সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫ ২৩ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ৭ জুলাই ২০২৫
সন্দ্বীপ রুটে বন্ধ জাহাজ সার্ভিস : নোনা জলে মৃত্যুর হাতছানি
কামরুজ্জামান রনি, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩, ৭:১৭ PM
চট্টগ্রাম জেলার দ্বীপাঞ্চল উপজেলা সন্দ্বীপ। মূল স্থল ভাগের সাথে সড়ক পথে কোন যোগাযোগ না থাকায় ৪ লক্ষাধিক জনবসতির এই দ্বীপের বাসিন্দাদের মূল জেলার সাথে যোগাযোগের একটি মাত্র পথ হচ্ছে নৌ রুট। আর এই রুটে যাত্রীদের নিরাপদ পারাপারের জন্য আছে একটিমাত্র জাহাজ। যা গত ১০ দিন আগে থেকেই রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরিয়ে নেয়া হয়। এই জাহাজটি মেরামত হয়ে কবে ফিরে আসবে সেই দিনক্ষণ নিশ্চিত করে জানাতে পারছেনা বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। ফলে বিকল্প নৌযান হিসেবে কাঠের তৈরী ট্রলার ও স্পিডবোটে চড়ে প্রতিদিনই মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে উত্তাল সাগরে চলাচল করতে বাধ্য হচ্ছে সন্দ্বীপবাসী। তবে আবহাওয়া বৈরী হলে সেই পারাপারের পথটি বন্ধ হয়ে যায়।

২০২১ সালে সন্দ্বীপবাসীকে নিরাপদে পারাপারের জন্য প্রধানমন্ত্রী উপহার হিসেবে এমভি আইভি রহমান জাহাজটি প্রদান করেন। ৪ লক্ষাধিক জনগোষ্ঠির এই দ্বীপাঞ্চলের মানুষকে নিরাপদে নৌ পারাপারের জন্য দেয়া ৫০০ আসনের এই জাহাজটি গুপ্তছড়া-কুমিরা নৌ রুটে নিয়মিত চলাচল করতো। তবে চাহিদার তুলনায় কম যাত্রী ধারণ ক্ষমতার পাশাপাশি কুমিরা ও গুপ্তছড়া দুই ঘাটেই সরাসরি জাহাজ ভেড়ানোর সম্ভব না হওয়ায় সৃষ্ট ভোগান্তির মধ্যেও তুলনামূলক নিরাপদ যাত্রী সেবা দিয়ে যাচ্ছিলো এমভি আইভি রহমান। গত ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে জাহাজটির প্রপেলারে (পাখার) যান্ত্রিক ত্রুটি সাড়াতে ডকে নেয়া হয়। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে এতোদিন জাহাজটিকে ডক ইয়ার্ডে উঠানোর সিরিয়াল পায়নি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসির) চট্টগ্রাম এর মহা ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) গোপাল চন্দ্র মজুমদারের সাথে কথা হলে তিনি বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, কুমিরা-গুপ্তছড়া নৌ রুট থেকে জাহাজটিকে ডকে নিয়ে আসলেও এতদিন ডকইয়ার্ড খালি না থাকায় উঠাতে পারেনি। গত ২৪ সেপ্টেম্বর জোয়ারের সময় এটিকে ডকে উঠানো হয়েছে। ডকে সিরিয়াল না পেলে কেন ১০ দিন আগেই এটিকে সরিয়ে নেয়া হলো জানতে চাইলে তিনি জানান, “জাহাজের প্রপেলারের (পাখা) কন্ডিশন খুব খারাপ ছিলো। একেবারেই খুলে পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা। তাই আমরা খুব সতর্কতার সাথে এটিকে ধিরে সুস্থে চালিয়ে ডকে নিয়ে আসি।”
 
এদিকে জাহাজ না থাকায় প্রতিদিন উত্তাল সাগরে বিকল্প নৌযানে পারাপারের জন্য অপেক্ষায় থাকে অন্তত কয়েক হাজার যাত্রী। তবে সাগর উত্তাল থাকলে যাত্রী পারাপার বন্ধ থাকে ফলে বিগত ১০ দিনে একাধিক দিন নৌ পারাপার বন্ধ ছিল। ফলে জরুরী কাজ, চিকিৎসা সহ আদালতের কার্যক্রমে উপস্থিতি থাকতে পারছেনা সন্দ্বীপের বাসিন্দারা।

সন্দ্বীপ পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক গাজন ফারুক হক খান চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম আসতে অন্তত দুই দিন গুপ্তছড়া ঘাটে অপেক্ষায় থেকে অবশেষে বাড়ী ফিরতে বাধ্য হ। তিনি মুঠোফোনে জানান, ২ দিন ভোরে ফজরের নামাজের পর স্ত্রীসহ চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম যেতে  গুপ্তছড়া ঘাটে অপেক্ষায় করেছিলাম। সাগর উত্তাল থাকায় এই রুটে দুইদিন স্পীডবোট ছাড়েনি। আর বর্তমানে জাহাজটি না থাকায় দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থেকে বাড়ী চলে আসি। সন্দ্বীপের এক যুবক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন, চট্টগ্রামের আদালতে আমার হাজিরার ধার্য্য তারিখ ছিল। আমি একদিন আগের দিন থেকেই পার হওয়ার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আদালতে হাজির হতে পারিনি। ফলে আদালত আমার জামিন বাতিল করে ওয়ারেন্ট ইস্যু করে দিয়েছেন। এখন এই জটিলতার দায় আমাকেই বহন করতে হবে অথচ আমি আদালতে যেতে দুই দিন যাবৎ চেষ্টা করেছি।

জাহাজটি কবে নাগাদ ফিরবে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসির) চট্টগ্রাম এর মহা ব্যবস্থাপক (বাণিজ্য) গোপাল চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, যদিও এসব আমাদের প্রকৌশলীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে যতটুকু জেনেছি জাহাজটির পাখা (প্রফেলার) এর টিউব যে ডায়ারে বসে সেটা ছোট, সেটা স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় করে দিয়ে বুস বসাতে হবে। এখন পর্যন্ত কত সময় লাগতে পারে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। তবে দ্রুততম সময়ে কাজ শেষ করে এটিকে সার্ভিসে ফেরানো হবে।

সন্দ্বীপের ভোগ্য পণ্যের পাইকারি ব্যবসায়ী ওমর ফয়সাল বলেন “সন্দ্বীপ নৌ রুটে একটি মাত্র জাহাজ এমভি আইভি রহমান প্রতি মাসে তেলের জন্য গেলে ১ দিন বন্ধ থাকে। এছাড়া জাহাজটি দেখা যায় প্রায় দুই তিন মাস পর পর মেরামতের ডকইয়ার্ডে যায়। এতে করে সন্দ্বীপের যাত্রীদের অনিরাপদ কাঠের ট্রলার ও স্পিড বোটে চড়ে ঝুঁকি নিয়ে নৌ পারাপার করতে হয়।” সন্দ্বীপের মানুষের দাবি এ নৌরুটে একাদিক জাহাজ  রাখা হলে ভোগান্তি ও  ঝুঁকিমুক্ত যাতায়াত করার সুযোগ পাবে দ্বীপের বাসিন্দারা। জাহাজ যখন তেল সংগ্রহ বা মেরামত করতে যাবে সেটার পরিবর্তে যাতে অন্তত আরেকটি জাহাজ চালু রাখে সেই দাবিও করেছে যাত্রীরা।

সূর্য ডুবলেই বন্ধ পারাপার
সন্দ্বীপে সূর্য ঢুবলে পরিবেশ যেমন অন্ধকারে ডুবে যায় সন্দ্বীপের মানুষের জীবন যাত্রাও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। কারণ সূর্য ডোবা মানেই নৌ পারাপার বন্ধ। অসুস্থ কোন রোগীকে জরুরী চিকিৎসার জন্য সন্দ্বীপ থেকে অন্যত্র নিতে হলে সেটা করতে হবে দিনের আলো থাকা কালে। গুরুতর অসুস্থ রোগীকে তাই অনিশ্চয়তা নিয়ে অপেক্ষায় থাকতে হয় সূর্য উদয়ের। গত ছয় মাসে অন্তত ৫ জন সাপে কাটা রোগীর মৃত্যু হয়েছে যথা সময়ে এন্টি ভেমন দিনে না পারার কারণে। এসব হতভাগ্য ব্যক্তিদের স্বজনদের ভাষ্য, রাতে কূল পার হতে না পারায় সাপের কাটা রোগীকে ইনজেকশন দিতে না পারায় তাদের মৃত্যু হয়েছে।

ভোগান্তির শেষ কোথায়? 
সন্দ্বীপে যাতায়াত মানেই ভোগান্তি। জাহাজে যাতায়াত নিরাপদ হলেও বিপদ কিন্তু সেখানেও পিছু ছাড়ে না। গুপ্তছড়া ও কুমিরা ঘাটে জাহাজ ভেড়ানো যায় না ফলে স্থানীয় লাল বোটে করে যাত্রীদের জাহাজে উঠা-নামা করানো হয়। যাত্রীদের জাহাজে উঠা-নামা বাবদ ৪০ টাকা করে আদায় করা হলেও এসব লাল বোটগুলোতে থাকেনা কোন নিরাপত্তা সরঞ্জাম। উত্তাল সাগরে জাহাজে যাত্রীদের উঠানো ও নামানোর সময় দুর্ঘটনার শিকার হতে হয়। ২০১৭ সালে এই লাল বোট ডুবির ঘটনায় ১৮ জন নিহত হয়। লাল বোটে নিরাপদে ঘাট অব্দি পৌছালেও ভোগান্তি শেষ হয় না সন্দ্বীপবাসীর। যদি জোয়ার না থাকে তাহলে কুমিরা ঘাটের অনেক দূরেই লাল বোট থেকে কাদা মাটিতে নামতে হয় যাত্রীদের। হাটু পর্যন্ত কাদা মাড়িয়ে তারপর কূলে উঠে যাত্রীরা। এই কাদায় অসুস্থ ও নারী-শিশুদের সবচেয়ে বেশী দুর্ভোগের শিকার হতে হয় বলে জানান স্থানীয় সংবাদকর্মী খাদেমুল ইসলাম।  তিনি আরো বলেন, “এই লাল বোট যেমন ইচ্ছা তেমন চালায়। ২০১৭ সালে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত কেউ ক্ষতিপূরণ পায়নি।”

সন্দ্বীপের মূল ভূখন্ডের সাথে দ্রুত যাতায়াতের জন্য বেশ আগে থেকেই সন্দ্বীপ রুটে যাতায়াত করছে একঝাঁক স্প্রিড বোট। ২০১২ সাল থেকে একক নিয়ন্ত্রনে চলাচল করা এই স্প্রিড বোটগুলোর চালকদের কোন প্রকার সনদ না থাকলেও এসব দ্রুতগতির নৌ যানে ২২ জন যাত্রী পরিবহন করা হয়। টিকেটের গায়ে কোন টাকার অংক লিখা না থাকলেও একবার পার হতে গুনতে হয় ৩৮০ টাকা। কেন কিভাবে এই ভাড়া নির্ধারণ হয়েছে সেই উত্তর জানায় না স্প্রিড বোটগুলোর মালিক মগধরা ইউপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন। সন্দ্বীপ রুটে যাত্রী পারাপার নিয়ে প্রতিবেদন তৈরীর সময় উঠে আসে সন্দ্বীপের নৌ রুটের যাত্রীদের অনেকটা জিম্মি করে স্বেচ্ছাচারিতা করছে আনোয়ার হোসেন। শুধু যাত্রীদের কাছ থেকেই ইচ্ছেমত ভাড়া আদায় করছে তাই নয়, চট্টগ্রাম জেলা পরিষদকে ন্যায্য পাওয়া পরিশোধ করছেনা সন্দ্বীপ নৌ রুটের এই একক অধিপতি। অন্য কোন প্রতিষ্ঠান যাতে এই রুটে যাত্রী পরিবহন করতে না পারে তাই নানান অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছে এই আনোয়ার হোসেন। স্থানীয় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন রিতীমত জেলা পরিষদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সন্দ্বীপ নৌরুটের একক সাম্রাজ্য বজায় রেখেছেন। এই বিষয়ে তার নাম্বারে একাধিকার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেনি। এসএমএস করে প্রশ্ন পাঠানো হলেও তিনি কোন জবাব দেন। এই বিষয়ে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য নিয়ে আগামীকাল প্রকাশিত হবে “সন্দ্বীপ নৌ রুটে চলছে আনোয়ার রাজত্ব”।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত