চট্টগ্রাম নগরীর বহদ্দারহাট থেকে ৩য় কর্ণফুলী সেতু সংযোগ সড়কটি সারাদেশের সাথে সড়ক পথে বান্দরবন, কক্সবাজারের সাথে যোগাযোগের ব্যস্ততম সড়ক। ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই অঞ্চলে প্রথমবারের মত নির্মিত ৬ লেনের ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কের সুফল অবৈধভাবে ভোগ করছে একাধিক আন্তঃজেলা বাস সার্ভিস, অটোরিকশা ও টেম্পো স্ট্যান্ড, বিভিন্ন কমিউনিটি সেন্টার, ওজন মাপার স্কেল, গাড়ির গ্যারেজ, ভাঙারি দোকান থেকে নির্মাণ সামগ্রী বিক্রেতারা। এছাড়া এই সড়কের ক্রসিংগুলোকে নির্বিঘ্ন ও নিরাপদ করতে নির্মিত একাধিক আন্ডারপাস এখন হকারদের দখলে। সিটি সার্ভিসসহ ছোট যানবাহন চলাচলের জন্য সড়কের উভয় পাশের দুটি সার্ভিস লেন এখন সম্পূর্ণ বেদখল হয়ে গেছে। ফলে মূল সড়কে বড় গাড়িগুলোর সাথে হালকা যানবাহন চলাচল করার ফলে প্রতিনিয়ত এই সড়কে ঘটছে দুর্ঘটনা, বাড়ছে হতাহতের ঘটনা।
সিএমপির ট্র্যাফিক দক্ষিণ বিভাগ ও স্থানীয় থানা পুলিশের ভাষ্য, বারবার উচ্ছেদ করলেও দখলদাররা ঘুরে ফিরে আবারো এই সড়কেই ফিরে আসছে এবার সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাথে সমন্বয় করে সার্ভিস লেনের ছোট ডিভাইডারগুলো অপসারণ করে সড়কের শৃঙ্খলা আনার উদ্যোগ নিচ্ছে তারা। তবে অভিযোগ আছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়কের অবৈধ দখলদার ও হকারদের কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা আদায় হয়। এসব চাঁদার বড় একটি ভাগ যাচ্ছে অসাধু কিছু পুলিশ সদস্যের পকেটে। চাঁদার টাকা সংগ্রহের দ্বায়িত্ব পালন করছে ক্যাশিয়ার ও সোর্স পরিচয় দেয়া কতিপয় ব্যক্তি। টেম্পো, সিএনজি ট্যাক্সি অবৈধ স্ট্যান্ডের চাঁদাবাজির সাথে একটি কলেজ ছাত্রলীগের কতিপয় নেতা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একাধিক নেতার অনুসারীরা জড়িত বলে জানা গেছে। কার্যত পুরো সড়কটি এখন বিভিন্ন অংশে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে চাঁদা তুলছে কতিপয় রাজনৈতিক নেতা। আবার এসব চাঁদার ভাগ নিয়ে প্রায় একাধিক পক্ষ নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়াচ্ছে।
৬ লেনের এই সড়ক ধরে কর্নফুলী ৩য় সেতু হয়ে সারাদেশের পর্যটকরা বান্দরবন ও পর্যটন নগরী কক্সবাজার যাতায়াত করে। এছাড়া দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের মহেশখালী ও মাতারবাড়ি সহ বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প চলমান ও বাস্তবায়িত হওয়ায় এই সড়কে যানবাহনের চাপ বেড়েছে কয়েক গুন। অথচ ছয় লেইনের সুপ্রশস্ত এই সড়কটির প্রায় অর্ধেকটাই চলে গেলে অবৈধ দখলে। ২০১০ সালে কর্ণফুলী সেতু চালুর দীর্ঘ প্রায় নয় বছর পর নানা কাঠগড় পুড়িয়ে সরকার কুয়েত ফান্ডের অর্থ ছাড় করিয়ে এই সড়কটি নির্মাণ সম্পন্ন করে। চট্টগ্রাম নগরীর সাথে বৃহত্তর পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ বাকলিয়া এলাকার যোগাযোগের জন্যও এই সড়কটি ব্যবহার হয়। ফলে বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠী নিয়মিত এই সড়কটি ব্যবহার করে৷ কিন্তু অবৈধ দখলের কারণে এই সড়কটি দিন দিন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, দক্ষিণ চট্টগ্রামের ১৯টি রুটের বাস, মিনিবাস মূল সড়কে দাঁড় করিয়ে যাত্রী উঠানামা করা হচ্ছে। তবে ঈগল নামের একটি বাস সার্ভিসের সবচেয়ে বেশী সংখ্যক বাস এই সড়কের সার্ভিস লাইনকে নিজেদের পার্কিং করে রাখতে দেখা গেছে। রাজাখালী ব্রিজের ওপরের একাংশ সহ সংলগ্ন সার্ভিস লাইনটি এখন কয়েকটি আন্তঃজেলা বাসের স্টেশন ও কাউন্টারে পরিণত হয়েছে। আছে বেশ কয়েকটি অঘোষিত টেম্পু, ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। সড়ক দখল করে আছে অগণিত হকার, ক্ষুদে দোকানি। পাশাপাশি ঝুট কাপড়ের গুদাম ও নির্মাণ সামগ্রী রেখে চলছে বেচাবিক্রি। সেতু সংলগ্ন গোল চত্বরটিতে সব সময় জটলা লেগেই থাকে। এসব জটলা পেরিয়ে কর্ণফুলী ৩য় সেতুতে উঠতে নামতে পোহাতে হচ্ছে ভোগান্তি। এই চত্বরটির এদিকে বাস স্ট্যান্ড অপর দিকে টেম্পো স্ট্যান্ড। একাংশ দখল করে গড়ে উঠেছে এস আলম বাসের অবৈধ পার্কিং। ইতিপূর্বে এই চত্বরে একাধিক প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। সড়কটির আন্ডারপাসের বিশৃঙ্খলার কারণে রাহাত্তারপুল থেকে কেবি আমান আলী সড়কে যানজট লেগেই থাকছে। একই অবস্থা কালামিয়া বাজার আন্ডারপাসে। বাকলিয়া মিয়া খান নগর থেকে আন্ডারপাস হয়ে পূর্ব বাকলিয়া যাতায়াত করতে পড়তে হচ্ছে যানজটের কবলে। এই দুটি আন্ডারপাসে মানুষের কষ্ট-দুর্ভোগের পাশাপাশি ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটছে। এম এ মান্নান (বহদ্দারহাট) ফ্লাইওভার থেকে নেমে ৬ লেইনের এই সড়কের প্রবেশমুখে সর্বদা যানবাহনের বিপদ জনক জটলা দেখা যায়। সড়কে দুপাশ দখল করে আছে অসংখ্য ছোট বড় গাড়ি। পুরো সড়কের ফুটপাথ গুলো দোকানের মালামাল রেখে দখল করে রাখা হয়েছে ফলে পথচারী মূল মহাসড়কটি ধরে চলাচল করছে।
এই সড়কে চলাচলকারী লোকাল যানবাহনের চালক মোস্তাক হোসেন বলেন, সার্ভিস লেইন দখল হয়ে যাওয়ায় এখন মূল সড়কে যাত্রী উঠানামা করতে হয়৷ কালামিয়া বাজারের বাসিন্দা মরিয়ম সুলতানা বলেন, আন্ডারপাস দিয়ে বাচ্চাকে স্কুলে আনা-নেওয়ার করতে হয় অথচ হকার ও গাড়ির স্ট্যাণ্ড বানিয়ে ফেলায় এটি দিয়ে আমাদের চলাচলে বিঘ্ন হচ্ছে৷ আন্ডারপাশের পাশের একাধিক কমিউনিটি সেন্টারে নেই কোন পার্কিং। এসব কমিউনিটি সেন্টারে পার্কিং দূরের কথা একটি গাড়ি যে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠা নামা করাবে সেই জায়গাটুকুও ওরা রাখেনি। এসব ভবন ও কমিউনিটি সেন্টার কি ভবে অনুমোদন পায় সেটিও খতিয়ে দেখার জোর দাবি জানালেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
নগর ট্র্যাফিক পুলিশের উপ-কমিশনার এন এম নাসিরুদ্দিন নিয়মিত এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদে অভিযান চালান উল্লেখ করে বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, “কারা এসব দখল করে আছে সেসব তথ্য গণমাধ্যমে তুলে ধরুন।” তবে ডিসি ট্রাফিকের এমন বক্তব্য সত্য নয় বলে সড়কের আশপাশের বাসিন্দারা বলেন, বিগত কয়েক মাসে একটিবারের জন্য এসব বাস ও অবৈধ দখল মুক্ত সড়ক তারা দেখেনি।
এই বিষয়ে বাকলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আবদুর রহিম বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, “পুলিশ একবার গিয়ে সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সার্বক্ষণিক পুলিশ বসিয়ে রেখে হকার ও অবৈধ দখল সম্ভব নয়, এ জন্য জনসচেতনতা বেশি দরকার৷ ইতিমধ্যে আমাদের সিএমপি কমিশনার স্যারের নির্দেশে রোডস এন্ড হাইওয়েকে দুই পাশের ছোট রোড ডিভাইডার গুলো তুলে নেয়ার বিষয়ে আলাপ হয়েছে। সকল অবৈধ পার্কিং ও দখল উচ্ছেদ করতে আমার প্রতিটি ফাঁড়িকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া আছে।”