নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে বিদেশি কূটনীতিকরা সক্রিয় হয়ে ওঠেন। তাদের কর্মকাণ্ড রাজনৈতিক দলের মতো হয়ে যায়। যদিও শাসক দল এই শিষ্টাচার লঙ্ঘনের প্রতিবাদ করেছে, বিরোধী দলগুলো সঠিকভাবে এর জন্য তাদের কথা নিয়েছে। কখনও কখনও তাদের আরও সক্রিয় হতে অনুরোধ করা. তাদের দূতাবাসে গিয়ে কিছু জিনিসপত্র দিতেও দেখা যায়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী কিছু নিয়ম মেনে বিভিন্ন দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে যা সার্বজনীন। কিন্তু বিভিন্ন প্রভাবশালী দেশ এসব নিয়ম উপেক্ষা করে। এসব দেশের কূটনীতিকদের কার্যক্রম একটি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের শামিল। অ্যাক্টিভিস্ট কূটনীতিকদের কাছে এটা একটা প্রশ্ন আমেরিকায় প্রতিনিয়ত মানুষ খুন হচ্ছে। তারা কি কখনও বিবৃতি দেয়? জাতিসংঘ কি কখনো বিবৃতি দিয়েছে? আমেরিকায় মানুষ মারা যায় কেন? কেমব্রিজে ফয়সাল নামের এক বাংলাদেশি ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে, ছেলেটির তদন্ত কতদূর এগিয়েছে তারা কী বলেন? নাকি রাষ্ট্রদূতরা একটি বিবৃতি দেওয়ার জন্য দলবদ্ধ হয়েছেন? তাদের জিজ্ঞেস করেন না কেন?
বাংলাদেশের কূটনীতিকরা ভিয়েনা কনভেনশনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। বাংলাদেশে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা যে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন তা ভিয়েনা কনভেনশনের আওতায় পড়ে না। তাদের কার্যক্রম ভিয়েনা কনভেনশনের মধ্যে নেই। তারা বাংলাদেশে তাদের কর্মকাণ্ডে কোনো কনভেনশন মানে না। ফ্রান্সে যেখানে আন্দোলন চলছে সেখানে বাংলাদেশের একটি দূতাবাস রয়েছে। তবে তারা কোনো বক্তব্য দেননি। আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি না, কত মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কত মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, কী ভয়াবহ অবস্থা, কোনো দূতাবাসের কোনো বক্তব্য নেই। তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে আমরা কখনো কোনো বিবৃতি দিইনি। এমনকি মার্কিন ও ইউরোপীয় দূতাবাসও ফরাসি ঘটনার বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেয়নি।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে কেন এমন হচ্ছে, আমরা তাদের (বিদেশি কূটনীতিকদের) মাথায় নিয়ে নাচছি। তারা এই কাজগুলো করতে সাহস পায় এটাই আমাদের দোষ। আমাদের জন্য আমরা নিজেদের আত্মসম্মান নষ্ট করেছি। তাদের কোনো ব্যক্তিত্ব নেই। রাজনীতিবিদরা দেশের মর্যাদা নষ্ট করেছে। এই জিনিসগুলো দেখে আমাদের খুব খারাপ লেগেছিল। তাদের এই কাজগুলো করার সাহস কীভাবে হলো? তারা এমন বিবৃতি দেয় যেন আমাদের দেশ তাদের অধীনে চলে। আজকে আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের মতো শক্তিশালী দেশ হতাম তাহলে তারা এসব করতে সাহস পেত না। বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকদের কর্মকাণ্ড স্পষ্টতই ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। কূটনীতিকদের সক্রিয়তার কোনো স্থান নেই। পৃথিবীর কোনো দেশেই তারা এভাবে ব্যবহার করতে পারে না এবং করতে পারে না। হয় তো তারা আফ্রিকায় করে, আমি নিশ্চিতভাবে জানি না। আগে তারা সেখানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল, লুণ্ঠন করেছিল। শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়রা আফ্রিকা লুট করে। এখন লুট করতে না পারলেও তারা দেখাতে চায় যে তারা আমাদের চেয়ে ভালো। বিদেশি কূটনীতিকরা এখানে যা করছেন বা বলছেন, তাদের উচিত নয়। আমরা অত্যন্ত সতর্ক এবং কূটনীতিকরা অহস্তক্ষেপ নীতি বজায় রাখার নৈতিক বাধ্যবাধকতা বিবেচনা করেনি এবং এটি প্রাথমিক ভুল। তাদের এটা করতে দেওয়া উচিত নয়।
তবে শুধু গত নির্বাচন নয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলে বিদেশি কূটনীতিকদের সক্রিয় হতে দেখা যায়। এসব কর্মকাণ্ডে সরকারি দল তেমন নজর দেয়নি। কিন্তু বিরোধীরা সব সময় সমর্থন দিয়ে আসছে। ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৪১-এর ১ ধারায় বলা হয়েছেÑ যে ব্যক্তিরা অন্য দেশে কূটনৈতিক মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন, তারা সেই দেশের আইন ও নীতির দ্বারা আবদ্ধ হবেন। এছাড়া তারা সে দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না।
এই বিভাগে আরও দুটি উপধারা রয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ, অনুচ্ছেদের দুই নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, কূটনীতিকদের সবধরনের অফিসের কাজ, যা প্রেরক দেশ কূটনৈতিক মিশনে অর্পণ করবে, তা অবশ্যই গ্রহণকারী দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করতে হবে। তিন নম্বর উপধারায়, কূটনীতিকরা তাদের কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কোনো উদ্দেশ্যে তাদের মিশন অফিসের প্রাঙ্গণ ব্যবহার করতে পারবেন না। চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে যে কূটনৈতিক সম্পর্ক দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হবে। এছাড়া, ভিয়েনা কনভেনশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারা বা আর্টিকেল ৯-এ বলা হয়েছে যে কোনো দেশ কোনো কারণ ছাড়াই ওই দেশে নিযুক্ত অন্য কোনো দেশের কূটনীতিককে ব্যক্তিত্বহীন বা অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করতে পারে। সংশ্লিষ্ট দেশে পৌঁছানোর আগেই কূটনীতিককে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। কোনো দেশের কূটনৈতিক মিশনে কর্মরত যে কোনো ব্যক্তি, সেই মিশনের প্রধানসহ, তাকে অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করা যেতে পারে। এই ক্ষেত্রে, প্রেরণকারী দেশ নিযুক্ত কূটনীতিককে বরখাস্ত করবে বা প্রত্যাহার করবে। দেশ যদি যথাসময়ে তার কূটনীতিক প্রত্যাহার করতে ব্যর্থ হয়, তবে গ্রহণকারী দেশ কূটনীতিককে তার বিশেষ মর্যাদা ও নিরাপত্তা অস্বীকার করতে পারে।
বুধবার ভোররাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি রাজ্যে রমিম উদ্দিন আহমেদ নামে এক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে অপরাধীরা। গত ৪ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশি ছাত্র সৈয়দ ফয়সাল আরিফ। এ ঘটনায় দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। যে দেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মানবাধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন, শাস্তিস্বরূপ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে, সে দেশে পুলিশের হাতে নিহত হচ্ছে নিরীহ মানুষ; কিন্তু তার কোনো বিচার নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর গড়ে এক হাজার মানুষ পুলিশের হাতে প্রাণ হারায়। এটা ওয়াশিংটন পোস্টের খবর, আমার নয়। তাই, যখন তাদের নিজের দেশেই এমন অবস্থা, তখন তারা কীভাবে বলবে যে বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ সহিংসতার শিকার হয়। যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুকের পারমিট পেতে অনেক বাধা, সেখানে মানুষ সহজেই খুন হয়। সম্প্রতি ছয় বছরের এক শিশু শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করে। তাদের দেশে পুলিশের হাতে নিহত ৯৮.১ শতাংশের কোনো বিচার হয় না। এর জন্য কাউকে আদালতে দাঁড়াতে হয় না। এছাড়া গড়ে মারা যাচ্ছে হাজার হাজার মানুষ খুন ও খুন হচ্ছে।
পৃথিবীর কোনো দেশই সম্পূর্ণ নির্ভুল নয়। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কি অন্য দেশের কূটনীতিকদের তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করার অনুমতি দেবে?। কূটনীতিকরা এই কারণে কথা বলতে সক্ষম হয়; যেহেতু তাদের একটি প্ল্যাটফর্ম দেওয়া হচ্ছে। তারা নিজেদের মতো করে সংবাদ সম্মেলন করছে, সেভাবে নয়। সুযোগ দেওয়ায় তারা কথা বলছে। এমনও হতে পারে যে এই বিভাগের রাজনীতি তাদের স্বার্থে কাজ করে। বিরোধী দলও বিদেশিদের আশীর্বাদে নির্বাচনে গিয়েছিল। তাই তাদের হস্তক্ষেপ অপ্রত্যাশিতভাবে বেড়েছে।
আমরা ২০১৮ সালে দেখেছি যখন বার্নিকাট বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে হবে; এরপর বিএনপি নির্বাচনে যায়। কূটনীতিকদের অনৈতিক বক্তব্যে রাজনৈতিক ইন্ধনের বিষয়টি পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিন্তু একজন কূটনীতিককে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হলেও ভিয়েনা কনভেনশন অনুযায়ী দেশের বাইরে তার কার্যক্রম চালাতে হয়। আমরা তাদের বিভিন্ন জায়গায় আমন্ত্রণ জানাই, তারা সরকারি ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে দেখা করলে তা প্রচারও করা হয়। কূটনীতিকদের চেয়ে আমাদের জনগণ এই প্রচারণায় বেশি আগ্রহী। এসব কারণে আমরা নিজেরা দায়িত্ব এড়াতে পারি না। কূটনীতিকরা যখন বিভিন্ন দেশে কাজ করেন, তারা নীরবে কাজ করেন। তারা (কূটনীতিক) যখন বিভিন্ন দেশে কোনো রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে দেখা করেন, তখন তা প্রচার করা হয় না। কারণ এটা তাদের রুটিন ওয়ার্ক। কিন্তু আমরা নিজেদের স্বার্থে তাদের প্রচারে নিয়ে আসি। রাষ্ট্রদূতরা যখন ভারতে রাজনৈতিক নেতাদের সাথে দেখা করেন, এ নিয়ে কোনো খবর নেই। আমরা মনে করি যে অন্যান্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রশ্ন থাকলে কূটনীতিকদের আরও সচেতনভাবে মন্তব্য করা উচিত।
লেখক : নিরাপত্তা ও কৌশলগত বিষয়ক বিশ্লেষক
বাবু/এ.এস