সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫ ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২
সোমবার ২৮ জুলাই ২০২৫
ফিলিস্তিন এবং পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতি
ড. ফরিদুল আলম
প্রকাশ: শনিবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৩, ৩:১৯ PM
ইসরায়েলের তরফে জানানো হয়েছে, তারা হামাসকে নির্মূল করবে এবং তাদের ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেবে। অথচ গাজার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকাগুলো তারা একের পর এক বোমা হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করছে। এ পর্যন্ত ফিলিস্তিনে যতজন নিহত হয়েছে, তার শতকরা ৬০ ভাগের বেশি নারী ও শিশু। অবস্থাদৃষ্টে স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, হামাসের বিরুদ্ধে অভিযানের নাম করে তারা ফিলিস্তিনের নিরীহ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে।

একেকটি হাসপাতাল যেন মর্গে পরিণত হয়েছে! গাজার চিকিৎসাসেবা পুরো ধসে পড়েছে। ৭০ শতাংশ আহত মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা না পেয়ে যন্ত্রণায় কাতর হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। একটি রাষ্ট্র কর্তৃক এবং যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা পৃষ্ঠপোষকতায় এমন নৃশংসতা কি মানবজাতি আগে দেখেছে কখনো? এর উত্তর ‘না’। ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে যেভাবে একের পর এক ইসরায়েলি বর্বরতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছিল, এর পরিণতিতে বর্তমানের এই বর্বরতা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাপিয়ে গেছে।

গাজার আশ্রয়শিবিরগুলো পর্যন্ত এই নির্মমতা থেকে রেহাই পায়নি। জাবালিয়া আশ্রয়শিবিরে ৪৫ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে দুই মাস বয়সী এক শিশু রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের কথা বলে আসা পশ্চিমা শক্তিগুলো নির্বিবাদে সব কিছুই মেনে নিচ্ছে। আর সেই জোরে ইসরায়েল গলা উঁচু করে বলছে, গাজাকে তারা মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেবে, যেন এক ধরনের বৈধতা তারা পেয়ে গেছে।

পরিস্থিতি যদি এই ধারায় চলতে থাকে, তাহলে যা অনুমান করা যাচ্ছে তা হলো, ইসরায়েল খুব শিগগির গাজা ভূখণ্ডকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করে এর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেবে।

সার্বিক পরিস্থিতির এই অবনতির প্রেক্ষাপটে কয়েক দিনের নীরবতা ভেঙে প্রতিক্রিয়া জানানো শুরু করেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে বসে বসে প্রতিবেশী দেশগুলো দর্শকের মতো এসব দেখবে না বলে এরই মধ্যে হুঁশিয়ারি করে দিয়েছেন ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে গাজার উত্তরাঞ্চলের লোকদের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে সরে যাওয়ার নির্দেশনার জবাবে সৌদি আরব ও কাতারের পক্ষ থেকে এটিকে একটি অযৌক্তিক প্রস্তাব বলে অভিহিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে তারা গাজা থেকে অবরোধ প্রত্যাহার এবং অধিবাসীদের আন্তর্জাতিক ও মানবাধিকার আইন অনুযায়ী পূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে।

সেই সঙ্গে গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন মানুষের জন্য ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। গাজার বাসিন্দাদের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত করাকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের পরিপন্থী বলেও জানানো হয়েছে। ফিলিস্তিনের বাইরে সিরিয়া, লেবাননসহ আরো কয়েকটি দেশ লক্ষ্য করে ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়েছে, যা প্রকারান্তরে আরো কয়েকটি দেশকে যুদ্ধে যোগদানে আমন্ত্রণের পর্যায়ে পড়ে। এহেন পরিস্থিতিতে যুদ্ধটি আগামী দিনগুলোতে শুধু হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবেÑ এ রকম কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহী রণতরি নিয়ে ইসরায়েলের সমর্থনে এগিয়ে আসা, অস্ত্র সরবরাহ—এসবের বিপরীতে চীন, রাশিয়া ও ভারতের পক্ষ থেকে সতর্ক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, যেখানে একটি পৃথক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যুদ্ধবিরতি দিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সহজ কথায় ব্যাখ্যা করতে গেলে বোঝা যায়, আজকের এই পরিস্থিতির জন্য ইসরায়েলের একগুঁয়েমি আচরণ দায়ী।

ফিলিস্তিন এবং পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতিআমরা প্রতিদিন গাজার রক্ত ঝরতে দেখছি। ইসরায়েল যেন রক্তের হোলিখেলায় মেতে উঠেছে। তাদের এই আচরণে (যেমনটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে) মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো কতটা এবং কত দিন নীরব থাকবে সেটা নিয়ে সংশয়ের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এরই মধ্যে সৌদি আরব তার অবস্থান জানানোর পাশাপাশি ২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ক স্বাভাবিক করা সংক্রান্ত ‘আব্রাহাম অ্যাকর্ড’-এর আলোকে আলোচনা স্থগিত করেছে। একই চুক্তির আওতায় প্রতিবেশী দেশ মরক্কো, বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়েছে। এর বিনিময়ে ইসরায়েল ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় নতুন করে ভূমি দখল এবং বসতি স্থাপন বন্ধ রাখবে বলে অঙ্গীকার করেছিল। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল তার প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার পরিণতিতে উল্লিখিত দেশগুলো যদি চুক্তি থেকে সরে যায়, তাহলে অবাক হওয়ার মতো কোনো কারণ থাকবে না। সৌদি আরব সম্প্রতি এই চুক্তির কাছাকাছি গিয়েও বর্তমান সংকটের প্রেক্ষাপটে এটা থেকে সরে এসেছে, যা এই বার্তা দেয় যে এই মুহূর্তে ইসরায়েলকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, অদূর ভবিষ্যতে মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি আলোচনাসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে এর বিরূপ প্রভাব অবশ্যম্ভাবী।

দুই পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার জেরে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এর প্রশমনে কোনো উদ্যোগ লক্ষণীয় হয়নি, উপরন্তু এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন ইসরায়েল সফর করে সে দেশের সরকার ও সাধারণ মানুষকে এই মর্মে সমবেদনা জানিয়ে গেছেন যে যত দিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্তিত্ব থাকবে, তত দিন তারা ইসরায়েলের পাশে থাকবে। উল্লেখ্য যে ব্লিনকেনের সফরের আগেই ইসরায়েলের উদ্দেশে একাধিক মার্কিন বিমানবাহী রণতরি ভূমধ্যসাগরে এসে পৌঁছায় এবং সফরের শেষে আরেকটি বিমানবাহী রণতরি ভূমধ্যসাগরের উদ্দেশে তারা প্রস্তুত রেখেছে বলে জানা যাচ্ছে। এর পরপরই সর্বশেষ সংবাদে জানা যায়, গাজা সীমান্তে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে কয়েক লাখ সেনা সমাবেশ করা হয়েছে এবং বিমান, স্থল ও নৌপথে হামলার ছক কষছে তারা। শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ নয়, লেবানন ও সিরিয়ায় কয়েক দফা বোমা হামলা চালিয়েছে তারা। জবাবে এই দেশ দুটি থেকেও ইসরায়েলের দিকে হামলা চালানো হয়েছে। বিষয়টি থেকে যা অনুমান করা যাচ্ছে, এরই মধ্যে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের কিছুটা আলামত স্পষ্ট হয়েছে। ইরানের পক্ষ থেকে সর্বশেষ প্রতিক্রিয়ায় তারা হামাসকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মতো তথাকথিত মানবতার ধ্বজাধারী রাষ্ট্র যদি দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলের আগ্রাসনকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে যেতে পারে, তাহলে ইরানের দিক থেকে ফিলিস্তিনের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টার ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষকতায় তো কোনো দোষ হওয়ার কথা নয়। অন্যদিকে অ্যান্টনি ব্লিনকেন তাঁর সফরে কথা বলেন ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের শাসক মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে। এই যুদ্ধে পশ্চিম তীরকে শান্ত রাখতে ব্লিনকেন মাহমুদ আব্বাসকে অনুরোধ করেন। সেই সঙ্গে পশ্চিম তীর থেকে সম্ভাব্য বিদ্রোহ রুখতে ইসরায়েলি বাহিনী শত শত চেকপোস্ট বসিয়েছে, যা থেকে পরিষ্কার হয় যে সব সম্ভাব্য প্রতিরোধের পথ আটকে তারা একতরফাভাবে গাজার অধিবাসীদের ওপর তাদের ঘৃণ্য জিঘাংসা চরিতার্থ করতে চায়। এ ধরনের অবস্থা ইসরায়েল চালিয়ে যাবে আর চুপ থেকে মারা পড়বে ফিলিস্তিনের মানুষ, বিষয়টি কত দিন চলবে, সেটি নিয়ে শঙ্কা রয়েছে বিশ্লেষকদের মনে। আর এ থেকে ধারণা করা যেতেই পারে যে যুদ্ধের মাত্রা আরো ব্যাপকতর হতে পারে।

এদিকে এই যুদ্ধ কত দিন ধরে চলতে পারে, এর কী কী প্রভাব পড়তে পারে—এই সব কিছু নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এরই মধ্যে জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ আমদানি পণ্যের দর আরেক দফা বেড়েছে। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে এর প্রভাব শুধু আমাদের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে নয়, বরং উন্নত দেশগুলোতেও অনেক নেতিবাচকভাবে পড়বে। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমারা প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধে ইউক্রেনকে ব্যাপক মাত্রায় আর্থিক এবং সমরাস্ত্রের সমর্থন দিয়ে আসছে। হঠাৎ ইসরায়েলের মতো ঘনিষ্ঠ মিত্রের সহযোগিতায় এগিয়ে আসাকে তারা ইউক্রেন যুদ্ধে সম্পৃক্ততার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। সেই দিক দিয়ে আগামী দিনগুলোতে ইউক্রেনে অর্থ এবং অস্ত্র সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে তারা মধ্যপ্রাচ্যে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে মরিয়া থাকবে। যে মানবিক বিবেচনায় তারা ইউক্রেনকে সমর্থন দিয়ে আসছিল, এর উল্টো অর্থাৎ ফিলিস্তিনিদের মানবিক বিপর্যয়ের কারণ ইসরায়েলের প্রতি সমর্থনকে তারা অধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। পশ্চিমা অপরাপর দেশগুলো, বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলো এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের পক্ষে সরাসরি কোনো সহযোগিতা প্রসারিত না করলেও বরাবরের মতো মার্কিন আকাঙ্ক্ষাকেই তারা প্রাধান্য দিয়ে যাবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। বিষয়টি শুধু হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের আক্রমণে তাদের পাশে থাকা নয়, নেপথ্যে রয়েছে আরো কিছু উদ্দেশ্য। গাজায় বসবাস করা ২১ লাখ অধিবাসীকে যদি নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মতো ঘৃণ্য প্রয়াস থেকেও থাকে, সেটির জন্য ইসরায়েলের একক শক্তিই যথেষ্ট। হামাসের মতো একটি ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণাঙ্গ রণসজ্জা নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে এগিয়ে আসা অনেকটা মশা মারতে কামান দাগার মতো। এর পেছনে দীর্ঘদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার একটা তাগাদাও রয়েছে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরবসহ কিছু দেশের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপটে মার্কিন প্রভাবের জায়গাটা অনেকটা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছিল। এই সুযোগে তারা সেখানে দীর্ঘমেয়াদি সেনা সমাবেশ করে অপরাপর রাষ্ট্রগুলোকে চীনের বলয় থেকে বের করে আনার কৌশল হিসেবেও এই সময়টিকে ব্যবহার করতে চাইবে। তবে সব কিছু মিলিয়ে ইউক্রেন না মধ্যপ্রাচ্য, কোনটি অধিক প্রাধান্য দেওয়ার বিষয়, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর সেই সঙ্গে দুটি যুদ্ধে তাদের দ্বিমুখী আচরণ নিয়েও যথেষ্ট দ্বিধা থেকে যায়।


লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত