রবিবার ৬ জুলাই ২০২৫ ২২ আষাঢ় ১৪৩২
রবিবার ৬ জুলাই ২০২৫
কারার ঐ লোহ কপাট
নজরুলের সুরই বাঙালির চেতনা
আজিজ ওয়েসি
প্রকাশ: বুধবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৩, ৫:০৪ PM
বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের বহুল পরিচিত একটি গান কারার ঐ লৌহ কপাট। সম্প্রতি হিন্দি সিনেমা ‘পিপ্পায়’ গানটির ব্যবহার নিয়ে বিতর্কের মুখে পড়েছে সিনেমা নির্মাতারা। ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের শিকার তারা। অস্কারজয়ী এ আর রহমানের সংগীত পরিচালনায় যেভাবে গানটি এখন উপস্থাপন করা হয়েছে, তাতে আপত্তি তুলেছে নজরুল পরিবার ও বহু সাধারণ মানুষ। বিতর্ক তৈরি হওয়ার পরে কবি পরিবারের মধ্যে থেকে দাবি উঠেছেÑ যে চুক্তি অনুযায়ী গানটি সিনেমায় ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে, তা প্রকাশ করার জন্য। 

যে হিন্দি ছবিতে গানটি ব্যবহৃত হয়েছে, ‘পিপ্পা’ নামের সেই সিনেমাটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক সদস্যকে কেন্দ্র করে সত্য ঘটনা অবলম্বনে তৈরি হয়েছে। সিনেমাটির সংগীত পরিচালনা করেছেন অস্কারজয়ী সংগীত পরিচালক এ আর রহমান। কথা ঠিক রাখলেও গানটির আসল সুর বদল করায়  ভারত ও বাংলাদেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আগে ‘কিসের দহনে বাকরুদ্ধ হন কবি নজরুল‘Ñ এ সম্পর্কে আলোচনা করলে আমাদের মূল বিষয় বুঝতে আরও সহজ, সরল ও স্পষ্ট হয়। 

প্রেম এবং দ্রোহে নজরুলের কোনো তুলনা ছিল না। তার এক হাতে ছিল বাঁশের বাঁশি, আরেক হাতে রণতূর্য। অজানা পথিকের সন্ধানে কবির দিন কাটত। রাত কাটত। আগলে রাখতেন নিজের কষ্টগুলোকে। কাউকে বুঝতে দিতেন না। তবে সব কিছুর প্রকাশ ঘটাতেন গানে, কবিতায়। সুরের ঝঙ্কার তুলতেন নিজের অথবা অপরের কণ্ঠে। চেষ্টা করতেন কাঠিন্যকে জয় করতে। তাই তো কারাগারকে পরিণত করেছিলেন সৃষ্টিশীলতায়। বেদনাকে দ্রোহে রূপান্তর করেন। বঞ্চনাকে ঠাঁই দেন হৃদয়ের গহিনে। আহারে যদি জানা যেত মানুষের প্রতি কতটা অভিমানে কবি বলেছিলেন, ‘সত্য হোক প্রিয়া, দীপালি জ্বলিয়া ছিল-গিয়াছে নিভিয়া!’ কতটা যন্ত্রণায় ‘ফুলের বুকে দোলে কাঁটার অভিমানের মালা/আমার কাঁটার ঘায়ে বোঝ আমার বুকের জ্বালা।’

তার বাঁশির সুর, গানের সুর সবই ছিল বাঙালির জন্য। কত লিখেছেন বাঙালির জন্য। গান, গজল, কবিতা বাঙালি যা পছন্দ করতেন তাই লিখতেন। কারার ঐ লৌহ কপাট বাঙালি জাতির এক অনন্য চেতনার গান, এক অনন্য চেতনার নাম। বাঙালি জাতির বিপ্লবী চেতনা রয়েছে এই গানে। 

১৯২১ সালে ডিসেম্বর মাসÑ কাজী নজরুল ইসলাম কুমিল্লা থেকে কলকাতায় ফেরার পর সৃষ্টি করেন ‘কারার ওই লৌহ কপাট ভেঙে ফেল কর রে লোপাট’ গানটি। বাংলার ইতিহাস হাঁতড়ালে সব থেকে সেরা বিদ্রোহের গানের প্রসঙ্গ যদি আসে তাহলে এই গানটি আসে। সেই সময় নজরুলের ‘বিদ্রোহ’ চিন্তায় ফেলেছিল রাজশক্তিকে। নজরুলের উপর নজরদারি শুরু হয়। তাঁর বহু কাব্যগ্রস্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। ১৯২৪ সালের কাছাকাছি সময়-নিষিদ্ধ করা হয়েছিল ‘ভাঙার গান’। ১৯৩০ সালের কাছাকাছি সময়, নিষিদ্ধ করা হয়েছিল নজরুল ইসলামের ‘প্রলয় শিখা’। তাঁর আগে সরকার বিরোধী প্রচারের জন্য তাঁকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

১৯২২ সালের ২০ জানুয়ারি কবিতা হিসাবে প্রকাশিত হয় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’। হুগলির জেলে দেশবন্ধু ও অন্যান্য বন্দিরা একসঙ্গে এই গান গাইতেন এমন কথাও শোনা যায়।  গানের কথা, জেলবন্দিদের মধ্যে তার প্রভাব দেখে সুবিধের লাগেনি ব্রিটিশদের। সরকারবিরোধী প্রচারের জন্য কবিকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তড়িঘড়ি ব্রিটিশ সরকার নিষিদ্ধ করে এই গানটি। অমানবিক অত্যাচার চলত। বন্ধ করা হয়েছিল ভাত। পরিবর্তে ফ্যান খেতে দেওয়া হতো। তরকারির জায়গায় তরকারির খোসা পেতেন। একদিন মাছ ও একদিন মাংসের ব্যবস্থা থাকলেও কয়েদিরা কাঁটা ও হাড় ছাড়া কিছুই পেতেন না। হুগলির জেল তখন কুখ্যাত চোর, ডাকাতদের জায়গা ছিল। তাদের সাথেই থাকতেন কবি। হুগলী জেলের সাধারণ কয়েদিরা তাঁর ভক্ত হয়ে উঠলেন। জেলের মধ্যে মধ্যে নজরুল ইসলাম ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটা গাইতেন। তখন যোগ দিতেন সাধারণ কয়েদীরাও। ছয় ফুট বাই চার ফুট ঘরের মধ্যে কবিকে দীর্ঘদিন ধরে থাকতে হয়েছে। সহ্য করতে হয়েছে মৃত্যুযন্ত্রণা। তবুও কারার ঐ লৌহ কপাট গান গেয়ে শক্তি জুগিয়েছেন নিজেকে। বিপ্লবী করে তুলতেন কয়েদীদের। 

নজরুলের শিরা-শোণিতের সংক্ষোভ, ইতিবাচকতা আজ বাঙালি জাতির বড় বেশি প্রয়োজন বলেই তাদের প্রতিবাদী চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। প্রখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাস বলেছিলেন, ‘নজরুল ঊনবিংশ শতকের ইতিহাস প্রান্তিক শেষ নিঃসংশয়বাদী কবি।’

নজরুলের আদর্শ ছিল বাঙালি চেতনা, ছিল সাম্যবাদী চেতনা। তিনি দেখেছেন ভারতবাসীর ওপর শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের নির্মম অত্যাচার এবং শোষণকে। এই উদ্দেশ্যের পথে শ্বেতাঙ্গরা সঙ্গে নিয়েছে ভারতবর্ষীয় জমিদার-মহাজনদের। ধর্মধ্বজাধারীরাও তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে নিরীহ মানুষের উপর উৎপীড়ন চালিয়ে নিরন্ন এবং অসহায় করেছে। এই অসাম্য দেখে নজরুলের কবি হৃদয় হাহাকার করে উঠেছিল । তাই জনদরদি এই রোমান্টিক কবি সাম্যবাদ নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। মানুষকে উদ্ধারের বিপ্লবের মন্ত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের পরিচয় রেখেছেন তিনি। অসহায় মানুষদেরকে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্ত করতে সাম্যের গান শুনিয়ে বজ্রকঠিন ব্যক্তিত্বের আড়ালে একটি কোমল হদয়ের সন্ধান দিয়েছিলেন। সর্বমানবের মুক্তি এবং সমানাধিকার প্রতিষ্ঠাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিল। মানবসমাজের ইতিহাসকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আলোচনা করেননি। কেবল সোচ্চার ছিলেন ধর্মীয় সাম্য ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে। এজন্যই লিখেছিলেনÑ

গাহি সাম্যের গান,
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রিশ্চান।
জাতি-গোত্রকেন্দ্রিক হানাহানি থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসার সাগরে ভাসবার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। এভাবেই নিজের সারাটি জীবন কাটিয়ে দিয়েছেন নজরুল। দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসতে গিয়ে যে দহনে দগ্ধ হয়েছিলেন তা তিনি ছাড়া আর কেউ জানতেনও না, বুঝতেনও না। শেষে বাকরুদ্ধ পর্যন্ত হয়েছিলেন। দারিদ্র্যের কষাঘাতে ক্ষতবিক্ষতের দাগ গায়ে আঁচ পড়তে দেননি নজরুল। 

‘পিপ্পা সিনেমা‘ যে গানটি নিয়ে ভারত বাংলাদেশে বিতর্ক শুরু হয়েছে তা হলÑ ‘কারার ঐ লৌহ কপাট।’ নজরুলের প্রতিটি গান-কবিতা, গজল-বাঙালি চেতনাকে ধারণ করে। গানের সুর, কবিতার ভাব, ইত্যাদি থেকেই মানুষের দেহ-মন আন্দোলিত হয়; অনুপ্রেরণিত হয়, উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। কারণ একই কথা ভিন্ন ভিন্ন সুরে ভিন্ন ভিন্ন ভাব তৈরি করে। ভিন্ন ভিন্ন অর্থ তৈরি করে। এজন্য মূল সুরকে পরিবর্তন করলে তার আদর্শ নষ্ট হয়ে যায়। আর এজন্যই কারার ঐ লৌহ কপাট গানের সুর পরিবর্তন করায় বাঙালি জাতির আঘাত লেগেছে। চেতনা এমন এক জিনিস যা পরিবর্তন করা যায় না। নজরুল ও নজরুলের গান বাঙালি জাতি চেতনায় আবদ্ধ। কবি বাকরুদ্ধ হলেও বাঙালির বাকস্বাধীনতা নিশ্চিত করে গিয়েছিলেন। আজ যে প্রতিবাদী কণ্ঠে আওয়াজ তোলে বাঙালি, তা যেন নজরুলের গানের সুর। এজন্য সেই সুর, ভাব, অর্থ যেন পরিবর্তন না হয়, বাঙালি যেন আঘাত না পায়, তাদের চেতনায় যেন আঘাত না আসে সেদিকে বিশ্ববাসীর কড়া নজর প্রয়োজন। তাহলেই সকল বিভেদ ভুলে একতা সৃষ্টির পথ আরও সুগম হবে। 

লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত