সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়ায় জনসমর্থন নিয়ে নির্বাচিত হয়ে আস্থার সাথে দীর্ঘদিন যাবৎ বাংলাদেশের মানুষের কল্যাণ এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে বিশ্ব মানচিত্রে উন্নয়নের এক মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে মানুষের হারিয়ে যাওয়া ভোটের অধিকার ফিরিয়ে এনেছে সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের পরিবেশ নিশ্চিত করার মাধ্যমে। বর্তমান সরকার প্রতিনিয়ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক চর্চা অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন যেমন ফেইক ভোট যেন না হয়, সেজন্য ভোটারের ফটো আইডি করে দিয়েছেন বর্তমান সরকার। কেউ কেউ অভিযোগ করে যে রাতের অন্ধকারে নাকি ভোট হয়ে যায়। তাদের সেই অযুক্তিক এবং ভিত্তিহীন মন্তব্যে চপেটাঘাত করতে বাংলাদেশ সরকার শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, স্বচ্ছ ট্রান্সপারেন্ট ব্যালট বাক্স তৈরি এবং তার মাধ্যমে সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করে আসছে বছরের পর বছর। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার মূলত জনগণের সরকার এবং জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনী বিল পাসের সমালোচনা করে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। এই দায়িত্ব পালন করতে হলে, ইসিকে স্বাধীনভাবে আইনি দায়িত্ব পালন করতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা হ্রাস করা সুষ্ঠু নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ঝুঁকি ও আস্থার সংকটে ফেলবে বলে আমরা মনে করি। তবে সংবিধান বিশেষজ্ঞরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইসির ক্ষমতা হ্রাস পাবে না, স্বাধীনতায়ও বাধা নয় বরং এটি নির্বাচন কমিশনকে একতরফা সিদ্ধান্তের বিপরীতে অধিক নিরপেক্ষ ও চাপমুক্ত রাখতে সাহায্য করবে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯১ (এ) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যদি এই মর্মে সন্তুষ্ট হয় যে নির্বাচনে বলপ্রয়োগ, ভীতিপ্রদর্শন, চাপ সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিরাজমান অপকর্মের কারণে যুক্তিযুক্ত, ন্যায়সংগত এবং আইনানুগভাবে নির্বাচন পরিচালনা নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে না, তাহলে যেকোনো ভোটকেন্দ্র বা ক্ষেত্র মতো সম্পূর্ণ নির্বাচনি এলাকায় নির্বাচনের যেকোনো পর্যায়ে ভোটগ্রহণসহ নির্বাচনি কার্যক্রম বন্ধ করতে পারবে।
অবশ্য ইসির কর্মকর্তাদের কেউ কেউ দাবি করেছেন, সংশোধনীতে ইসির ক্ষমতা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এতদিন আইনের এ ধারায় অস্পষ্টতা ছিল। এখন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইসি ভোট বন্ধ করতে পারবে, তা সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। ইসির থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং তা অনুমোদন হয়েছে যে ভোটের পর ফলাফলের গেজেট হওয়ার আগে অনিয়মের অভিযোগ পেলে এবং তদন্তে তা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট আসনের ফল বাতিল করার। এ জন্য আরপিওর ৯১ (ক) নামে আরেকটি উপধারা যোগ করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল এবং তা অনুমোদন হয়েছে। মন্ত্রিসভা প্রস্তাবিত নতুন ওই উপধারায় পুরো আসনের ভোট বাতিল না করে যেসব কেন্দ্র সম্পর্কে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হবে, সেই কেন্দ্রগুলোর ভোট বাতিলের অনুমোদন দিয়েছে। এতে নির্বাচন কমিশন ক্ষমতা হারায়নি, বরং ক্ষমতা বেড়েছে। পূর্বের ধারা অনুযায়ী কোন এক কেন্দ্রে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অন্যান্য সব কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট হওয়া সত্ত্বেও পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করে দেওয়া কোনোভাবেই ন্যায়সঙ্গত ছিল না। বর্তমান সংশোধনী অনুযায়ী কোনো আসনের যে কেন্দ্রে কোনো ধরনের অনিয়ম এবং জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে ঐ কেন্দ্রের ভোট বাতিল ঘোষণা করে দিবে ইসি। এক কেন্দ্রের জন্য বাকি সব কেন্দ্রে সুষ্ঠু ভোট হওয়া সত্ত্বেও পুরো আসনের নির্বাচন বাতিল করা ঠিক হবে না। এই সংশোধনীর মাধ্যমে ইসি দায়িত্ব আরো পরিষ্কার এবং ন্যায়সঙ্গত করে দেওয়া হয়েছে। কোনোভাবেই এই সংশোধনী ইসির ক্ষমতা হ্রাস করে দেয়নি।
নতুন সংশোধনীর ফলে আরপিওর ৯১ (ক) ধারা বহাল থাকছে। এটা ইসির ইনহ্যারেন্ট পাওয়ার। ৯১ (ক) ধারাটি প্রয়োগ হবে নির্বাচনি কার্যক্রম ও ভোট চলাকালে। এ ধারা প্রয়োগে কমিশন গাইবান্ধা-৫ আসনের মতোই পুরো নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারবে। আর প্রস্তাবিত ৯১(কক) ধারায় ভোট শেষ হওয়ার পর কোনো অভিযোগ পেলে প্রয়োগ করা যাবে। এতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরো বেড়েছে।
রিটার্নিং অফিসার ফলাফল ঘোষণা করার পর এবং কমিশনে ফলাফল পাঠানোর সময় অনেক সময় অভিযোগ আসে। কিন্তু সে সময় কোনো অভিযোগ এলে তা আমলে নেওয়ার জন্য কমিশনের কোনো ক্ষমতা নেই। ওই সময় কমিশন কিছু করতে পারে না। অভিযোগ থাকার পরও কমিশনকে গেজেট করে দিতে হয়। বড় ধরনের কোনো অভিযোগ থাকার পরও গেজেট হলে যাঁরা অভিযোগ তোলেন তাঁদের কষ্ট থেকেই যায়। কমিশনের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়। বলা হয়, আমরা একটা অভিযোগ দিলাম, কমিশন যাচাই-বাছাই কিছু না করে রিটার্নিং অফিসার যে ফলাফল দিলেন সেটাই বাস্তবায়ন করে ফেলল। এতে একটা ক্ষোভ তৈরি হয়। এ জন্য ৯১ (ক ক) উপধারাটি যোগ করে তাতে ভোটের পর ফলাফলের গেজেটের আগে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণিত হলে ভোট বাতিলের বিধানের প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে।
সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) ইসি ভোট শেষে অনিয়মের অভিযোগ খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট কিছু কেন্দ্রে ভোট বাতিল ও গেজেট প্রকাশ আটকে দেওয়ার ক্ষমতা পেয়েছে। এতে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা আরও বেড়েছে ও সুসংহত হয়েছে। সরকার নির্বাচন কমিশনের মতামত নিয়ে আরপিও সংশোধন করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। সরকার কিছু চাপিয়ে দেয়নি। নির্বাচন কমিশনের সম্মতিতে আরপিও সংশোধন করা হয়েছে। সরকার কিছু বিভ্রান্তি দূরের প্রস্তাব দিয়েছিল, যাতে ইসি সম্মতি দিয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে আইনটি নিয়ে নানা বক্তব্য এসেছে যা জনমনে বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে। কিন্তু যেসব ব্যাখ্যা, মন্তব্য এসেছে তার সবগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন। এজন্য ইসির পক্ষ থেকেও এটা স্পষ্ট করে বলা হয়েছে যে, সরকার আমাদের প্রস্তাব মতো আরপিও সংশোধন করেছে। ইসি তার অবস্থান আরও সংহত, শক্তিশালী করার জন্য সংশোধনগুলো চেয়েছিল, সরকার সম্মত হয়েছে। সংসদ সম্মত হয়েছে। এতে করে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বর্ধিত হয়েছে। কমিশন থেকে ইসির ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে এটাও অবান্তর কথা। ক্ষমতা কমানোর প্রস্তাব পাঠাতে পারে না ইসি। সমালোচকদের উদ্দেশে কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আমরা পুরো জাতি একটা সুন্দর নির্বাচন চাই। নির্বাচন নিয়ে অহেতুক, বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে ইসিকে হেয় করা বাঞ্ছনীয় নয়।
এছাড়া মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগের দিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ এবং টেলিফোন, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির সরকারি সেবার বিল পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আগে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সাত দিন আগে এসব ঋণ পরিশোধ করতে হতো। সংশোধনীর এই অংশে সুজন সমালোচনাকে বলে যে এর ফলে নাকি ঋণখেলাপিরা নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহিত হবে। এটাও নিঃসন্দেহে একটা অবান্তর সমালোচনা। মনোনয়নপত্র দাখিলের আগের দিন সবধরনের বিল পরিশোধের বিধান যদি ঋণখেলাপিদের নির্বাচনে অংশগ্রহণে উৎসাহ প্রদান করে তাহলে মনোনয়ন দাখিলের ৭ দিন পূর্বে কি ঋণখেলাপিরা চাঁদের দেশে থাকে? না তারা তখনও এদেশেই অবস্থান করে। এই সংশোধনী আনার একমাত্র কারণ নির্বাচনে যোগ্য এবং উপযুক্ত ব্যক্তিরা যেন মনোনয়ন দাখিলের শেষদিন পর্যন্ত ও সময় পায় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার কোনো ঋণখেলাপিকে উৎসাহ দিতে নয়। সুতরাং সুজনের এই সমালোচনা একেবারেই ভিত্তিহীন। এটা মূলত সমালোচনার জন্য সমালোচনা করা কোনো যৌক্তক সমালোচনা নয়।
এছাড়া সংশোধিত আরপিওতে নির্বাচনের সংবাদ সংগ্রহের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যমকর্মী এবং পর্যবেক্ষকদের কাজে কেউ বাধা দিলে তাকে শাস্তির আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। এ ধরনের অপরাধে সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ সাত বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এই সংশোধিত কিন্তু নিঃসন্দেহে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সংগঠিত করার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে। গণমাধ্যমের চূরান্ত স্বাধীনতা দিয়ে এই সংশোধনী এটায় প্রমাণ করল যে তা কতটা সুষ্ঠু নির্বাচন সহায়ক বান্ধব হয়েছে। এই সংশোধনী এটাই বোঝাচ্ছে যে নির্বাচনে কোন অনিয়ম এবং জালিয়াতি ঘটলে তা গণমাধ্যমের মাধ্যমে সরাসরি সহজে ইসিরসহ পুরো জাতির চোখে ধরা পড়বে। এর ফলে ইসি সংঘটিত সকল ধরনের অনিয়ম এবং জালিয়াতির ব্যাপারে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিতে পারবে।এভাবেই এই সংশোধনীর মাধ্যমে মূলত ইসির ক্ষমতা হ্রাস নয় বরং বৃদ্ধিই করেছে।
সর্বোপরি, এটা স্পষ্ট যে এই সংশোধনী কোনোভাবেই ইসির ক্ষমতা হ্রাস করেনি বরং ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার করে দিয়েছে। তবে পরিতাপের বিষয় হলো সুজন এর মতো একটা সংগঠনও সমালোচনার জন্য সমালোচনা করলো কোনো যুক্তিসঙ্গত সমালোচনা করেনি। যে যাই বলুক বা সমালোচনা করুক জনগণের সমর্থনে ও গণতন্ত্রে বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ সরকার পূর্বের ন্যায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের গণতন্ত্রের চর্চাকে অব্যাহত রেখে তাদের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করণে বদ্ধ পরিকর পূর্বে ছিল এবং ভবিষ্যতে ও থাকবে।
লেখক : ট্রেজারার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রফেসর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাবু/এ.এস