বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫ ২ শ্রাবণ ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ১৭ জুলাই ২০২৫
বাংলাদেশ এখন গুরুত্বপূর্ণ
ড. দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২৩, ৪:০২ PM
১১ নভেম্বর প্রতিদিনের বাংলাদেশ-এ ‘ওয়াশিংটনকে স্পষ্ট বার্তা নয়াদিল্লির’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টু প্লাস টু সংলাপে দক্ষিণ এশিয়া ও বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তের আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে ভারত। ভারতের তরফে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সেদেশের জনগণই তাদের ভবিষ্যতের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’ ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের দুটো দিক রয়েছেÑ একটি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট এবং অপরটি আঞ্চলিক। এই দুই প্রেক্ষাপটের মধ্যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটই গুরুত্ব পায় বেশি। দুটি দেশ কোয়াড থেকে শুরু করে একাধিক আঞ্চলিক সংস্থার কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। এও সত্য, দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক স্বার্থের পরিসরও দুই দেশের মধ্যে ব্যাপক। ভূরাজনৈতিক নানা সমীকরণ এখানে কাজ করে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক ঘটনাবলি ও সমীকরণ বৈশ্বিক ঘটনাবলির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকলেও এখানকার ভূরাজনীতির রূপ আলাদা। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির একটি স্বতন্ত্র দিক রয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ইতিহাসের স্বরূপও স্বতন্ত্র। প্রতিটি দেশই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো ভালোভাবে অনুধাবন করে। আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় আমরাই বুঝতে পারব। আমাদের ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশী হিসেবে ভারতও আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো অনুধাবন করতে পারে বিধায় তারা টু প্লাস টু সংলাপে এমন মন্তব্য করেছে।

ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক বিভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতিটি দেশের আন্তঃসম্পর্কের মাত্রা ভিন্ন ও স্বতন্ত্র। এই অঞ্চলের দেশগুলোর ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি এমনকি অবকাঠামোগত দিকের পালাবদল এই অঞ্চলের মানুষই প্রকৃত অর্থে বুঝতে পারে। পশ্চিমা বিশ্ব কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই বাস্তবতা বোঝা সম্ভব নয়। একইভাবে বলা যায়, এশিয়া প্যাসিফিকের কোনো দেশের পক্ষেও উত্তর আমেরিকা কিংবা পশ্চিমা বিশ্বের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা পুরোপুরি অনুধাবন করা সম্ভব নয়। বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের বিষয় হলেও প্রতিটি দেশের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অবস্থা ও আত্মপরিচয় রয়েছে। সঙ্গত কারণেই বাইরের কোনো দেশ যখন অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে চায়, তখন তারা সাময়িক কিছু বিষয় দেখার চেষ্টা করে। ফলে তারা যখন মন্তব্য করে তখন তা ভুল বার্তা প্রকাশের শঙ্কা বহন করে। দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতায় ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের ভিন্ন মাত্রা রয়েছে সত্য, কিন্তু এই দুই রাষ্ট্র এই অঞ্চলকে পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে একই আঙ্গিকে দেখবে, এমনটি প্রত্যাশা করা যায় না। দৃষ্টান্ত হিসেবে মিয়ানমারের কথা বলা যেতে পারে।

মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের কৌশলগত সম্পর্ক রয়েছে। মালাক্কা ডিলেমার কারণে চীন মিয়ানমারের সঙ্গে আরও বেশি যুক্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে চীনের সঙ্গে মিয়ানমারের একাধিক উদ্যোগ আমরা দেখেছি। তা ছাড়া নিরাপত্তা ও সামরিক ক্ষেত্রেও দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি চীন ও মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তুলতে শুরু করেছে। এতদসত্ত্বেও মিয়ানমার প্রসঙ্গে ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিন্ন অবস্থান লক্ষণীয়। যেমন রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত মিয়ানমার সরকারকে সমর্থন করছে। মিয়ানমারের সঙ্গে দেশটির সুসম্পর্ক রয়েছে। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর নানা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। বার্মা অ্যাক্ট নামে একটি নতুন আইনও জারি করেছে। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, ভূরাজনৈতিক উদাহরণ সামনে থাকার পরও আন্তর্জাতিক কোনো কোনো বিশ্লেষক কীভাবে প্রত্যাশা করেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি একই হবে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ভূরাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট রয়েছে। এই প্রেক্ষাপট ভারতের কাছে যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি আমাদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। একই কথা যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নাও হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বাংলাদেশ বৈশ্বিক রাজনীতির কৌশলের অংশ হিসেবে বিবেচিত। ভারতের ক্ষেত্রে তা আঞ্চলিক বাস্তবতা ও তাদের রাষ্ট্রীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক স্বার্থ বিবেচনায় কানাডা কিংবা মেক্সিকোর যে গুরুত্ব বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন গুরুত্ব প্রত্যাশা করা ঠিক হবে না। একইভাবে ভারতের ক্ষেত্রে বলা যায়, বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। বিগত ১০-১৫ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের দিকে দৃষ্টিপাত করলে আমাদের কারো কারোর দৃষ্টিভঙ্গির সীমাবদ্ধতার দিকে কিছুটা আলোকপাত করা সম্ভব হবে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটি সুদৃঢ় সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। দুই দেশের বাণিজ্যিক ও যোগাযোগ সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে, নিরাপত্তা সহায়তার আদান-প্রদানও বেড়েছে। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ-ভারত সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তার আগে ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা সংকট ছিল, যা এখন নেই।

বাংলাদেশের সহযোগিতায় তারা সংকটাবস্থা সম্পূর্ণরূপে দূর করতে পেরেছেন। উল্লেখ্য, যে শক্তিগুলো এই সংকটাবস্থা সৃষ্টি করেছিল, সেই শক্তিগুলো যদি আবার বাংলাদেশে ক্ষমতারোহণ করে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে বিঘ্নিত করে তোলে, তাহলে সেটিও ভারতের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। দক্ষিণ এশিয়ার বাস্তবতা বিবেচনা করেই ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে। আমাদের ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে ভারত পরিচিত বিধায় তারাও চায় না বাইরের কেউ এসে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করুক। যেমনটি আগেও বলেছি, সাময়িক কিছু ঘটনাবলির ভিত্তিতে সামগ্রিক মন্তব্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভুল বার্তা বহন করতে পারে। শুধু তাই নয়, পশ্চিমা বিশ্বের কূটনীতিকদের বোঝা উচিত, প্রাসঙ্গিকতা যাচাই না করে মন্তব্য করলে বাংলাদেশের মানুষও তা গ্রহণ করবে না।

আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, কোনো দেশই নিজস্ব সংস্কৃতি-ইতিহাস ও স্বকীয় রাজনৈতিক বাস্তবতা দ্বারাই পরিচালিত হয়। অন্য কোনো দেশের হস্তক্ষেপ ওই দেশটির অবস্থা নাজুক করে তোলে। এক্ষেত্রে আফগানিস্তানের কথা বলা যেতে পারে। সেখানে বাইরের হস্তক্ষেপের ফলে তাদের আর্থসামাজিক অবস্থা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইউক্রেনের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যেতে পারে। আফ্রিকার বহু দেশের ক্ষেত্রেও আমরা দেখেছি কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহির্দেশের হস্তক্ষেপ বহু মানুষের জীবন বিপন্ন করে তোলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বহির্শক্তির সহায়তা নিয়ে দশকের পর দশক বর্ণবাদী শাসনব্যবস্থা এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। অর্থাৎ বিদেশি শক্তির সহায়তায় অভ্যন্তরীণ সংকটাবস্থা দূর হয়নি। যখন নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দেশটির অভ্যন্তরে আন্দোলন বেগবান হয়, তখন ইতিবাচক ও টেকসই পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে গেছে দেশটি। কোনো একটি দেশের অভ্যন্তরীণ সংকট তার ভূরাজনৈতিক অবস্থান, আঞ্চলিক স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের নিরিখেই বিবেচনা করা জরুরি। ভূরাজনৈতিক কিংবা বৈশ্বিক কৌশলের স্বার্থে যদি কোনো দেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তা ওই দেশ তো বটেই ওই অঞ্চলের জন্যও মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। ভারতের নীতিনির্ধারকরা যে তা অনুধাবন করতে পেরেছেন তা-ই লক্ষ করা গেল টু প্লাস টু সংলাপে। যেকোনো সংলাপে তারা বিষয়টি বরাবরই ব্যক্ত করে আসছে।

উন্নয়নযজ্ঞে বাংলাদেশ অনেকদূর এগিয়েছে। এই অগ্রযাত্রার পথে বাংলাদেশের ভৌগোলিক গুরুত্ব বেড়েছে। অবকাঠামো ও বাণিজ্যিক উন্নয়নযাত্রায় বহির্দেশের হস্তক্ষেপ ভালো কিছু এনে দেবে না। বিশ্বের অনেক দেশেই বাইরের দেশের হস্তক্ষেপ রাজনীতি, অর্থনীতি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের পথে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেছে। পাকিস্তানের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট বোঝা সম্ভব। দেশটির অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দল ক্রমেই বাড়ছে। একই সঙ্গে রয়েছে বহির্শক্তির প্রভাব। ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা। প্রায়ই শোনা যায় তারা বাংলাদেশ থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে বাংলাদেশ একটি সফলতার নাম। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে ভুল বোঝাবুঝির সুযোগ নেই।

বিগত কয়েক দশকে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক আস্থা যে মাত্রা পেয়েছে তা বাংলাদেশ-ভারতের নেতৃত্বকে জোরদার করছে এবং দক্ষিণ এশিয়াকে সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের মূল ভিত্তি ভূরাজনীতি ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষা করা। সেক্ষেত্রে আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সাময়িক কিছু বিষয়ে দৃষ্টি দিয়ে সামগ্রিক প্রেক্ষাপট নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে বিদেশি কূটনীতিকরা আরও সংযত হবেনÑ এমনটিই প্রত্যাশা। কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে অস্থিতিশীলতা উস্কে দেওয়া কিংবা অভ্যন্তরীণ বাস্তবতা বদলে দেওয়ার বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয় হতে পারে না। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। এই মূলমন্ত্রের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দরকষাকষি করছে।

বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, আত্মমর্যাদা ও রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতি বিদেশি রাষ্ট্রের শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করার বিষয়েও কূটনীতি পরিচালিত হচ্ছে। এভাবেই কূটনৈতিক প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে। আমরা তেমনটিই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের কূটনীতিকদের স্পষ্টভাবে বিদেশিদের বোঝাতে হবে যেন তারা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যুক্ত হতে গেলে শ্রদ্ধাবোধ রাখেন ও সংযত থাকেন। ভূরাজনৈতিক সম্পর্কে মত-দ্বিমত থাকবেই। কিন্তু কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অযাচিত হস্তক্ষেপ যেন না হয়, তা কূটনৈতিক চ্যানেলকে মাথায় রাখতে হবে।

 লেখক : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত