাদী ফ্যাসিবাদের দৌরাত্ম্যে অস্থির অবস্থায় রয়েছে এবং প্রত্যেক দেশেই মানুষ এর বিরুদ্ধে একভাবে না একভাবে লড়ছে। আন্দোলনকারীদের ভেতর আকাঙ্ক্ষা আছে ঐক্যবদ্ধ হবার। কিন্তু পুঁজিবাদীরা পারতপক্ষে এখন তাদেরকে এক হতে দেবে না।
নোবেল শান্তি পুরস্কার যে প্রতিবছরই যথাপাত্রে অর্পিত হয় এমন নয়। অতীতে দেখা গেছে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী দুজনকে নিয়ে কথা উঠেছিল। তারা পেশায় সাংবাদিক, ফিলিপিনের মারিয়া রিসা এবং রাশিয়ার দিমিত্রি মুরতেভ। তারা অনুসন্ধানী সাংবাদিক এবং সে জন্য নিজের দেশে সরকারি সহযোগিতা পাননি। তাদেরকে কাজ করতে হয়েছে বিপদ-আপদের মধ্যে। তাদের কাজের এই যে স্বীকৃতি সেটাও সমর্থনই; বড় আকারে ও আন্তর্জাতিক মাত্রায় সমর্থন। এই সমর্থন আন্তর্জাতিক এবং বিশ্বায়ন-বিরোধী। বিশ্বায়ন চলে মুনাফার তাড়ায়, আর আন্তর্জাতিকতা গড়ে ওঠে সংবেদনশীলতার অনুপ্রেরণায়। তারুণ্যের পাশাপাশি এই আন্তর্জাতিকতাও বিশ্বের জন্য এখন ভরসা।
তারুণ্যে বিদ্রোহ করবে, এটা প্রত্যাশিত। কিন্তু কার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, সেটাও কিন্তু নিরূপণ অত্যাবশ্যকীয়। নানা রকমের অন্যায় চলছে, কিন্তু সকল অন্যায়ের উৎস এখন দাঁড়িয়েছে পুঁজিবাদী উন্নয়ন। কিন্তু এই উন্নয়ন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই মানুষের জন্য প্রতিকূল হয়ে উঠেছে। শুধু মানুষ নয়, প্রকৃতি ও প্রাণিজগতেরও সর্বনাশ ঘটাচ্ছে, তার এই বৈরী চরিত্রটিকে সুস্পষ্টরূপে চিহ্নিত করা আবশ্যক। টেকসই উন্নয়নের কিছু জরুরি শর্ত আছে। নীতিনির্ধারকদের এসব অজানা নয়। কিন্তু তারপরও তাদের উদাসীনতা লক্ষ্য করা যায়, প্রায় প্রত্যেক দেশে এবং সারা বিশ্বে। এর নিরসন জরুরি জাতীয় স্বার্থেরই প্রয়োজনে। উন্নতির পাশাপাশি বৈষম্যের ছায়া যেভাবে বিস্তৃত হচ্ছে তা উদ্বেগের কারণ বটে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
-বাবু/এ.এস