বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কেবল রাজনৈতিক স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিল না, এটা ছিল একাধারে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। জাতিসংঘের এক হিসাব মতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অর্থনৈতিক ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১.২ লক্ষ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠিত করা। যে কোনো নতুন সরকারের পক্ষে এক পর্বত প্রমাণ কাজ। তাছাড়া ছিল যুদ্ধের সময় ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী প্রায় ১ কোটি লোকসহ ৩ কোটি গৃহহীন লোকের পুনর্বাসন সমস্যা। স্বাধীনতা লগ্নে বাংলাদেশের না ছিল বৈদেশিক মুদ্রা, না ছিল খাদ্য মজুদ। এমতাবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং সাধরণ মানুষ চরম অর্থনৈতিক দুর্দশায় পতিত হয়। অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের সুস্পষ্ট আদর্শটি সবকিছুর ঊর্ধ্বে বিরজমান ছিল অবিচল আস্থায়। কল্যাণ রাষ্ট্রে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটিয়ে সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়টি ছিল শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক দর্শন।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনীতির মূল এবং একমাত্র দর্শনই ছিল জনগণের মৌলিক চাহিদা তথা খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় সাংবিধানিক অধিকার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩, ১৪ এবং ১৫ নং অনুচ্ছেদে এসকল অধিকারের কথা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বাংলাদেশ আর বঙ্গবন্ধু মুক্তিকামী মানুষের দৃষ্টিতে সমার্থক। তাঁর প্রমাণ ১৯৭১ সালে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেন, আপনার ৫২তম জন্মদিনে সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী? উহার উত্তরে তিনি বলেছিলেন জনগণের সার্বিক মুক্তি।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের লায়ালপুর কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু স্বদেশের মাটিতে পা রাখলেন। তাঁর প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দান করে; দেশ ফিরে পায়তার প্রিয় নেতা ও প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি যখন ফিরছিলেন তখন বিমানের জানালা থেকে নিচের জনসমুদ্র দেখা যাচ্ছিল। এটা দেখে নিতে অভিভূত হয়ে তিনি কেদেঁছিলেন। দেশ স্বাধীন হবার পরে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শীতায় ভারত ও ইরাকসহ কয়েকটি মিত্ররাষ্ট্র খাদ্যসহ নিত্যপণ্য সাহায্য পাঠায়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য অন্যান্য সংস্কারের সাথে সাথে অর্থনৈতিক সংস্কারের নিমিত্ত বেশকিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর অসংখ্য শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের অবাঙালি মালিকগণ দেশত্যাগ করলে সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সংক্রান্ত এ আইনটি ১৯৭২ সালের ৩ জানুয়ারি প্রণীত হয়। ১৯৭২ সালের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির ১নং আদেশ এবং পরবর্তীতে ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রপতির ১৬ নং আদেশ (পিও-১৬) অনুসারে বাংলাদেশ সরকার ঐসকল প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের অব্যবহিত পূর্বে পাকিস্তানিরা ২৮৮.৬০ কোটি টাকার মূল্যের ৭২৫টি ইউনিট পরিত্যক্ত রেখে পালিয়ে যান। এগুলো ছিল বাংলাদেশের আধুনিক শিল্পগুলোর মোট অংশের ৪৭ শতাংশ এবং বেসরকারি খাতের মোট শিল্পের ৭১ শতাংশ। এর অন্তর্ভুক্ত ছিল ৬টি বাণিজ্যিক ব্যাংক, যেগুলো এ অঞ্চলের মোট ডিপোজিটের ৭০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করত।
১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীনতার প্রথম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে পাট, বস্ত্র, চিনিকল, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণের আওতাভূক্ত করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক জাতীয়করণ আদেশের আওতায় সমস্ত শাখাসহ ১২টি ব্যাংকের দখলিস্বত্ব সরকার গ্রহণ করে এবং সেগুলো ক্রমান্বয়ে ৬টি নতুন ব্যাংকে রূপান্তর করে। জাতীয়করণ আইনের আওতায় ৬৭টি পাটকল, ৬৪টি বস্ত্রকল এবং ১৫টি চিনিকল জাতীয়করণ করা হয়। জাতীয় বিমান সংস্থা ও জাতীয় শিপিং সংস্থা যা আগেও সরকারি মালিকানায় ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাতের অধীনে আনা হয়। এভাবে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ জাতীয়করণ করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শাসনভার গ্রহণের সময় দেশের শতকরা ৮৫ ভাগ লোক কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল এবং জাতীয় আয়ের অর্ধেকেরও বেশি ছিল কৃষিখাত নির্ভর। আর সেই সিংহভাগ কৃষকের কল্যাণেই তিনি সবুজ বিপ্লবের ডাক দেন। ‘কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে’ এটা কেবলই একটা স্লোগান ছিল না, ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন সরকারের অগ্রাধিকার কর্মসূচি। মুক্তিযুদ্ধের পর ২২ লক্ষেরও বেশি কৃষক পরিবারকে পুনর্বাসন করেছিল বঙ্গবন্ধু সরকার। জমির সকল বকেয়া খাজনা মওকুফসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করেন।পরিবার প্রতি সর্বাধিক ১০০ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকানা নির্ধারণ করেন।পাকিস্তানামলে ১০ লক্ষ কৃষকের বিরুদ্ধে ঋণের সার্টিফিকেট মামলা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সরকার এসব ঋণী কৃষকদের মুক্তি দেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে নতুন সমাজ গঠনের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা উপহার দেন। তিনি প্রায়শ বলতেন যে, বাংলাদেশের সংবিধান এবং পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা হলো বাঙালি জাতির অমূল্য দলিল এবং তা বাঙালি জাতিকে দেশ শাসন ও উন্নয়নের দিক নির্দেশনা প্রদান করবে। ১৯৭৩ সালের ১ জুলাই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-৭৮ কার্যকর হয়। এই পরিকল্পনার দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য হবে দারিদ্র্য হ্রাস। যার লক্ষ্য অর্জনের কৌশল হিসেবে বলা হয়েছিল; কর্মের সুযোগ বৃদ্ধি এবং সমতাভিত্তিক বণ্টন নিশ্চিত করার জন্য কার্যকর আর্থিক ও দ্রব্যমূল্য সংশ্লিষ্ট নীতিমালা।
অর্থনীতির প্রতিটি খাতে বিশেষত কৃষিশিল্পের পুনর্গঠন ও উৎপাদন বৃদ্ধি। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির হার ৩ শতাংশ থেকে ৫.৫ শতাংশ এ উন্নীত করে। আর আনুষ্ঠানিক খাতগুলোর কর্মসংস্থানবৃদ্ধির পাশাপাশি উন্নয়নে স্বেচ্ছাশ্রম বিকাশ। মানবশক্তি ও অর্থনৈতিক সম্পদের সর্বোচ্চ বিকাশের লক্ষ্যে উন্নয়নমূখী স্থানীয় সরকার কাঠামো শক্তিশালী করা। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য বিশেষ করে খাদ্য, বস্ত্র, ভোজ্যতেল, কেরোসিন, চিনি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং এসবের বাজার মূল্য দরিদ্র জনগোষ্ঠীর হাতের নাগালে রাখা এবং স্থিতিশীল করা (কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধির সাথে সংগতি রেখে)।
১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সমুদ্রসীমা ও মহীসোপানে বাংলাদেশের ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের দাবিনামা পেশ করেন। কূটনৈতিক দক্ষতা, আইনি প্রস্তুতি, সার্ভে ম্যাপ বানানোসহ সবদিক থেকে আঁটসাঁট বেঁধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০১২ সালে মায়ানমারের সাথে এবং ২০১৪ সালে ভারতের সাথে বিরোধ নিস্পত্তিতে ইতিবাচক রায় পায় যার ফলে বাংলাদেশ লাভ করে ১,১৮,০০০ বর্গ মাইল সমুদ্র এলাকা, ২০০ নটিক্যাল মাইল মহীসোপান।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মুক্তি চেতনা বুঝতে হলে অবশ্যই তৎকালীন বিশ্ব পরিস্থিতি বুঝতে হবে। পৃথিবী তখন দুটি ব্লকে বিভক্ত ছিল, একদিকে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়া, চীন অন্যদিকে পুঁজিবাদী শক্তি আমেরিকা, বঙ্গবন্ধু কোন ব্লকেই যোগ দেননি। তিনি এ ভূখণ্ডের মানুষ, তাদের সংস্কৃতি, মাটির গঠন, প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী স্বতন্ত্র একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। এটা শুধু রাজনীতিবিদদের কাজ না, একজন দার্শনিকের কাজ। কিন্তু নানা কারণেই সেগুলো কিছু বাঁধার সম্মুখীন হয়। একদিকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ, ব্যাংকে টাকা নেই, কোষাগার শূন্য, সমস্ত অবকাঠামো বিপর্যস্ত, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট ভাঙা, ২ কোটি মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে, ১ কোটি ৪০ লাখ কৃষক পরিবার তাদের লাঙল-জোঁয়াল, গবাদি পশু রেখে গেছে, বাড়ি ঘর সব লুটপাট হয়ে গেছে, এমনকি ফিরে যাবার আগে-পরে পাকিস্তানি সেনারা এদেশের গুদামগুলো পর্যন্ত লুট করে গেছে, না পারলে আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। দেখলে মনে হতো যেন পারমাণবিক বোমার আঘাতে এক পরিত্যক্ত বিভীষিকাময় ভূখণ্ড।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে বিপর্যস্ত বাংলাদেশকে পুর্নগঠন করতে প্রবল বিক্রমে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করলেন, রাস্তা ঘাট মেরামত করতে লাগলেন, শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীকরণ করতে লাগলেন। একটি সদ্যোজাত বিপর্যস্ত স্বল্পোন্নত দেশকে কিভাবে একটি শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে লক্ষ্যে তিনি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) প্রণয়ন করলেন। নানান বাঁধা বিপত্তি সত্ত্বেও তিনি দেশটা এগিয়ে নিচ্ছিলেন স্বীয় মেধা-মননশীলতা-বিচক্ষণতা এবং সীমাহীন দূরদর্শিতায়। তখনই একদল ভিন্ন মতাবলম্বী তাঁকে অসহযোগিতা শুরু করলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের কাছে সামান্য সময় চেয়েছিলেন শুরুর দিকে অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের জন্য। কিন্তু সে সময় দিতে রাজি ছিল না এদেশেরই একদল অসহিষ্ণু বিপদগামী তরুণ। তাই আত্মত্যাগ তাঁকেই করতে হয়েছে। পুরো পরিবার নিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়েছে।
অত্যন্ত দুঃখবহ এবং করুণ মৃত্যুবরণ করলেও তিনি একটি মুক্ত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ এদেশের মানুষকে উপহার দিয়েছেন, একটি নতুন জাতি সত্তা সৃষ্টি করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু যে অর্থনীতির দর্শন দিয়ে গেছেন সে পথ ধরেই আমাদের প্রত্যাশা অগ্রগতির ধারা আরো বেগবান হবে।
লেখক : প্রভাষক, ইস্পাহানী ডিগ্রি কলেজ, কেরাণীগঞ্জ, ঢাকা
বাবু/এ.এস