শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫ ৬ আষাঢ় ১৪৩২
শুক্রবার ২০ জুন ২০২৫
বঙ্গবন্ধুর নামে আন্তর্জাতিক শান্তি পুরস্কার চালু হোক
মো. তাঈদ উদ্দিন খান
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর, ২০২৩, ৪:৪১ PM
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ২৩ মে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার গ্রহণ করে বলেছিলেন, ‘উপনিবেশবাদী শাসন আর শোষণের নগ্ন হামলাকে প্রতিহত করে ৩০ লাখ মানুষের প্রাণের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি জাতীয় স্বাধীনতা। তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে শান্তি আর স্বাধীনতা একাকার হয়ে মিশে আছে। আমরা মর্মে মর্মে অনুধাবন করি বিশ্বশান্তি আর আঞ্চলিক স্বাধীনতার অপরিহার্যতা।’ তিনি বিশ্বশান্তি আন্দোলনে যুক্তদের সহকর্মী হিসেবে অভিহিত করে আরো বলেন, ‘এ সম্মান কোনো ব্যক্তিবিশেষের নয়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মদানকারী শহীদদের, স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সেনানীদের।’ বঙ্গবন্ধুর শান্তি দর্শনের মূল সারাংশ এখানেই নিহিত।

একটু পেছনে তাকানো যাক। ১৯০১ সালে যখন নোবেল পুরস্কার চালু হয়, সবাই ভেবেছিলেন সাহিত্যে লিও টলস্টয়ের পুরস্কার নিশ্চিত। কিন্তু, পেলেন সুলি প্রুধোম নামের এক ফরাসি কবি। যিনি ফ্রান্সেই অখ্যাত। টলস্টয় আর পেলেন না। টলস্টয় জীবনকালে অত্যাধিক জনপ্রিয় ও মেধাবী ছিলেন। টলস্টয় ১৯০২ থেকে ১৯০৬ পর্যন্ত প্রতিবারই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য এবং ১৯১০ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। কিন্তু একবারও নোবেল পাননি। যা নোবেল ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা। রাশিয়ান সাহিত্যের যুগশ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের একজন টলস্টয়। ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছেন, ‘টলস্টয় নিজেই একটি পৃথিবী।’ নোবেল পুরস্কার পাননি ফিওদর দস্তয়েভস্কি, ম্যাক্সিম গোর্কির মতো কথাশিল্পীরাও। মার্কিন কবি রবার্ট ফ্রস্টও পাননি। বাঙালিদের জন্য প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ও পতাকা এনে দেওয়া শেখ মুজিবুর রহমানকেও নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়নি। নোবেল পাননি মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীও (মহাত্মা গান্ধী), যার আরেক নাম শান্তিবাদী। ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি হত্যা করা হয় ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীকে। এর মাত্র দুইদিন পরই ছিল সে বছরের নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন জমাদানের শেষ তারিখ। সেবার নোবেল কমিটি গান্ধীকে মনোনীত করা ছয়টি চিঠি পায়, যার মধ্যে ছিল প্রাক্তন নোবেল লরেট দ্য কোয়েকার্স এবং এমিলি গ্রিন বলচের চিঠিও।

ইতোপূর্বে নোবেল শান্তি পুরস্কার মরণোত্তর কাউকে দেওয়া হয়নি। কিন্তু নোবেল ফাউন্ডেশনের তৎকালীন সংবিধি অনুযায়ী, কয়েকটি শর্ত মেনে মরণোত্তর শান্তিতে নোবেল দেওয়া যেত। ফলে গান্ধীকে নোবেল দেওয়ারও রাস্তা খোলা ছিল। কিন্তু তারপরও নোবেল কমিটি সে বছর গান্ধীকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেয়নি। পাঁচবার নোবেল পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হন গান্ধী। ১৯৪৬, ১৯৪৭, ১৯৪৮ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে দুবার। পাকিস্তানের বিখ্যাত ফ্রি অ্যাম্বুলেটরি সার্ভিসের জনক আব্দুল সাত্তার ইদিকেও নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। অন্যদিকে পাশের দেশ ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা দিলীপ কুমার ইউসুফ খানকে ভারতরত্ন সম্মাননা দেওয়া হয়নি। অমিতাভ বচ্চন আজো পাননি এই সম্মাননা। আরো পাননি সুরসম্রাট উস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সাহেব।

আমরা সবাই জানি স্বীকৃতি ও পুরস্কার আপেক্ষিক। বার্ট্রান্ড রাসেলকে নোবেল দেওয়া হলেও ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি পুরস্কারের জন্য লিখি না।’ ভিয়েতনামের সাবেক প্রেসিডেন্ট লি ডাক থু শান্তিতে নোবেল পেয়েও নেননি। তিনি বলেছিলেন, ‘শান্তি কোথায় ভিয়েতনামে!’ আর নিকট অতীতের বব ডিলানের কাহিনী তো আজ বিশ্বশ্রুত!

লেখক-সাহিত্যিক জাঁ-পল সার্ত্র ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হন। কিন্তু তা প্রত্যাখান করতে গিয়ে যে দু-চারটি বাক্য খরচ করেন, তাতেই উপলব্ধি করা যায়, তার ব্যক্তিত্বের আকাশচুম্বী গভীরতা। জাঁ-পল সার্ত্র বলেন, ‘লেখকরা সমগ্র পৃথিবীর, তাদের কোনো প্রতিষ্ঠানের হওয়া উচিত নয়।’ বছর দশেক আগে পশ্চিমবঙ্গে এক অসাধারণ ঘটনার জন্ম দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অমর কবি আল্লামা ইকবালকে মরণোত্তর সম্মাননা জানিয়েছিলেন তিনি। তারানা ই হিন্দ এবং তারানা ই মিলি রচনার কারণে তাকে এই সম্মাননা জানানো হয়েছিলো প্রায় শতবর্ষ পর। নিঃসন্দেহে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। ভারতে এরকম দৃষ্টান্ত আরো আছে। জিন্নাহর জীবনী লিখে বিজেপি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন বাজপেয়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিং।

ফেরা যাক শুরুর প্রসঙ্গে, বঙ্গবন্ধু জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার লাভ করেন ১৯৭৩ সালে। আর এই পুরস্কার ঘোষিত হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১০ অক্টোবর। সেদিন ছিলো বঙ্গবন্ধুর বিশ্বনেতা হয়ে ওঠার দিন। জানা মতে, প্রেস ইন্সটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ ও এমনতর কিছু কিছু মানুষ ছাড়া আর কাউকেই দিবসটিকে স্মরণ করতে দেখিনি। এ বিষয়ে একটি গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, যা দেখে আমরা আশাবাদী হতে পারি।

সামগ্রিক বিষয়, নোবেল পুরস্কার ও দেশ-বিদেশের আরো মানসম্মত পুরস্কার পাওয়া না পাওয়া, গ্রহণ-বর্জন এবং নানা আলোচনা দেখে আমার মনে একটি ভাবনার উদয় হয়েছে। খোলাসা করেই বলি, বঙ্গবন্ধুর নামে 
Mujib World Peace Prize (মুজিব ওয়ার্ল্ড পিস প্রাইজ) চালু করা যেতে পারে। যেটি দেওয়া হবে প্রকৃত মানুষকে। তাহলেই বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি ও দর্শন বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিতি পাবে। ১৯৭১-কে সামনে রেখে এই পুরস্কারের অর্থমূল্য হবে ১৯ লাখ ৭১ হাজার টাকা আর মেডেলের ওজন হবে ৭১ গ্রাম আঠারো ক্যারেট স্বর্ণের। প্রতিবছর বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ শান্তিবাদী নেতা অথবা শিক্ষাবিদ অথবা দার্শনিককে এই সম্মাননায় ভূষিত করা যেতে পারে। যারা স্বীয় ক্ষেত্রে এক একজন যুগস্রষ্টা; কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র কিংবা পৃথিবী ওইভাবে তাদের কীর্তি সম্পর্কে অবগত নন। আসলে তাদের কেউ ওইভাবে খুঁজতেও যায় না। তারাও কোনোপ্রকার খুঁজের ধার ধারে না। তারা কাজ করে যান পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য। মুজিব ওয়ার্ল্ড পিস প্রাইজ হবে তাদের জন্য। তবেই কেবল আমাদের জাতির পিতাকে প্রকৃতভাবে জানতে আগ্রহী হবে বিশ্ব।

লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা দায়েরকারী

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত