শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫ ২৮ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ১২ জুলাই ২০২৫
ইসলামি-পরিষদ-লীগ নেতা মামুন!
কামরুজ্জামান রনি, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: শনিবার, ১০ জুন, ২০২৩, ১১:০৯ PM আপডেট: ১১.০৬.২০২৩ ১২:৫৪ AM
আব্দুল্লাহ আল মামুন৷ একাধারে ভূঁইফোঁড় সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ চট্টগ্রাম নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি সংসদ, বঙ্গবন্ধু শিশু-কিশোর মেলা, পাঁচলাইশ সাবেক ছাত্রলীগ পরিষদ, পাঁচলাইশ সর্দার পরিষদ, দুবাই বঙ্গবন্ধু পরিষদ, শারজাহ প্রবাসী ব্যবসায়ীসহ দেশ বিদেশের কয়েক ডজন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের বড় বড় পদধারী এই নেতা এখন নিজেকে ৩নং পাঁচলাইশ ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে পরিচয় দেয়। অথচ এই মামুন দেশের অন্যতম শীর্ষ সন্ত্রাসী, শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ খাঁনের ঘনিষ্ঠ সহচর ও শিবিরের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল৷ এক সময়ের শিবির নেতা মামুন সময়ের পথ পরিবর্তনে কয়েক ডজন সংগঠনের ব্যানার টাঙিয়ে এখন আওয়ামী লীগ নেতার রূপ ধারণ করেছে বলে অভিযোগ উঠছে।

দেশজুড়ে আলোচিত চট্টগ্রামের এইট মার্ডারের অন্যতম হোতা শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ সর্বশেষ ২০০১ সালে অত্যাধুনিক একে ৫৬ রাইফেলসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়। পরে জামিনে বেরিয়ে দেশ ত্যাগ করেন৷ এরপর প্রথমে দুবাইতে বসে চট্টগ্রামের অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি মুঠোফোনে ব্যাপক চাঁদাবাজি চালিয়ে যায়৷ অভিযোগ আছে কথিত লীগ নেতা পরিচয় দেয়া আবদুল্লাহ আল মামুন শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের বিশ্বস্ত লোক হিসেবে দেশে তার অপরাধ কর্মকাণ্ড দেখাশোনা করছে। শুধু তাই নয় ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা সাজ্জাদ খান যখন ভারতের পাঞ্জাবের এক মেয়েকে বিয়ে করে তখন বাংলাদেশ থেকে অতিথি হিসেবে আবদুল্লাহ আল মামুন সেই বিয়েতে যোগ দিয়েছিল৷ ভারতের নিজস্ব রীতিতে আয়োজিত সেই বিয়েতে মাথায় লাল পাগড়ি বেঁধে আজকের আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয় দেয়া মামুনকে নেচে গেয়ে উল্লাস প্রকার করতে দেখাগেছে৷ এই সংক্রান্ত একাধিক ছবি দীর্ষদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে আছে৷ সেই সাথে বায়েজিদ ও পাঁচলাইশ এলাকায় সাজ্জাদের ব্যাপক চাঁদাবাজি ও হামলার ঘটনার পর প্রতিবারই মামুনের নাম উঠে আসে।

এতো কিছুর পরো বিপুল অর্থবিত্তের দাপটে আবদুল্লাহ আল মামুন বরাবরই থেকেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে৷ নিজেকে আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে একাধিক ভূঁইফোঁড় সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে চালিয়েছে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা৷ মাঝে দেশজুড়ে সমালোচিত জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদ নামক ভূঁইফোঁড় সংগঠনকে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্যাপক অর্থ বিনিয়োগ করে মামুন। সে সময় বেশ আয়োজন করে একাধিক বড় বড় আওয়ামী লীগ নেতাদের উপস্থিতিতে ভূঁইফোঁড় সংগঠন জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের সম্মেলন আয়োজন করে মামুন৷ সেই সম্মেলনে তাকে ভূঁইফোঁড় সংগঠনটির চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়৷ এরপর মামুন নগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডে একের পর এক কমিটি ঘোষণা করা শুরু করে৷ মূলত প্রধানমন্ত্রীর নামে সংগঠনের আড়ালে মামুন অন্যকোনো লক্ষ্যে কাজ চালাচ্ছিলো মর্মে অভিযোগ উঠেছিল।
চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার আবদুল্লাহ আল মামুন

চট্টগ্রাম নগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার আবদুল্লাহ আল মামুন


তবে বিভিন্ন প্রতারণার অভিযোগে ভূঁইফোঁড় সংগঠন জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের কথিত প্রতিষ্ঠাতা মনির খাঁন প্রকাশ দর্জি মনিরকে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করলে রাতারাতি গা ঢাকা দেয় আব্দুল্লাহ আল মামুন৷ পরে বেশ কিছু নগর আওয়ামী লীগ নেতাদের ম্যানেজ করে আবারও মুজিব কোট গায়ে আওয়ামী লীগ নেতা পরিচয়ে মাঠে নামে মামুন।

প্রচণ্ড চতুর ও ধূর্ত প্রকৃতির মামুন বর্তমান সরকারের আমলে নিজেকে প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতে এমন কোন কাজ নেই যা করেনি৷ নিজেকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের ব্যানারে আ জ ম নাছিরের ছবির পাশাপাশি মামুন তার ছবি জুড়ে দিয়ে মিটিং মিছিল করতো। সাজ্জাদের অবৈধ চাঁদার ভাগের টাকায় মামুন নিজে বিশিষ্ট দানবীর হিসেবেও প্রচার চালায়৷ স্থাবীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কাড়ি কাড়ি টাকা বিলি করে মামুন তার নামের পাশে "ডোনার" উপাধি বসিয়ে দিতে বেশ পছন্দ করে৷ বিপুল অর্থে নির্মিত মানুনের বিলাস বহুল বাড়ির ড্রইং রুমটি বিভিন্ন জনপ্রতিনিধি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের পদচারণায় মুখরিত থাকতো৷ ফলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী মামুনকে বেশ সমীহ করেই চলতো৷ কুখ্যাত শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগীর তকমা গায়ে থাকা মামুন এখন পাঁচলাইশ কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সহ-সভাপতির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বে আইনি অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল।

তবে এতো রং বদল করে শিবির থেকে আওয়ামী লীগ বনে যাওয়া আবদুল্লাহ আল মামুনের শেষ রক্ষা অবশেষ হয়নি৷ গত ৭ জুন নগরীর অক্সিজেন এলাকা থেকে নগর গোয়েন্দা পুলিশ মামুনকে গ্রেফতার করে। মামুনের বিরুদ্ধে সাবেক কাউন্সিলর ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি কফিলউদ্দিন খাঁন সহ একাধিক জনকে হত্যার হুমকি ও চাঁদাদাবীর অভিযোগে মামলা রয়েছে৷ একই মামলায় অন্যান্য আসামীরা সবাই শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের গ্যাং মেম্বার বলে জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

এই বিষয়ে সাবেক কাউন্সিলর কফিল উদ্দিন খান বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, মামুন একজন চিহ্নিত শিবির ক্যাডার৷ আমাদের ওয়ার্ড তো দূরের কথা চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের কোন অঙ্গ কিংবা সহযোগী সংগঠনে কোথাও সে সদস্য ছিল বা আছে তেমন কোন নজির নেই৷ বরং সে নিজেকে নেতা সাজাতে মানমীয় প্রধানমন্ত্রীর নামে ভুয়া সংগঠন গড়তে বিপুল অর্থ খরচ করেছিলো৷ মামুনের নেতা হলো দর্জি মনির৷ মামুন নিজেকে বিভিন্ন সময় পাঁচলাইশ ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সভাপতি পরিচয় দেয়া প্রসঙ্গে একসময়ের তুখোড় ছাত্রলীগ নেতা কফিল উদ্দিন বলেন, ঐ সময় সভাপতির দ্বায়িত্বে ছিল রহিম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিল রিদোয়ান৷ মামুনের সাথে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাজ্জাদ আমাদের আওয়ামী লীগ নেতা, তৎকালীন ওয়ার্ড কমিশনার লিয়াকত ভাইকে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে হত্যা করে৷ সাজ্জাদ বাংলাদেশের ইতিহাসে একত্রে ৮ জন মানুষকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যার অন্যতম খলনায়ক৷ সেই সাজ্জাদের সাথে মামুনের দৈনন্দিন যোগাযোগ এবং সাজ্জাদের এদেশীয় এজেন্ট হিসেবে মামুনের নানা অপকর্ম আড়াল করতেই সে আওয়ামী লীগের নাম ধারণের কৌশল অবলম্বন করেছিলো৷ তবে সত্য কখনোই চাপা থাকে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রে জানা গেছে সাজ্জাদ খান নিজের নাম পরিবর্তন করে মো. আব্দুল্লা নাম ব্যবহার করছে৷ ইন্টারপোল ইতিমধ্যে সাজ্জাদকে গ্রেফতারে রেড অ্যালার্ট জারি করেছে৷ এই মিথ্যা পরিচয়ে সাজ্জাদ ভারতে গিয়ে ভারতের পাঞ্জাবের এক মেয়েকে বিয়ে করে৷ সেই বিয়েতে সাজ্জাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে এই মামুন সশরীরে উপস্থিত ছিলেন৷ সাজ্জাদের সাথে যোগাযোগ ও ভারতে যাতায়াতের জন্য মামুন মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আরো একটি পাসপোর্ট বানিয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার অনুসন্ধানে উঠে এসেছে৷ সেই পাসপোর্টে আবদুল্লাহ আল মামুন তার নাম উল্লেখ করেছে মো. আব্দুল্লা৷ তার বাবার নাম মো. ইউনুস হলেও সেই পাসপোর্টে মামুন তার বাবার নাম পালটে রেখেছে মো. আলী। পাঁচলাইশ বকসু নগরের বাসিন্দা মামুন সেই পাসপোর্টে নিজেকে হাটহাজারী উপজেলার মাদার্শার বাসিন্দা পরিচয় দিয়েছে।

গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের পুলিশ ২০১২ সালের ৭ নভেম্বর অমৃতসর থেকে সাজ্জাদ ভারতীয় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। কিন্তু সাজ্জাদের ভারতীয় নাগরিক স্ত্রীর আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশের হাতে তুলে না দিয়ে কয়েক বছর পর জামিনে মুক্তি দেয়া হয়। ছেলের গ্রেফতারের খবরে উদ্বিগ্ন সাজ্জাদের মা ২০১৫ সালে ভারতের পাঞ্জাবে ছেলের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল৷ সেসময় সাজ্জাদের মায়ের সফর সঙ্গী ছিল মামুন৷ বর্তমানে সাজ্জাদ ভারতেই ব্যবসায়ী পরিচয়ে বসবাস করছে।

বাবু/জেএম 
« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত