বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫ ২৬ আষাঢ় ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১০ জুলাই ২০২৫
বঙ্গবন্ধুর শিক্ষানীতি ও আজকের অবস্থা
ড. মো.শফিকুল ইসলাম
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ অক্টোবর, ২০২৩, ৫:২৪ PM

শিক্ষা একটি জাতির উন্নতির মূলমন্ত্র, শিক্ষা ব্যতীত কোনো জাতিই এগিয়ে যেতে বা উন্নতি করতে পারে না। এই বিষয়টি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষানীতি ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার পরিবর্তিত হয়।কারণ পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকদের প্রবর্তিত শিক্ষা কমিশনগুলোতে যে শিক্ষানীতি অনুসরণ করা হয় সেগুলো মানুষের জীবনযাত্রা বা মূল্যবোধ বিরোধী ছিল। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন যার ফলস্বরূপ। বঙ্গবন্ধু তাই বরাবরই এই শিক্ষা কমিশন বা শিক্ষানীতিগুলোর বিরোধী ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর শিক্ষার প্রতি কতটুকু শ্রদ্ধা এবং ভাবনা ছিল তা আমরা তার বিভিন্ন বক্তৃতা এবং ঘোষনার মাধ্যমে বুঝতে পারি। যেমন-১৯৭০ সালে তিনি নির্বাচনের আগে একটি ভাষণে বলেছিলেন সুষ্ঠু সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য শিক্ষাখাতে পুঁজি বিনিয়োগের চেয়ে উৎকৃষ্ট বিনিয়োগ আর কিছুই হতে পারে না।

কত গুরুত্বপূর্ণ কথা। যা এখন অনেক সরকারি কর্মচারী বা রাজনীতিবিদেরা বুঝতে চাই না। যদি বুঝতে, তাহলে শিক্ষার আজ এই অবস্থা তৈরি হতো না। যদিও সরকার প্রধান চেষ্টা করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু ওই একই ঘোষনায় আরোও বলেন নিরক্ষরতা অবশ্যই দূর করতে হবে। আর তার জন্য পাঁচ বছর বয়সি শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে। তিনি বলেছিলেন উচ্চশিক্ষার পথে দরিদ্র যেন বাধা না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। এই ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পরপরই তিনি এগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেন। যা ছিল যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত।

বঙ্গবন্ধুর গৃহীত শিক্ষানীতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়Ñ ১৯৭১ সালে তিনি একটি ঘোষনার মাধ্যমে তিনি মার্চ-ডিসেম্বরের শিক্ষার্থীদের সকল বেতন মৌকুফ করেন, শিক্ষকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের সময় ক্ষতিগ্রস্ত স্কুল, কলেজ এবং মাদরাসার অবকাঠামো পূর্ননির্মাণ করেন। জাতীয় সংবিধানে শিক্ষা সম্পর্কিত অনুচ্ছেদ যুক্ত করার মাধ্যমে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হিসেবে যুক্ত করেন। যা ছিল খুবই ইতিবাচক সিদ্ধান্ত।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৭, ১৮ এবং অনুচ্ছেদ ২৮(৩), ৪১(২) অনুযায়ী শিক্ষাকে বাধা নিরপেক্ষ ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে উল্লেখ করেন। ১৯৭২-৭৬ এ প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ঘোষিত হয় যার অধিকাংশ ভাগিই ছিল শিক্ষা প্রসারের জন্য। ১৯৭২ সালের ৩০ জুন প্রথম ঘোষিত বাজেটে প্রতিরক্ষাখাতের বরাদ্দ ছিল ৪০ কোটি টাকা কিন্তু শিক্ষাখাতে বরাদ্দ ছিল ৪৩ কোটি টাকা,যার থেকে এটি স্পষ্ট যে বঙ্গবন্ধু প্রতিরক্ষার চেয়ে অধিকতর গুরুত্ব দিয়েছেন শিক্ষাকে। এখন শিক্ষাখাতে বরাদ্দকৃত বাজেট পর্যাপ্ত নয়। এই খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রকৃত অর্থেই বাংলার বন্ধু তিনি সব সময়েই বাংলাদেশের ও বাঙ্গালী জাতির উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর শাসনামলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই বিতরণ করা হত, নারীশিক্ষা এবং মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতিও তিনি সমান গুরুত্ব দেন এবং মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড গঠন করেন। তাঁর নেতৃত্বে ১৯৭২ সালে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট  ড. কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হয় এবং রিপোর্ট পেশ করা হয়। এই শিক্ষা কমিশনে বাংলা ও বাঙ্গালী জাতির চিরায়ত সংগ্রাম সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ অক্ষুণ্ন রেখে প্রণয়ন করা হয়। এই কমিশনের রিপোর্টে বিভিন্ন বিষয়ে উন্নতির জন্য আবেদন করা হয় এবং বঙ্গবন্ধুকে এটি দেখার অনুরোধ করা হয়। জরুরি।  কিন্তু তিনি বলেন যে রিপোর্ট আমার শিক্ষকেরা তৈরি করেছেন তাতে দোষ ধরার ক্ষমতা আমার নেই। তার এই বক্তব্যের মাধ্যমে বুঝা যায় তিনি শিক্ষকদের কতটুকু শ্রদ্ধা করতেন। তিনি চেয়েছিলেন শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি থাকবে স্বতঃফূর্ত ও স্বাধীন। বর্তমানে শিক্ষানীতি ২০১০ এখনও চূড়ান্ত অনুমোদন পাইনি। যা বাস্তবায়ন করা

বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের ১৯৭৪ সালে প্রথম বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন করেন বঙ্গবন্ধু তিনি সেখানে উদ্বোধনী ভাসনে শিক্ষার উদ্দেশ্য ও নারী শিক্ষা সম্বন্ধে বলেন, “শতকরা ২০ জন শিক্ষিতের দেশে নারীর সংখ্যা আরও নগণ্য। ... ক-খ শিখলেই শিক্ষিত হয় না, সত্যিকারের আলোকপ্রাপ্ত হইতে হইবে।” তিনি সব সময়ই চেয়েছেন বাংলার মানুষ সু-শিক্ষায় শিক্ষিত হোক। কারিগরি শিক্ষা, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য তিনি এইক্ষেত্রগুলোতে বেশি বেশি গবেষণা করার পরামর্শ দেন এবং এবিষয়ে বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

একটি কার্যকর শিক্ষা কমিশন গঠন, ৪টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বায়ত্তশাসন প্রদান এবং বিশ্ববিদ্যালয মঞ্জুরি কমিশন গঠন এই তিনটি পদক্ষেপ ছিল তাঁর আমলে যুগান্তকারী এবং প্রশংসনীয়। এছাড়াও তাঁর আমলে শিক্ষা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ ২টি আইন পাশ হয়। সেগুলো হল প্রাইমারি এডুকেশন অ্যাক্ট ১৯৭৪ এবং মাদ্রাসা এডুকেশন অ্যাক্ট ১৯৭২। স্বাধীনতার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেক বাধ্যবাধকতা ছিল শিক্ষকরা ইচ্ছে করলেই সামাজিক বা নানাবিধ সমস্যা  নিয়ে ক্লাস এ আলোচনা করতে পারতেন না। যার জন্য শিক্ষা প্রকৃতঅর্থে বিশ্বের সাথে সমান গতিতে এগিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসিত ঘোষণার পর এর শিক্ষার মান উন্নয়ন হয় এবং বিশ্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগতভাবে চাইতেন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব নীতিতে চলুক এবং পড়ালেখা হোক স্বাধীন। কিন্তু এখন সমাজের কিছু লোক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই।

তিনি শিক্ষার সাথে সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের প্রতিও ছিলেন শ্রদ্ধাশীল। ১৯৭৪ সালে ১ম সাহিত্য সম্মেলনে তাঁকে প্রধান অতিথি হিসেবে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি পল্লী কবি জসিমউদদীন ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর নাম উল্লেখ করেন। একই সাথে তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কত মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। যেহেতু তিনি একটি জাতির উত্থানের সাথে জড়িত ছিলেন তাই তিনি সবসময় তাঁর দেশের মঙ্গলের কথা ভেবে গেছেন। দেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে যে সকল বিষয় তাকে ভাবিয়েছে তার মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। বঙ্গবন্ধু যেসকল শিক্ষা নীতি গ্রহন করেছিলেন তাতে সমাজ, জ্ঞান ও মূল্যবোধ ছিল একই সূত্রে গাঁথা।

তিনি শুধু উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেই নয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষার ক্ষেত্রেও নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাঁর আমলে ১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ৪০ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়। শিক্ষকদের সম্মানী ও ভাতা বৃদ্ধি করা হয়। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে সমাজ পরিবর্তন বা উন্নয়নের হাতিয়ার হিসাবে কল্পনা করতেন। ১৯৭১ সালের ১০ জানুয়ারী এক বিদেশি সাংবাদিক প্রশ্ন করেন কেন আপনি বাংলাদেশকে সোনার বাংলা বলে চিহ্নিত করেন? যেখানে আসলে কোন সোনা বা দামী সম্পদের খনি নেই? তখন জবাবে তিনি বলেন, “আমার বাংলার মাটি আছে মানুষ আছে। আমি বাংলার মাটি ও মানুষকেই সোনা বলে মনে করি। দেশের ৭ কোটি মানুষ খনিজ সম্পদের চেয়েও বড় সম্পদ এই মানব সম্পদই একদিন এই দেশকে উন্নতির শীর্ষে নিয়ে যাবে।” যা আজ সত্যি।  মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করতে আরবির পাশাপাশি বাংলা, ইংরেজি, গণিতকে আবশ্যিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে এই দেশের শিক্ষা নীতিকে পুনরায় পিছিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু তার সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে আবার তা পুনরুজ্জীবিত হয় এবং উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন এবং শিক্ষার হার ৭৪.৬৬ শতাংশে উন্নতিকরণ তাঁরই সুযোগ্য নেতৃত্বের ফলস্বরূপ। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা এবং সুযোগ্য নেতৃত্বে আমরা যে স্বাধীনতা লাভে সক্ষম হয়েছিলাম তা টিকি রাখতে তার শিক্ষানীতি বা রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনা ছিল সুদূরপ্রসারী এবং যুগোপযোগী।

লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

বাবু/এ.এস

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত