বৈশ্বিক অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে দ্রুত ঘুরে দাড়িয়েছে যে দেশটি সেটি শ্রীলঙ্কা। খাদের কিনার নয় একেবারে খাদের মধ্যে থেকে উঠে দাড়িয়েছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয়টা যেমন ছিল বিশ্বের কাছে বিস্ময়, ঠিক এক থেকে দেড় বছরের মাথায় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানোটাও একটা বিস্ময়। প্রশ্ন হলো কোন ম্যাজিকে শ্রীলঙ্কা এভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছে? সে আলোচনায় আসার আগে শ্রীলঙ্কার প্রেক্ষাপটের এক বছর আগে ফিরে যাওয়া যাক। করোনা মহামারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যখন বিশ্ব অর্থনীতি ঝুঁকছিল এবং যার রেশ এখনও বিশ্বব্যাপী রয়েছে যেমন অনেক দেশ মূল্যস্ফীতির ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি, খাদ্যসংকট এখনও চোখ রাঙাচ্ছে অথবা এশিয়ার দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির মতো ঘটনাগুলো এখনও চলছে ঠিক সেই সময় আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার পর্যটনসমৃদ্ধ দেশ শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি চরম অবনতি ঘটে। পরিস্থিতি দেশটির দেউলিয়ায়ত্বের দিকে নিয়ে যায়। রাজনীতির ঐতিহাসিক পট পরিবর্তন ঘটে। মোট কথা গত বছরের শুরু থেকেই শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি থেকে রাজনীতি অত্যন্ত খারাপ সময়ের মধ্যে পার করে। সময়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল হলেও অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে সংগ্রাম করতে হয় দেশটিকে। দেশটিতে জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে উঠে। সারা বিশ্বের মতো শ্রীলঙ্কায় বেকারত্ব অসহ্য হয়ে উঠে। এরই মধ্যে বর্তমান সরকার বহু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে অর্থনীতি ফিরিয়ে আনতে। নানাভাবে ব্যয় সংকোচনের পথে হাঁটতে দেশটির সরকার। কৃচ্ছ্রসাধনে সরকারি নিয়োগ স্থগিত ও চাকরির মেয়াদ কমিয়ে আগাম অবসরের ঘোষণাও দেওয়া হয়। এরপর সেনাবাহিনীর সংখ্যাও কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার। শ্রীলঙ্কায় তিন লাখ ১৭ হাজার সেনার বিশাল বাহিনী থেকে তিন ভাগের এক ভাগ কমিয়ে এক লাখ ৩৫ হাজারে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। দেশটির কৃষি এবং ভ্রমণ এই দুই খাত শক্তিশালী করতে হবে যেখান থেকে তারা খাদ্যনিরাপত্তা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। স্বাধীনতা অর্জনের পর গত ৭০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দেশটি দাড়িয়ে আছে। সেখান থেকে ফিরতে সবরকম প্রচেষ্টাও করছে। দেশটির জনগণ দীর্ঘদিন মারাত্মক জ্বালানি সংকটেও ভুগছে। সাধারণ মানুষও বিক্ষোভে নামেন। এসব ঘটনার মধ্যেই পর্যটনকে কেন্দ্র করে শ্রীলঙ্কা এগিয়ে যেতে থাকে। এরপর গত কয়েক বছরে করোনা মহামারী শুরু হলে পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। এর পরেই দেশটি বড় ধরনের ধাক্কা খায়।
ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়নের জন্য নেওয়া বিপুল পরিমাণে ঋণ এবং অর্থনীতির অচলাবস্থা এ দুইয়ে মিলে শ্রীলঙ্কা বিপর্যস্থ হয়ে পরে। অভিযোগের তীর যায় ক্ষমতাসীন রাজপাকসে পরিবারের দিকে। শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিস্থিতির পেছনে রাজপাকসে পরিবারের দিকে আঙুল তুলেছেন দেশটির জনগণ। দুর্নীতি ও শাসনের পরিবারতন্ত্রের দিকে আঙুল ওঠে। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে দেশটি দেউলিয়াত্বের কাতারে চলে যায়। দেশটির রাজনৈতিক সংকট যখন মারাত্বক আকার ধারণ করে সেই পরিস্থিতিতে ব্যাপক গণআন্দোলনের মুখে গোতাবায়া রাজপাকসে দেশ ছাড়েন এক প্রকার লোকচক্ষুর অন্তরালে। তারপর মালদ্বীপ-সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড ঘুরে ৫০ দিন পর তিনি দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক কাঠামো শক্তিশালী করাই ছিল প্রধান চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক পরিস্থিতি এখন মোটামুটিভাবে শান্ত। দেশটির প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমাসিংহে অর্থনীতির এই উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিভিন্ন সংস্থা ও দেশের দারস্থ হয়। প্রধানমন্ত্রী নিজেও পর্যটন খাতকে শক্তিশালী করার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। তবে প্রতিটি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন ছিল সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। ঋণের সুদ পরিশোধ করার মতো সক্ষমতা অর্জন করা, বেকারত্ব দূর করা বা প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, খাদ্যপণ্য, জ্বালানী ও ঔষধ পণ্যের মতো অতিদরকারি পণ্য আমদানি করা ইত্যাদি চাপ সামাল দিতে হচ্ছে শ্রীলঙ্কাকে।
অর্থনীতি থেকে রাজনীতির উত্থান-পতনের সাক্ষী দেশটি। চলতি বছর যখন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয় তখন বিশ্বজুড়েই নানামুখী সংকট ঘনিভূত হতে থাকে। বিশ্ব ক্রমেই মুদ্রাস্ফীতির কবলে পরে এবং খাদ্য সরবরাহ, জ্বালানী সরবরাহ প্রভৃতি কারণে জীবনযাত্রার মান কমতে থাকে। এর মধ্যে যে দেশটি সবচেয়ে খারাপ অবস্থা পার করছে সেটি শ্রীলংকা । শ্রীলঙ্কার সমস্যার শুরু হয়েছিল অর্থনৈতিক সংকট থেকে। তারপর এটি রাজনীতিতে ছড়িয়ে যায়। শ্রীলঙ্কার প্রধান অর্থনীতির ভিত হলো পর্যটন খাত। করোনায় বিপর্যয় ঘটার পর আবার তা ঘুরে দাড়াতে থাকে। ধীরে ধীরে শ্রীলঙ্কা গভীর সংকটে ডুবে যেতে থাকে। একদিকে বাইরের ঋণ ও অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির মন্থর গতি সবমিলিয়ে সেসময়ের সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু সিদ্ধান্ত অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পালন করেছে। ক্ষমতা গ্রহণের পর কিছু কিছু খাতে সংস্কারের পাশাপাশি আইএমএফের সাথে প্রায় তিন বিলিয়ন ডলারের একটি ‘বেইল আউট প্যাকেজ’ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী। চলতি বছরের মার্চে আইএমএফ বোর্ড সেটি অনুমোদন করে। এরপর খাদ্যমূল্য, বিদ্যুতের দাম সামান্য কমানোর চেষ্টা করে জনজীবন সহজ করার চেষ্টা করে সরকার। এর অংশ হিসেবে ২৩ লাখ অতি দরিদ্র পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা দেওয়া হয়। জনগণ প্রথম থেকেই নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের সংকটে পরে। সুতরাং জীবনযাপন হয়ে ওঠে অসহনীয়। জনগণের জীবনমান সহজ করাই ছিল সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ। বিষয়টিকে দ্রুত রিকভারির সাথে তুলনা করা যায়। এটা কোনো ম্যাজিক নয় বরং সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তার বাস্তবায়ন। দেশটিতে তীব্র মূল্যস্ফীতি তৈরি হয়। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতির হার পৌছে ৬৯ দশমিক ৮ শতাংশে। সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি নেমেছে ৪ শতাংশে। অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এটাই দেশটির সর্বনিম্ন মূল্যস্ফীতির হার। গতবছরের মাঝামাঝি থেকেই তা বেশ শক্তিশালী হতে থাকে। এছাড়া বাংলাদেশের কাছ থেকে নেওয়া অর্থও পরিশোধ করতে শুরু করেছে। শ্রীলঙ্কার জিডিপির ১২ শতাংশ আসে পর্যটন থেকে। এক সময় দক্ষিণ এশিযার মানুষের কাছে প্রিয় ঘুরে বেড়ানোর স্থান ছিল শ্রীলঙ্কা।
গতবছরের জুলাই মাসের শেষ দিকে দেশটি পর্যটন খাত থেকে ১০০ কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে। দেশটির পর্যটন উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ জানায়, ২০২১ সালে দেশটিতে বিদেশি পর্যটক এসেছিলেন ১ লাখ ৯৪ হাজার ৪৯৫ জন। গত বছর এই সংখ্যা আরো বেড়েছে। গত বছরের জুলাই মাসেই ১ লাখ ৬ হাজার ৫০০ বিদেশি পর্যটক যায় দেশটিতে। আর ডিসেম্বরের দিকে সেখানে গিয়েছিল ৯১ হাজার ৯৬১ পর্যটক। শ্রীলঙ্কার পর্যটন মন্ত্রণালয়ের পূর্বাভাস, ২০২২ সালে পর্যটন খাত থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭০ কোটি ডলার। চলতি বছর আরও বেশি আশা করছেন বিশ্লেষকরা। শ্রীলংকা তাদের পর্যটনখাত প্রসারিত করতে পদক্ষেপ নিয়েছে। জানা গেছে, দেশটিতে মাল্টিপল-এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা ৫ বছর পর্যন্ত বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দেশটির পর্যটনমন্ত্রী জানান, শ্রীলঙ্কায় পর্যটনকে উৎসাহিত করতে ৩৫টি দেশের জন্য ৫ বছরের মাল্টিপল এন্ট্রি ট্যুরিস্ট ভিসা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে মন্ত্রীসভা। এর মাধ্যমে একজন পর্যটক ৬ মাস শ্রীলংকায় থাকতে পারবেন। পর্যটনখাত শক্তিশালী হলে দেশটিতে অর্থনীতির পুনর্জীবন ঘটবে একথা বলা যায়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পর্যটন খাত থেকে আয় বেড়েছে ২৫ শতাংশের বেশি। সেই সাথে ঋণ কাটিয়ে উঠলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। তবে এখানেই শেষ নয়। দেশটির অর্থনীতির আরও একটি বড় শক্তি হলো রেমিট্যান্স। দেশটির রেমিট্যান্স বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। বিপুল পরিমাণ শ্রমিক বিদেশে গেছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭৬ শতাংশ বেশি। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি দ্রুত শক্তিশালী হচ্ছে। এক সময় তাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি ছিল দ্রুততম। মাথাপিছু আয় ছিল ঈর্ষণীয়। তবে এখনও পথ অনেকটা যেতে হবে। বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। সেক্ষেত্রে শক্তিশালী অর্থনীতিতে ফিরতে বহুমুখী খাতেই অগ্রসর হতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
বাবু/এ.এস