সরকারের পদত্যাগ এবং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের এক দফা দাবিতে বিএনপির মহাসমাবেশের সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে পরিস্থিতি রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠে, পণ্ড হয় বিএনপির সমাবেশ। বিএনপি হরতাল কর্মসূচি দেয়। রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠার কারণ ও পরিণতি নিয়ে এখানে কথা বলেছেন দু’জন অধ্যাপক।
শান্তিপূর্ণভাবে সমাবেশ করার কথা বলে অনুমতি নিয়ে বিএনপি শেষ পর্যন্ত কথা রাখতে পারল না। যদিও বিএনপি নেতারা দাবি করেছেন, পুলিশের আক্রমণের মুখে তাদের সমাবেশ শুরু হয়েও মাঝপথে বন্ধ করতে হয়েছে, বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। পুলিশ আক্রমণাত্মক হয়েছে সত্য, তবে কাকরাইলে বিএনপি কর্মীদের ককটেল ছুড়ে মারার পরই পুলিশ অ্যাকশনে যেতে বাধ্য হয়েছে। জনজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব সরকার ও প্রশাসনের। ফলে মারমুখী বিএনপি কর্মীদের ঠেকাতে পুলিশের অ্যাকশনে না গিয়ে কোনো বিকল্প ছিল না। আমার ধারণা, একটা পরিস্থিতি তৈরির জন্যই বিএনপির পক্ষ থেকে কাকরাইলের ঘটনার সূত্রপাত ঘটানো হয়। এর জেরেই বিএনপিকে তড়িঘড়ি সমাবেশ শেষ করে চলে যেতে হয়েছে। বিএনপি কর্মীদের হাতে একজন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। এ ঘটনা কী প্রমাণ করে? শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বিএনপির লক্ষ্য ছিল না। ঘটনার প্রতিবাদস্বরূপ বিএনপি সারাদেশে হরতাল ডেকেছে। আমরা অতীতে বিএনপির ডাকা হরতালের চেহারা দেখেছি। হরতাল ডেকে নেতারা অন্য কাজে ব্যস্ত থাকেন বা ঘরে বসে থাকেন। ফলে কর্মীরাও রাস্তায় থাকে না। এভাবে সরকার পতনের আন্দোলন হয় না। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, জনগণ কিন্তু বিএনপির সঙ্গে নেই। দেশের অর্থনীতি এক যুগ আগে যেমন ছিল আজকে তার চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। মানুষের কাজের বহু সুযোগ তৈরি হয়েছে। ফলে মানুষ এখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের চেয়ে রুটি-রুজির কাজে বেশি ব্যস্ত; কোনো দলের বিমূর্ত দাবিতে জীবন দেওয়ার আগ্রহ নেই তাদের।
বিএনপি তো বরাবরই গণঅভ্যুত্থানে বর্তমান সরকারকে উৎখাতের কথা বলছে। কিন্তু শুধু দলীয় কর্মী দিয়ে কি গণ-অভ্যুত্থান করা যায়? জনগণ বিএনপির সঙ্গে নেই বলে তাদের পক্ষে আন্দোলন বেশি দূর টেনে যাওয়া সম্ভব হবে না।
বিএনপি হয় তো আজকের হরতালের পর আরও সহিংস কর্মসূচি দিতে পারে। তখন সরকারও বসে থাকবে না। সহিংসতা দমনে রাষ্ট্রীয় ম্যান্ডেট বাস্তবায়নে বল প্রয়োগের পথে যেতে হবে। পরিণামে বিএনপির বহু নেতা গ্রেপ্তার হতে পারেন। তখন, অতীতের অভিজ্ঞতায় বলা যায়, আন্দোলন এমনিতেই স্তিমিত হয়ে যাবে।
আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, এ ধরনের আন্দোলনে নানা শক্তি ক্রিয়াশীল থাকে। সেগুলো নিয়ন্ত্রণ আন্দোলনকারীদের পক্ষে সবসময় সম্ভব হয় না। আর ওই পরিস্থিতিও সরকারকে বল প্রয়োগের সুযোগ করে দেয়। বিএনপির মহাসমাবেশের কাছাকাছি জামায়াতও যে জড়ো হলো বিনা অনুমতিতেই সমাবেশ করতে, সে ব্যাপারে বিএনপি কি সতর্ক ছিল? জামায়াত তো বরাবরই চায় সহিংসতা সৃষ্টি করতে। এরা মনে করে, সহিংস পরিস্থিতিতেই এদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এদের পাশে রেখে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ কী করে সম্ভব? জামায়াত যে একই দিন একই সময়ে রাস্তায় নামল তা নিয়েও বিএনপির কোনো সুস্পষ্ট বক্তব্য নেই।
এ পরিপ্রেক্ষিতেও বলা যায়, বিএনপির মতো একটা দলের যেখানে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করারই ক্ষমতা নেই, তারা কীভাবে সরকারের পতন ঘটাবে? পুলিশ কিন্তু শুধু ককটেল বিস্ফোরণের কারণেই অ্যাকশনে যায়নি। সেখানে কয়েকজন বিএনপি কর্মীকে তারা আটক করে। তখন বিএনপি নেতাকর্মীরা পুলিশের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় লিপ্ত হয়। এর প্রভাব অনতিদূরের নয়াপল্টনে পড়াই স্বাভাবিক। আমার কথা হলো, বিএনপি নেতাদের যদি শান্তিপূর্ণ সমাবেশই লক্ষ্য হতো তাহলে তারা নেতাকর্মীর ধাওয়ার বদলে সমাবেশ স্থল ধরে রাখত। সে রকম কোনো চেষ্টাই আমরা দেখিনি। আমরা নাগরিক সমাজের অনেককেই দেখেছি, গত কয়েক মাস ধরে সরকার ও বিএনপির মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের আহ্বান জানাতে। কিন্তু এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়, এক দফার আন্দোলন থেকে সরে না এলে সংলাপেরও কোনো ভবিষ্যৎ নেই।
এ অবস্থায় প্রশ্ন উঠতে পারে, আন্তর্জাতিক মহল বিশেষত মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা শক্তি কী করতে পারে, যারা আমাদের নির্বাচন নিয়ে এবার বেশ তৎপর? এ কথা ঠিক, আগামী নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য করার ব্যাপারে তারা ইতোমধ্যে বেশ নজরদারির ভূমিকা নিয়েছে। তারা বলেছে, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে বাধা সৃষ্টিকারী সবার বিরুদ্ধে তারা পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। এখন অল্প কিছুদিনের মধ্যই নির্বাচনের তপশিল ঘোষিত হবে। তখনও যদি বিএনপি সহিংসতা চালায় তাহলে তা কিন্তু পশ্চিমাদের ওই ঘোষিত নীতিরই বিরোধিতা হবে। আবার পশ্চিমাদের ওই নীতি যদি নিছক কথার কথা হয়, তারা যদি একতরফা সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে তাহলে জনগণ ও প্রশাসন সরকারের পাশে থাকলে সেটা কিন্তু তেমন প্রভাব ফেলবে না।
আমি মনে করি, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন দেশি-বিদেশি ফোরামে বিষয়টা ইতোমধ্যে একাধিকবার পরিষ্কার করেছেন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায়ও তিনি বলেছেন, সরকারদলীয় প্রার্থীদের নিজেদের যোগ্যতায় নির্বাচিত হয়ে আসতে হবে। তিনি কাউকে নির্বাচিত করে নিয়ে আসতে পারবেন না। আবার জনগণের মধ্যও একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের বিষয়ে বিপুল আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এটাকে কারও পক্ষেই নিরাশ করা সম্ভব হবে না।
নির্বাচনে বিএনপি যদি না আসে, তারা যদি ২০১৪ সালে যা করেছিল এবারও তা করে, তাহলে রাজনৈতিকভাবে তাদের চরম মূল্য দিতে হবে। জাতীয় পার্টি কিন্তু ইতোমধ্যে আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ঘোষণা দিয়েছে, অন্য অনেক দলও একই মনোভাব ব্যক্ত করেছে। এ পরিস্থিতিতে হয়তো নির্বাচনে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে না; তবে নির্বাচনটা যদি অবাধ ও সুষ্ঠু হয়, তাহলে দেশি-বিদেশি কোনো মহলেই নির্বাচন নিয়ে আপত্তি থাকবে বলে মনে হয় না।
একটা নির্বাচন সুষ্ঠু হতে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে শক্তির ভারসাম্য থাকতে হয়। প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে কিছুতেই মাঠ না ছাড়ার মনোভাব থাকতে হয়। বিএনপির মধ্যে সেটা আছে বলে মনে হয় না। এ কারণেই বিএনপির একপ্রকার না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা দেখা যাচ্ছে।
লেখক : রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও প্রাক্তন উপাচার্য, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়