বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার রাজনীতিতে অভিষেক যেমন তার জন্য সুখকর অভিজ্ঞতা ছিল না, তেমনি মসৃণ নয় তার রাজনৈতিক চলার পথটিও। পায়ে পায়ে পাথর ঠেলে শেখ হাসিনাকে আজকের অবস্থানে আসতে হয়েছে। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিযাত্রা একেবারেই কুসুমাস্তীর্ণ বলা যাবে না। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতোই অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এসেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পরিবারের অন্য সদস্যদের হারিয়েও স্বদেশে ফিরতে পারেননি তিনি। দেশের মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পরও ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করেছে ঘাতক। তাকে ২১ বার হত্যাচেষ্টা করা হয়। কিন্তু জনগণকে আস্থায় নিয়ে রাজনৈতিক কল্যাণের যে পথযাত্রা শুরু হয়েছিল তার, তা থেকে তাকে বিচ্যুত করা যায়নি। কারণ ওই সময় থেকে মাতৃসম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে লড়াই শুরু করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে শক্তি ও সাহস। স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে। কৃষক ও কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলে দেশ দ্রুত খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জন করে। পাশাপাশি সরকার বিভিন্ন খাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা গ্রহণের ফলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়েছে অর্থনীতিতে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ উন্নত দেশে পরিণত হবে। সরকার সে লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় থাকাকালে মাত্র ৯ মাসে জাতিকে সংবিধান উপহার দিয়েছিলেন। সাধারণ নির্বাচন দিয়েছিলেন। জাতির পিতার একমাত্র স্বপ্ন ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ে তোলা। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর ইতিহাস মুছে ফেলার যে ষড়যন্ত্র শুরু হয় তা অমোচনীয় কালো অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলোর জনবিচ্ছিন্নতা, লুটপাট ও দর্শনবিহীন রাষ্ট্র পরিচালনা বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাহীন রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ পরিচিতি পেয়েছিল ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং ভিক্ষুক-দরিদ্র-হাড্ডিসার মানুষের দেশ হিসেবে। ১৯৮১ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে এ দেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। শেখ হাসিনার সুদৃঢ় নেতৃত্বে স্বৈরাচার পতন ঘটে এবং দেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর থেকে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়াই করছেন। আজ জনগণ তার সুফলও পেতে শুরু করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি দরিদ্র দেশ থেকে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই উন্নয়নের ‘রোল মডেল’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথে বাংলাদেশে যে ইতিবাচক রূপান্তর হয়েছে, তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের নীতিনির্ধারকদের চোখ খুলে দিতে পারে। শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে চলেছে তা হতে পারে বিশ্বের উন্নত দেশের জন্যও অনুকরণীয়।
২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশকে অন্ধকার দেশে নিয়ে যাওয়া হয়। পাঁচ শ বোমা দেশকে ক্ষতবিক্ষত করেছিল। জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছিল, কোর্টের বারান্দায় বিচারপতিকে হত্যা করেছিল, আজকের প্রধানমন্ত্রী সেদিন বিরোধী দলের নেতা। আর শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য যারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করেছিল, বাংলাদেশকে জঙ্গিবাদের দেশ বানিয়েছিল, অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল, দুর্নীতিতে পাঁচ পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন করেছিল, মানুষের ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সামনে রেখে তত্ত্বাবধায়ককে বিতর্কিত করেছিল। দেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি নতুন করে কলুষিত হয় ২০০৭ ও ২০০৮ সালে। বাংলাদেশে তখন চলছে চেপে বসা অপশক্তির দুঃশাসন। গণতন্ত্র নির্বাসনে পাঠিয়ে চেপে বসা শাসকগোষ্ঠী তখন রাজনীতিবিদদের চরিত্র হননে ব্যস্ত। সেই দুর্বিষহ দিনে, সেনাসমর্থিত ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই ধানমন্ডির বাসভবন সুধা সদন থেকে গ্রেপ্তার করা হয় শেখ হাসিনাকে। তাকে প্রায় ১১ মাস রাখা হয় সংসদ ভবন এলাকায় স্থাপিত বিশেষ কারাগারে। গ্রেপ্তারের কয়েক দিন আগে রাজধানীর একটি হাসপাতালে শিল্পী সাবিনা ইয়াসমিনকে দেখতে গেলে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন শেখ হাসিনা। এর পরই ১৬ জুলাই ভোররাতে সুধা সদন ঘিরে ফেলে যৌথবাহিনী। তাকে গ্রেপ্তার করে ঢাকার নিম্ন আদালতে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেদিন শেখ হাসিনা আদালতের গেটে দাঁড়িয়ে প্রায় ৩৬ মিনিটের বক্তৃতার মাধ্যমে তৎকালীন অবৈধ সরকারের হীন রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন।
গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলটির প্রবীণ নেতা তৎকালীন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জিল্লুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে যান। শেখ হাসিনার অবর্তমানে শত প্রতিকূলতার মধ্য দিয়েও দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রাখেন জিল্লুর রহমান ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। নেতাদের মধ্যে দেখা দেয়া দ্বিধাবিভক্তিও দূর করেন তারা দুজন। পাশাপাশি শেখ হাসিনার মুক্তির আন্দোলন চালিয়ে যান আপসহীনভাবে। এক পর্যায়ে তাকে জামিন দেয়া হয়। তারপর জাতীয় নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। সরকারপ্রধানের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে শুরু হয় বাংলাদেশের উন্নয়নের নতুন অগ্রযাত্রা। টানা তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
দেশের উন্নয়নের অদম্য গতি কেউ থামাতে পারবে না। শেখ হাসিনার সরকার ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলবে। মানবতাবাদী দার্শনিক শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন, আমাদের দেশের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে আমরা কখনোই অন্যের মডেলের ওপর নির্ভর করব না। দেশের সার্বিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে আমরা নিজস্ব মেধা ও চিন্তার প্রয়োগ ঘটাব। দেশের উন্নয়নের পরিকল্পনা তৈরি করতে আপনাকে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জ্ঞানের সঙ্গে দেশের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করার জ্ঞানকে সমন্বয় করতে হবে, যা টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। ১৪ বছর আগের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে। ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। গ্রামীণ জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এ দেশের মানুষ ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখা ভুলেই গিয়েছিল। মানুষ আজ স্বপ্ন দেখে। সাধারণ মানুষ স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের। স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বাঁচার। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন।
শেখ হাসিনার দক্ষ নেতৃত্ব দেশের উন্নয়নের সঙ্গে অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে। কোভিড, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব সবকিছুকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা অদম্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, এই তলাবিহীন ঝুঁড়ি ভারতসহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের তুলনায় দ্রুত সম্প্রসারিত অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২.২২৭ মার্কিন ডলারে। মাথাপিছু আয় এবং অনেক মূল অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে।
বর্তমান সরকার কৃষি ও শিল্পসহ প্রকৃত অর্থনীতিতে অর্থ ঢেলেছে। বাংলাদেশ সরকারের বাজেট এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে এই অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি পরিচালনা করেছে। মুদ্রানীতির রক্ষণশীল চরিত্রকে বজায় রেখেও কৃষি, ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ এবং সবুজ উদ্যোগগুলোতে কম সুদের পুনঃঅর্থায়ন দিয়ে অর্থনীতিকে বলিষ্ঠ হতে সহযোগিতা করেছে। সেজন্য একদিকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ ভোগ ও চাহিদার ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ দীর্ঘমেয়াদে যাতে টেকসই উন্নয়ন কৌশলে নিবেদিত থাকে, সেজন্য আইএমএফ তাদের জ্ঞানভিত্তিক কৌঁসুলিদের বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যুক্ত করবে। বাস্তবেও তা-ই হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘সরকার দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে, তবু কিছু মানুষ সরকারের উন্নয়ন দেখে না। আমি দেশের মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন করবই। যারা চায়নি দেশের উন্নয়ন হোক এটা তাদের প্রতি আমার চ্যালেঞ্জ। এ সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি জানান, নিজের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য নয়, জনগণের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। আর সেটা তিনি বাস্তবায়ন করে দেখাবেন।’ প্রধানমন্ত্রী কথা ও কাজে বিশ্বাসী। তিনি দেশের উন্নয়নের জন্য কঠোর পরিশ্রম করছেন। আর সে কারণে দেশের শিক্ষা, যোগাযোগ, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, আইটিসহ নানা ক্ষেত্রে বিপুল কর্মযজ্ঞ ইতোমধ্যে সম্পাদিত হয়েছে এবং বহু কাজ চলমান রয়েছে। অন্যদিকে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের জন্য যেসব ক্ষেত্রের উন্নয়ন প্রয়োজন ওই পরিকল্পনায় সেসবের উল্লেখ রয়েছে। সময়ের বিবেচনায় ওই সব ক্ষেত্রের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন পড়বে অভ্যন্তরীণ প্রচেষ্টাকে যথেষ্ট শক্তিশালী করা। আর অভ্যন্তরীণ নীতি, কর্মসূচি এবং বাস্তবায়ন মাপকাঠি-সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলোর উন্নয়নে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখবে।
আমরা বিশ্বাস করি, রূপকল্প-২০৪১ সুনিপুণভাবে বাস্তবায়িত হবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আরও মর্যাদা অর্জন করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর কাছে আজ আশ্রয়ের প্রতীক। শেখ হাসিনার উন্নয়ন ভাবনা, মানুষের প্রতি ভালোবাসা, মানবিকবোধ প্রশংসনীয়। একদিন যারা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে দেশের উন্নয়ন অভিযাত্রাকে থমকে দিতে চেয়েছিল তারা আজ ব্যর্থ; অন্যদিকে সফলতার সব কৃতিত্ব মানবতাবাদী দার্শনিক শেখ হাসিনার।
লেখক : চিকিৎসাবিদ ও সংসদ সদস্য
বাবু/এ.এস