গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বিএনপি সরকার পরিবর্তনের আন্দোলন করছে। কিন্তু তারা সরকার পতন বা পরিবর্তনের জন্য বর্তমান সরকারের চেয়ে ভালো জনকল্যাণমূলক উত্তম কোন পরিকল্পনা জনগণের সামনে তুলে ধরতে পারছে না। সরকার পরিবর্তন হলে কিংবা সরকারের পতন হলে যদি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গণতান্ত্রিক দেশ হতো পাকিস্তান। এ দেশটি স্বাধীন হওয়ার পর থেকে কোনো সরকারই তাদের পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পারেনি! কিন্তু আমরা জানি সেখানে গণতন্ত্রের কী অবস্থা। আসলে সরকারের পরিবর্তন কিংবা পতনের মধ্য দিয়ে কখনো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। আবার গণভিত্তি শক্তিশালী না হলে যেকোনো সরকারই জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। যা আমরা শ্রীলঙ্কায় দেখেছি।
২৮ অক্টোরব বিএনপির শান্তিপূর্ণ আন্দোলন নেতৃত্বহীনতার কারণে নিয়ন্ত্রনহীন হয়ে পড়ার প্রশ্ন আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। কারণ যে পরিমাণ কর্মী তারা মহাসমাবেশে জড়ো করেছিল, তা তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। অথবা ভাড়াটিয়া কর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশনা বুঝতে পারেনি, যে যার মতো শৃংখলা ভঙ্গ করেছে। ফলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের গতি ধ্বংসাত্মক রূপ নেয়। ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে গেলে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পরদিন ২৯ অক্টোবর হরতাল ঘোষণা দিয়ে কোনরকমে মঞ্চ থেকে নেমে যান, হরতালের পরই টানা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন রুহুল কবির রিজভী। যা বাস্তবায়নেও বিএনপি অগ্নিসন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। এ নির্দেশনা হয় তো দলের হাই কমান্ড থেকেই এসেছে। তেমনটির আভাস পাওয়া যায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি ভিডিও বার্তায়। তিনি দলীয় কর্মী সমর্থদের উদ্দেশ্যে লন্ডন থেকে এক ভিডিও বার্তায় জানান আন্দোলনের যেকোন পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব দিতে ও নেতৃত্ব হাতে তুলে নিতে কেউ যেন পিছু না হটে। প্রশ্ন হচ্ছে তিনি কেন এগিয়ে এলেন না? যা নিয়ে খোদ বিএনপি নেতা কর্মীদের মধ্যেই অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। লন্ডন থেকে এসি রুমের হিমেল হাওয়ায় বসে রাজনীতির যে কল্পনা বিলাস তিনি করছেন তা বাস্তবাতার সাথে কথটা সংগতি পূর্ণ? সৎ সাহস থাকলে কেউ পালিয়ে থেকে দলের নেতৃত্ব দেয়? নাকি সততার রাজনীতিতে আসতে তিনি ভয় পান।
লন্ডনের উন্নত জীবন, এয়ার কন্ডিশনের শীতল হাওয়া আর বিলাস-বসনে তিনি গত ১৪ বছরে যুক্তরাজ্য বিএনপির কাউন্সিলরদের জন্য একটি ভোটের আয়োজনও করতে পারেননি। পারেননি দলীয় কর্মীসমর্থকদের ভোটে নেতা নির্বাচন করতে। প্রতিবারই কাউন্সিল হয়েছে বাকি প্রার্থীদের বসিয়ে দিয়ে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায়। জানা যায়, যুক্তরাজ্য বিএনপির সর্বশেষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি। ওই কাউন্সিলে বর্তমান সভাপতি এম এ মালেক ছাড়াও সভাপতি পদে শরিফুজ্জামান চৌধুরী তপন ও তাজ উদ্দীন মনোনয়নপত্র কেনেন। আর সাধারণ সম্পাদক পদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক কয়সর এম আহমেদ ছাড়াও মনোনয়নপত্র কেনেন মুকাদ্দেম চৌধুরী নিয়াজ, নাসিম আহমদ চৌধুরী ও তাহির রায়হান পাভেল। ১২ জানুয়ারি এই পাঁচ প্রার্থী নির্বাচনপ্রক্রিয়ায় অন্তত চারটি বড় অসংগতির প্রতিকার চেয়ে তারেক রহমানের কাছে লিখিত অভিযোগ দেন। কিন্তু হাইকমান্ড অভিযোগের ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিনে পাঁচ জনের কেউই আর মনোনয়নপত্র জমা দেননি। এই হচ্ছে যুক্তরাজ্য বিএনপির রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য। বিএনপির জন্য তিনি গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ ঠিক করতে না পারলেও নেতাকর্মীদের অর্থ আর দেশে টাকা দিয়ে ঠিকই তিনি নিজের জন্য আয়েশি জীবন তৈরি করতে পেরেছেন।
যেখানে নয়াপল্টনে সমাবেশের তিন চারদিন আগে থেকে নেতা-কর্মীরা এসে খোলা আকাশের নিচে মশা-মাছি, রোদ-গরম উপেক্ষা করে দলের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করছেন সে অবস্থায় তিনি ছাদঢাকা আলোক উজ্জ্বল এসি রুমে বসে কীভাবে দলকে নেতৃত্ব দিবেন। এমন আরামে থেকে তিনি কীভাবে পল্টনে নেতা কর্মীদের আন্দোলনের উত্তাপ অনুভব করবেন। অন্তত কোনো ত্যাগী নেতার নেতৃত্বগুণ তা বলে না। যার নেতাকর্মীরা নির্ঘুম রাত কাটায়, মিছিল-মিটিংয়ে নিজের রক্ত ঝরায় তিনি কি কখনো নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করেছেন? কীভাবে তিনি একটি আলোক-উজ্জ্বল ভিডিও বার্তা দিয়েই নিজের দায় সারতে পারেন! নেতাদের বিভ্রান্ত করতে দেশের কোটি কোটি টাকা দেশের বিরুদ্ধে ব্যয় করেছেন। গুজব ছড়ানো ইউটিবার আর বিদেশি লবিস্টদের বিলিয়েছেন গত একযুগ ধরে কিন্তু তাতে কী হয়েছে? আন্দোলন সফল হয়েছে? লবিস্ট আর বিদেশি শক্তি দিয়ে ষড়যন্ত্র করে আন্দোলন সফল করা যায় না।
‘৮০ বছরের বৃদ্ধ মা পরে আছে জেলে; লন্ডনে বসে নমিনেশন বেচে ছেলে’Ñ ঘটনাটি ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাককালে মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে বিএনপির মনোনয়নবঞ্চিত সিলেটের একজন নেতার। সে বার মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে বিএনপির অনেক হেবিওয়েট প্রার্থীরাও মনোনয়ন পাননি। গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কার্যালয়, নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ে তখন বিক্ষোভ কওে ফটকে তালা দেয়ার মতো ঘটনাগুলো গণমাধ্যমে উঠে আসে। তখন বিএনপির তৃণমূল নেতারা বলেছিলেন রাজনীতির অরাজকতা কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। চাঁদপুর ১ আসনের নেতা এহসানুল হক মিলন মনোনয়ন বঞ্চিত হন, তার পরিবর্তে মালেয়েশিয়া প্রবাসী আদম ব্যবসায়ী মোশারফ হোসেনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল যিনি কখনো কচুয়ার তৃণমূলের সাথে সম্পৃক্তও ছিলেন না। তখন এ তালিকায় আরো যাদের নাম আসে তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নারায়নগঞ্জ-১ আসনের বিএনপি প্রার্থী তৈমুর আলম খন্দকার।
গণ-আন্দোলনের জন্য গণভিত্তি প্রয়োজন, যা বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব তৈরি করতে পারেনি। জাস্টিন ট্রুডোকে আমরা দেখেছিলাম করোনা মহামারির সময় দেশের জনগণের পাশে দাড়ানোর জন্য নাওয়া-খাওয়া ভুলে কীভাবে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন। বড় বড় চুল আর খোচা খোচা দাঁড়ি দেখে তার জনদরদ বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। রাহুল গান্ধীর ভারত-জড়ো আন্দোলনেও আমরা দেখেছি কীভাবে তিনি কন্যাকুমারী থেকে কাশ্মীর ভারতজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন। কেউ যদি মনে করে লন্ডনের হিমেল হাওয়ায় ক্লিন শেভ করে দু-চারটি কথা বলে দেশ উদ্ধার করবেন তবে তা রাজনীতির কল্পনা বিলাস বৈ আর কিছুই নয়।
লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট