দফায় দফায় চলছে বিএনপির হরতাল-অবরোধ। এতে বিপাকে পড়েছেন সাহেব আলীদের মতো খেটে খাওয়া মানুষ। হরতাল-অবরোধে সড়কে পরিবহন চলাচল থেমে থাকলেও সাহেব আলীদের পেটের ক্ষুধা থেমে থাকেনি। পেটের টানে প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে শ্রম বিক্রির জন্য তারা হাজির হন বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কের নয়াবাজার শ্রমিকের হাটে।
গুরুদাসপুরের নয়াবাজারে প্রতিদিন ভোরে বসে শ্রমিকের হাট। শ্রম বিক্রির জন্য এই হাটে এসে কৃষকের কাছে নিজেকে বিক্রি করেছেন সাহেব আলী, আনেছা, রহিমারা। সকালের মিষ্টি শীতে শরীরটা চাদরে মোড়ানো। হাতে কাস্তে-কোদাল। কাঁদে ধান বাহনের বাক ইত্যাদি সরঞ্জামাদি নিয়ে অন্যদের মতো ষাটোর্ধ্ব দিনমজুর মুনু মিয়াও নিজেকে হাটে তুলেছেন শ্রম বিক্রির জন্য। দিনমুজুর সাহেব আলী, আনেছা, রহিমা, নরেশদের বাড়ি সিরাজগঞ্জের হরিণচরা ও খালখোলা এলাকায়। সময় তখন ভোর পাঁচটা। কিছুটা কুয়াশা, হিমেল হওয়ার সাথে হরতাল অবরোধের মতো প্রাণঘাতি প্রতিকূলতা ছাপিয়ে ঝুঁকি নিয়ে কিভাবে তারা শ্রমিকের হাটে এসেছেন তা জানালেন।
সাহেব আলীর (৫২) মতে, আগে ঢাকা থেকে ফেরা পন্যবাহী ট্রাক, মাছের গাড়ি, টেমপু, ভুটভুটি, পিকআপে চড়ে সীমিত ভাড়ায় শ্রমিকের হাটে আসতেন তারা। এখনও সেসব পরিবহনেই আসেন। তবে হরতাল-অবরোধের কারণে ১০ টাকার কাছে তিনগুন পরিবহন ভাড়া গুনতে হচ্ছে। সবচেয়ে বড় সমস্য হলো ককটেল-বোমার ভয়। ভয় ট্রাকে আগুন লাগারও।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছেÑ প্রায় একযুগ ধরে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের নয়াবাজারে ‘বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক’ ঘেঁষে শ্রমিকের হাট বসে। এই হাটে শুধু যে সাহেব আলীরা এসেছেন তা নয়। জীবিকার তাগিদে আশপাশের কয়েকটি জেলা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক এসেছেন শ্রম বিক্রি করতে। শ্রমিকের এই কাতারে রয়েছেন নারী- প্রুুষ, শিশুসহ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির মানুষরাও।
তাড়াশের মাঝগাঁও থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠির শত শত ওরাঁও সম্প্রদায়ের নারী-পুরুষও এখানে এসেছেন। এদের দলনেতা শ্যামা ওরাঁও জানান, রসুন রোপন, ধানকাটাসহ সব কাজই তারা করে থাকেন। নিজের খেয়ে জনপ্রতি মজুরিপান ৩৫০ টাকা। কিন্তু হরতাল-অবরোধ চলায় শ্রমিকের হাটে আসতে তাদের বেশ ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। তবুও পেটের তাগিদে ঝুঁকি নিয়েই তারা এই হাটে আসেন শ্রম বিক্রি করতে।
কৃষি বিভাগ ও স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথাবলে জানাগেছে- দক্ষিণ চলনবিলের গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম, সিংড়া, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ ও পাবনার চাটমোহর উপজেলায় একযোগে রবি শস্যের আবাদ শুরু হয়। চলনবিলের পানি নামার সাথে সাথেই জেগে উঠে আবাদী জমি। ধান কাটার পর রসুন, ভুট্টা, সরিষাসহ রবিশস্য আবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কৃষক। এসব কাজে স্থানীয় শ্রমিকের তুলনায় কম মজুরীতে শ্রমিকের হাটে পাওয়া যায় বহিরাগত শ্রমিক।
গতকাল মঙ্গলবার ভোরে নয়াবাজারের শ্রমিকের হাটে গিয়ে দেখাগেল গুরুদাসপুর-বড়াইগ্রাম ছাড়াও তাড়াশ, সলঙ্গা ও উল্লাপাড়া, বগুড়া, শেরপুর উপজেলা এলাকার শ্রমিকরা দলবেঁধে এখানে জমায়েত হয়েছেন। এসব শ্রমিকদের সবাই এসেছেন ট্রাক, নছিমন কিংবা অটোভ্যানে। সকলের গায়েই রয়েছে শীতের পোষাক, হাতে কাস্তে, কোদাল ও ধান বহনের জন্য বাক। কৃষক তাদের চাহিদামত শ্রমিক দরদাম মিটিয়ে সরাসরি মাঠে নিয়ে যায়।
হাফিজুল ইসলামসহ পাঁচজন কৃষকের সাথে কথাবলে জানাগেছে, বিনাহালে রসুন রোপন, সেখানে লারা (ধানের খড়) বিছানো ও ধানকাটাসহ জমি তৈরির কাজ করানো হয় বহিরাগত এসব শ্রমিক দিয়েই। স্থানীয় শ্রমিকের মুজুরি ৬০০ টাকা। অথচ একই কাজ করে বহিরাগত শ্রমিকদের দিতে হয় ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। তুলনামূলক কম মুজুরীতে কাজ করায় এসব শ্রমিকের চাহিদা বেশি।
ধারাবারিষা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল মতিন জানান, শুধু নয়াবাজার নয়, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়ক ঘেঁষে মশিন্দা ইউনিয়নের হাঁসমারী ও বড়াইগ্রামের মানিকপুর পয়েন্টেও এরকম শ্রমিকের হাট বসছে প্রায় একযুগ ধরে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হারুনর রশীদ বলেন, সময়মতো বহিরাগত দিনমজুর পাওয়ার সুবাদে এলাকার মানুষ ঠিকঠাকভাবে জমি চাষাবাদ করতে পারছেন।