এই মুহূর্তে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আক্ষরিক অর্থেই নানা ষড়যন্ত্র দেশে-বিদেশে চলছে। স্পষ্ট হচ্ছে কে বাংলাদেশের জনগণের বন্ধু, কে স্বাধীনতাবিরোধীদের বন্ধু? ২০১৯ সালে সুইডেন থেকে নেত্র নিউজ নামে একটি গণমাধ্যম অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধী, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির পক্ষে প্রচার চালায়। তারা আল জাজিরাসহ বিশ্বের আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে নানা বিতর্কিত প্রতিবেদন, সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে ‘খ্যাতি’ অর্জন করে। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে যুক্ত আছে ডেভিড বার্গম্যানের নাম। সম্প্রতি নেত্র নিউজ থেকে পদত্যাগ করার কারণ বিশদ বিবরণসহ নিজের সাফাই গেয়ে একটি প্রতিবেদন গণমাধ্যমে তিনি দিয়েছেন। নেত্র নিউজ থেকে বিদায় নেওয়ার প্রতিবেদনে তিনি লিখেছেন, ‘আওয়ামী লীগের জন্য বাকস্বাধীনতা অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কোনোরকম সমালোচনা সহ্য করার মতো মানসিকতা দলটির নেই। বরং ক্ষমতা যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, বাকস্বাধীনতার ওপর তত বেশি খড়গহস্ত হয়ে উঠছে এই সরকার। এ কথা সত্য, স্বাধীনতার পর থেকে সব সরকারই স্বাধীন সাংবাদিক ও সাংবাদিকতার পথ রুদ্ধ করার চেষ্টা করেছে। কখনও কম, কখনও বেশি। কিন্তু এখন আওয়ামী লীগের অধীনে যে পরিস্থিতি, তাকে ঘোরতর খারাপ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বর্ণনা করার উপায় নেই। এ দেশে যারা নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করে, তাদের ভয়াবহ মূল্য দিতে হয়। বহু সাংবাদিকই বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হুমকির শিকার হয়েছেন, গ্রেপ্তার হয়েছেন।’
ডেভিড বার্গম্যান যা লিখেছেন তা যারা বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই জানেন না, তাদের কাছে নানা বিস্ময় সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বর্তমান অনলাইনের জগতে কেউ নাড়াচাড়া করলেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশে কখন কতটি টিভি চ্যানেল কোন সরকারের আমলে অনুমোদন পেয়েছে। কতটি পত্রিকা বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় এই দেশে কোন সরকারের আমলে অনুমোদন নিয়ে মিডিয়াজগৎ সৃষ্টি করেছে। আবার কোন শাসনামলে কতজন সাংবাদিককে হত্যা করা হয়েছে, তারও একটি স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার কথা। তবে বিদেশিদের এ নিয়ে কতটা আগ্রহ আছে তা আমাদের জানা কঠিন। কিন্তু বার্গম্যান বাংলাদেশকে বিদেশে যেভাবে উপস্থাপন করার মিশন নিয়ে কাজ করেছেন সেটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তো বটেই, বিদ্বেষিত বললেও কম বলা হবে। তিনি বাংলাদেশের নাগরিক নন, বিয়ে করেছেন এ দেশেরই এক সময়ের প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ যিনি এখন বয়স এবং নানা কারণেই মানুষের কাছে অনালোচিত, তার মেয়েকে। মুক্তিযুদ্ধে যারা গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নিয়ে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতা করেছিলÑ সে রকম একটি ধর্মান্ধ, উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিয়ে নানা বিভ্রান্তিকর লেখালেখি বার্গম্যান দেশে-বিদেশে করেছেন। তার কি ব্যক্তিগত স্বার্থ ছিল বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করে বিদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়াকে বিতর্কিত করার জন্য লেখালেখি এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার? বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৫ সালে বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধের সরকারি পরিসংখ্যানের বিরোধিতা করার জন্য তাকে আদালত অবমাননার দায়ে দোষী সাব্যস্ত করেছিলেন। বাংলাদেশের আদালত যে ব্যক্তিকে তার মিথ্যা তথ্যদানের জন্য দোষী সাব্যস্ত করেছেন তিনি কীভাবে নিজেকে গণতন্ত্র, মুক্তমনা, স্বাধীন সাংবাদিকতার মানুষ হিসেবে দাবি করতে পারেন? বাংলাদেশের নাগরিক না হয়েও যার এমন ভূমিকা, তিনি পশ্চিমের উদার গণতন্ত্রের কোনো শিক্ষাই যে নেননি তার কর্মকাণ্ডেই এর সাক্ষ্যবহ।
তিনি কাদের স্বার্থরক্ষায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন, সেটি বুঝতে খুব বেশি জানা ও বোঝার দরকার হয় না। তিনি তার দেশের বিষয়াদি নিয়ে যা করার তা করতে পারেন, কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র নিয়ে আমাদের কি ক্রমাগত সবক দিতে পারেন? তার প্রতিষ্ঠিত নেত্র নিউজ যাদেরই অর্থে পরিচালিত হোক না কেন সেটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার, মুক্তচিন্তা, মুক্ত গণমাধ্যমের পক্ষে দাবি করার কোনো যুক্তি বা ভিত্তিও আমরা দেখতে পাইনি। তিনি বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি, জনমানসের সমস্যা ও সম্ভাবনার বিষয়গুলো কতটা জানেন এবং বোঝেন, তা যেকোনো সচেতন মানুষের কাছেই বিরাট প্রশ্ন। ডেভিড বার্গম্যানের এমন দুরভিসন্ধি বুঝতে খুব বেশি বাকি থাকে না। তিনি অন্য কোনো দেশে সাংবাদিকতার নামে এই কর্মকাণ্ডগুলো করলে তার অবস্থান লাল দালান না অন্য কোথাও হতো, তাও টের পেতেন। কিন্তু বাংলাদেশে এসে তিনি যা করেছেন, তাতেও তিনি আজ সন্তুষ্ট নন। গণহত্যাকারীদের পক্ষাবলম্বন করে, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদকে তার অবজ্ঞা যে কত বড় অপরাধ তা বোঝার মতো মানবিক জ্ঞান তিনি চর্চা করেন বলে আমরা মনে করি না। বাংলাদেশে ’৭৫-এর পর থেকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা হয়েছে, পত্রপত্রিকায় সঠিক তথ্যটিও লেখা যখন যেত না, তখন আমরা তো অনেকেই পত্রিকার পাঠক ছিলাম, বার্গম্যানের বয়স তখন ১০-১৫ বছরও ছাড়ায়নি। বাংলা তো তার মাতৃভাষা নয়। তেমন হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে তখন জেলে পুরে রাখা হয়েছে যারা দেশের জন্য আদর্শের রাজনীতি করেছেন। আর ’৭১-এর ঘাতকরা তখন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আশীর্বাদে গর্ত থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশে ‘ইসলামী বিপ্লব’ সংগঠিত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তখন নিরপরাধ ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। অনেক মা-বাবা তাদের সন্তান হারিয়েছেন। বার্গম্যান সেই ইতিহাস চেপে গেছেন।
দ্বিতীয় সামরিক শাসনামলেও স্বাধীন গণমাধ্যম নির্বাসিত ছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক শক্তি, বিএনপি-জামায়াত নির্বিচারে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করেছে, হিন্দু সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেছে, নারীদের ধর্ষণ করেছে। এসবই তো তখনকার পত্রপত্রিকায় প্রতিদিনের খবর ছিল। সেই সময় বাংলাদেশের প্রথম টেরিস্টোরিয়াল বেসরকারি চ্যানেল ইটিভি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যারা ইটিভি বন্ধ করেছেন তিনি তো তাদেরই পক্ষাবলম্বন করেছেন। এখন বাংলাদেশে ৩৫টিরও বেশি নতুন টিভি চ্যানেল ২৪ ঘণ্টা সংবাদ, রাজনৈতিক আলোচনা, পর্যালোচনা থেকে শুরু করে এমন কোনো খবর নেই যা অবাধে প্রচার করছে না। সরকার কি টেলিভিশনের এসব খবর বা টকশো প্রচার বন্ধ করে দিয়েছে? বাংলাদেশ এদিক থেকে অনেকদূর এগোয়নি? দেশে অনেক পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে, বেশকিছু পত্রিকা তাদের প্রতিবেদন এবং লেখালেখির জন্য সচেতন পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণও করছে। পত্রিকাগুলো এখন মানের প্রতিযোগিতার মধ্যে পড়েছে। অথচ বার্গম্যান বলছেন, ‘আওয়ামী লীগের অধীনে যে পরিস্থিতি, তাকে ঘোরতর খারাপ ছাড়া অন্য কোনোভাবেই বর্ণনা করার উপায় নেই।’ তার কাছে ভালো লাগত যদি এখন স্বাধীনতাবিরোধী এবং বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে উন্নয়নবিরোধী তথ্যপ্রমাণবিহীন অপপ্রচার দিয়ে গণমাধ্যম মানুষকে বিভ্রান্ত করার ক্ষেত্রে মাতামাতি অব্যহত রাখত। ডেভিড বার্গম্যান তার দেশে গিয়ে সেটি করতে পারেন। আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু আমরা মুক্তিযুদ্ধ এবং অনেক প্রতিকূলতা, সাম্প্রদায়িকতা, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র এবং অপশক্তির তৎপরতাকে মোকাবিলা করেই স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রম করে এখন একটি উন্নয়নশীল দেশ। ১৮ কোটি মানুষের মুখে আমরা সবেমাত্র অন্ন দিতে পেরেছি। কিন্তু উন্নত জীবন দেওয়ার জন্য নিরন্তর লড়াই আমাদের করতে হবে। শেখ হাসিনা দেশকে ১৫ বছরে নানা সীমাবদ্ধতা ও প্রতিকূলতার পরও একটি নিরাপদ জায়গায় এনেছেন, কিন্তু সেই নিরাপদ অবস্থানটি আজ অনেকেরই গাত্রদাহের বিষয়।
আমরা ভুলে যাইনি, ব্রিটিশ নাগরিক সাইমন ড্রিং (১৯৪৫-২০২১) সাংবাদিক হিসেবে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর সারা বিশ্বকে জানিয়েছিলেন। পাকিস্তানিরা তাকে দেশ থেকে বিতাড়িত করার পর তিনি তার সাংবাদিকতার সংগ্রাম কলকাতা থেকে অব্যাহত রেখেছিলেন। এই সাইমন ড্রিং-ই ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশে প্রথম বেসরকারি টেরিস্টোরিয়াল টিভি চ্যানেল প্রতিষ্ঠায় অনন্য মেধা ও ভালোবাসার স্বাক্ষর রাখেন। তার হাতেই প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন আমাদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অসংখ্য সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, প্রযুক্তিবিদ এবং মিডিয়া সম্পর্কীয় জ্ঞানগত ধারণা রাখার সূচনা প্রতিষ্ঠানের। ইটিভি শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্ব মিডিয়া জগতে তখন আলোড়ন সৃষ্টি করে। দেশপ্রেম, বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা, দেশ ও জাতির মনন গঠনের মতো অনুষ্ঠান প্রচারের আয়োজন নিয়ে ইটিভি সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। সেই সাইমন ড্রিংকেই জোট সরকার দেশত্যাগে বাধ্য করেছিল, ইটিভিও বন্ধ করে দেয়। ড্রিং নিজে দেশে বসেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রথম বেসরকারি গণমাধ্যম ইটিভির মাধ্যমে যে যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করেছিলেন, এর প্রতি আস্থা রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে যমুনা টিভি প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনাকালেও তার কারিগরি ও মিডিয়াজ্ঞান কাজে লাগানো হয়।
সাইমন ড্রিং বাংলাদেশের মানুষের কাছে ’৭১-এ ছিলেন একজন বিদেশি সাংবাদিক যোদ্ধা এবং ১৯৯৭-২০০২ এবং ২০০৯ পরবর্তী সময়ে হয়ে ওঠেন আধুনিক গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার পথিকৃৎ। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক হলেও বাংলাদেশের মানুষ তার কাছ থেকে ৫ দশকের মতো সেবা পেয়েছে। বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি তিনি করেননি। সে কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বন্ধু হিসেবে ২০১২ সালে সাইমন ড্রিংকে সম্মাননা দেয় শেখ হাসিনার সরকার। ডেভিড বার্গম্যান সেই শেখ হাসিনার সরকারকেই আগাগোড়া বিতর্কিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে এবং বাইরে বসে অপকর্ম করে যাচ্ছেন। নেত্র নিউজ ত্যাগ করেছেন, তবে তিনি হয়তো নতুন কোনো মিশন নিয়ে এখন নামবেন। তবে বাংলাদেশের মানুষের মনের মধ্যে একটি নামই অমর হয়ে থাকবে। সেটি সাইমন ড্রিং। ডেভিড বার্গম্যান কোথায় থাকবেন সেটি ইতিহাস থেকে খুঁজে নিতে হবে।
লেখক : ইতিহাসবিদ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
-বাবু/এ.এস