সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫ ৩০ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ১৪ জুলাই ২০২৫
ডলার সংকট ও রুপিতে বাণিজ্য
মো. মিজানুর রহমান
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৩, ২:৫৪ PM

মহামারি করনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশ-ভারত দুটি দেশেরই বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ নাজুক। ফলশ্রুতিতে সাম্প্রতিককালে দুটি দেশেরই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তলানিতে নেমে এসেছে। এক বছর আগের তুলনায় বাংলাদেশের রিজার্ভ কমেছে প্রায় ৩০ শতাংশ। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স থেকে আসা বৈদেশিক মুদ্রার তুলনায় আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় ক্রমশই রিজার্ভ হ্রাস পাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় করনা পরবর্তী গত দেড় বছরে টাকার মূল্যমান কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। অবস্থা এমন হয়েছে যে বাড়তি দামেও ডলার পাওয়া যাচ্ছে না। উপায়ান্ত না দেখে অনেক ব্যাংক নতুন করে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলাও বন্ধ রেখেছে।

ডলারের উপর একচ্ছত্র নির্ভরশীলতা কমানোর জন্য দুটি দেশের আমদানি-রপ্তানির মূল্য পরিশোধে রুপি ব্যবহারের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। তবে এই সিদ্ধান্ত যে রাতারাতি গৃহিত হয়েছে তাও বলা যাবে না; বরং ২০১৩ সালেই ভারত এতদ একটি প্রস্তাব বাংলাদেশের কাছে করেছিল। সে সময় নানাবিধ কারণে সেই প্রস্তাবটি আর আলোর মুখ দেখতে পারেনি। দুই দেশের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যকার বিভিন্ন সংলাপ, মিটিং, সেমিনার, আলাপ-আলোচনার পর অবশেষে দীর্ঘ ১০ বছর পর এই গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিটি সম্পাদিত হয়।

প্রাথমিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে ব্যবসা, চিকিৎসা, শিক্ষা কিংবা ভ্রমণ যেই উদ্দেশ্যেই গমন করুক না কেন তাদেরকে আর স্থানীয় মুদ্রা ডলারে রুপান্তর করতে হবে না। ঠিক তেমনি যারা ভারত থেকে বাংলাদেশে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে আগমন করেন তারা ভ্রমণের সময় বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনতে ব্যাংক হিসেবে টাকা যোগ করতে পারবেন। ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের এই নতুন উদ্যোগের ফলে এখন থেকে ইসভয়েসিং, পেমেন্ট, আমদানি, রপ্তানির সকল প্রকার সেটেলমেন্ট ভারতীয় রুপির মাধ্যমেই করা যাবে। দুটি দেশের মধ্যকার এ দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে রুপিতে লেনদেন শুরু হলেও পরবর্তীতে টাকায়ও লেনদেন চালু হবে। ফলে রাশিয়া ও চীনের পর প্রতিবেশি দেশ ভারতও যে মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে নতুন পথে ধাবিত হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বাংলাদেশ অংশে সরকারি মালিকানাধীন সোনালী ব্যাংক পিএলসি এবং বেসরকারি মালিকানাধীন ইস্টার্ন ব্যাংক লি: আর ভারতের অংশে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া এবং আইসিআইসি ব্যাংকে রুপিতে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দিয়েছে। দুটি ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে কেলমাত্র ভারতে রপ্তানির বিপরীতে রুপি থেকে অর্জিত আয় জমা করা যাবে। উক্ত জমাকৃত অর্থ শুধুমাত্র ভারত থেকে আমদানি করা পন্য ও সেবায় ব্যয় মেটানো যাবে। খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে, নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট কি? সহজ ভাষায় বলতে গেলে কোন ব্যাংক যখন অপর কোনো বিদেশি ব্যাংকে হিসাব খোলে তখন তাকে নস্ট্রো অ্যাকাউন্ট বলে। মূলত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় ও বানিজ্যিক লেনদেনের সুবিধার্থে এ ধরনের অ্যাকাউন্ট ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

ডলার বা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অন্য কোনো মুদ্রার বদলে নিজ দেশীয় মুদ্রায় আমদানি-রপ্তানি কার্জ সম্পাদন করাকে অর্থনীতির ভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ এরেঞ্জমেন্ট’ বলে। আর এই কারেন্সি সোয়াপ এরেঞ্জমেন্ট বা ভারতীয় ‘রুপি সোয়াপ’ মোটেও খারাপ কোন চুক্তি না। তবে  ‘রুপি সোয়াপ’ই পৃথিবীতে প্রথম কোন উদাহরন নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহ, মায়ানমার, ইরান ইত্যাদি দেশসমূহ যারা এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন র্(এসিইউ) এর সদস্য তারা পারষ্পরিক আলোচনার মাধ্যমে ইতিমধ্যেই নিজেদের মুদ্রায় বৈদেশিক লেনদেনের বিষয়ে সম্মত হয়েছে। যেমন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যখন ইরানের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, ঠিক তখন ইরান ভারতে জ¦ালানি তেল রপ্তানি করেছিল রুপির মাধমেই।

তবে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী সমাজ এবং অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা ইতিমধ্যেই ডলারের পরবর্তিতে রুপি ব্যবহারের পজেটিভ আর নেগেটিভ দিকসমূহ নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে শুরু করেছেন। অর্থনৈতিক বোদ্ধাদের মতে ডলারের পরিবর্তে রুপির ব্যবহারের ফলে রুপির উপর নির্ভরতা সৃষ্টি হবে এবং নিকট ভবিষ্যতে হয়তো এমন দিনও আসবে যখন ভারতীয় ব্যাংকসমূহ রুপি ছাড়া অন্য কোনো বৈদেশিক মুদ্রায় এলসি ওপেন নাও করতে পারে।

বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য মতেÑ ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ভারতে রপ্তানির পরিমান ছিল ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, বিপরীতে ভারত থেকে বাংলাদেশে আমদানির পরিমাণ ছিল ১৩.৬৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে রুপি কোন স্বীকৃত রিজার্ভ কারেন্সিও না। আর বাংলাদেশ যেহেতু মূলত একটি আমদানি প্রধান দেশ, ফলে খুব স্বভাবতই আমাদের রপ্তানি পোর্টফলি তুলনামূলক অনেক কম। একটা বিষয় খুবই পরিষ্কারÑ এখন থেকে যেহেতু ভারতে কোনো পণ্য বা সেবা রপ্তানি করলে তা রুপিতেই করতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমদানি করলে এত বিশাল পরিমাণের রুপি কোত্থেকে পাওয়া যাবে? এর একটি পথ হতে পারে ডলার ভাঙিয়ে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হবে কিংবা সরাসরি ডলারের মাধ্যমেই আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে হবে। ফলে আলটিমেটলি বাংলাদেশের খুব বেশি লাভবান  হবে না বলেই মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকেরা। আবার বিষয়টা এমনও নয় যে বাংলাদেশ তার আমদানির সমুদয় অর্থ দেশীয় টাকায় পরিশোধ করতে পারবে, কারণ আমাদের টাকা নিয়ে ভারতের কোনো লাভই নেই। যেমন কিছুদিন পূর্বে ভারত রুপির মাধ্যমে রাশিয়া থেকে কিছু পণ্য আমদানি করতো। কিন্তু সাম্প্রতিককালে রাশিয়া এই রুপি গ্রহণ করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে।

এদিকে মার্কিন ডলারকে এড়িয়ে প্রতিবেশি দেশ ভারতের সাথে রুপির মাধ্যমে সম্পাদিত লেনদেনকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে দেখবে এখন এটাও একটি দুশ্চিন্তার বিষয়। কারন ভারতে প্রতিবছর যে পরিমাণ রপ্তানি হয় তার থেকে ১৩-১৪ গুণ বেশি পণ্য রপ্তানি হয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। বিশেষত গার্মেন্টস ও তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় বাজার হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে ভারতের সাথে এ চুক্তির কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে চলমান দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক যেন কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেটিও মাথায় রাখতে হবে।

অথনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, অনাকাক্সিক্ষত ডলার সংকট, ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে ভারত-বাংলাদেশ মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে রুপির ব্যবহারকে সীমিত সময়ের জন্য ফলপ্রসূ মনে হতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে এটি কতটুকু কার্যকর তা সময়ই বলে দেবে। আর প্রতিবছর বাংলাদেশ যেই ২০০ কোটি ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি করা হয়, আগের নিয়ম হলে বাংলাদেশ ভারত থেকে স্বাভাবিকভাবেই ২০০ কোটি ডলার পেত, কিন্তু বর্তমানের হিসাবে ডলারের বদলে রুপি আসবে। ফলে এ রপ্তানিতে আমাদের দেশীয় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। আবার ভারতের সাথে রুপির মাধ্যমে যেই লেনদেন করা হবে, তার বিনিময় হার কিন্তু নির্ধারিত হবে ডলারে। ফলে এক ডলারে কত রুপি পাওয়া যাবে তাও সুনির্দিষ্ট করে রাখা উচিত। এছাড়াও ভারত পাট, পাটজাত পণ্য, বাংলাদেশে তৈরি হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ইত্যাদি পণ্যের উপর অ্যান্টি ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় ভারতে রপ্তানিযোগ্য পন্যের তালিকা দিনকে দিন হ্রাস পাচ্ছে। পণ্য ভিত্তিক এ শুল্ক প্রত্যাহারের উপর ভারতীয় ‘রুপি সোয়াপ’ এর সফল বাস্তবায়ন অনেকাংশেই নির্ভর করছে।

স্বাধীনতা লাভের পর থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি বরাবরই আমদানি নির্ভর। আর আমদানির বিশাল ব্যয়ভারের যোগান আসে মূলত প্রবাসীদের প্রেরিত কষ্টার্জিত রেমিট্যান্স আর ছোট্ট পরিসরের রপ্তানি আয় থেকে। কিন্তু বাংলাদেশের শ্রমবাজার যেমন উন্মুক্ত ভারতের শ্রমবাজার তার ঠিক উল্টো। ভারতের যেই বিশাল জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে কাজ করছে তাদের বেতন-ভাতাও পরিশোধ করতে হয় এই রেমিট্যান্স থেকেই। ফলে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কখনোই সন্তোষজনকভাবে ছিল না। কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট বা ভারতীয় ‘রুপি সোয়াপ’ এর সফল বাস্তবায়ন করতে চাইলে ভারতের শ্রমবাজারে বাংলাদেশি শ্রমিকদের প্রবেশাধিকার উন্মুক্ত করতে হবে এবং অযাচিত শুল্কারোপ প্রত্যাহার করতে হবে।  

লেখক :  সহযোগী সদস্য, দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড সেক্রেটারিজ অব বাংলাদেশ (আইসিএসবি) ও আইনজীবী, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, কুমিল্লা

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত