শনিবার ৫ জুলাই ২০২৫ ২১ আষাঢ় ১৪৩২
শনিবার ৫ জুলাই ২০২৫
নির্বাচন : সামনে বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ
আবদুল মান্নান
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর, ২০২৩, ৫:০৪ PM
দেশে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে উৎসবমুখর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি ও তাদের সঙ্গে থাকা বেশকিছু প্যাডসর্বস্ব দল নির্বাচন বানচাল করার লক্ষ্যে দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে নানা ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে, মানুষ মারছে, সম্পদ পুড়ছে। তাদের দাবি, বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা নির্বাচনে যাবে না। তাদের আরও দাবি, নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনাসহ বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে, যা সংবিধান অনুমোদন করে না। একই সঙ্গে বিএনপি দাবি করছে, তাদের দলের সাজাপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও সাজাপ্রাপ্ত পলাতক ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের সাজা বাতিল করে মুক্তি দিতে হবে। শৌখিন বামপন্থিদের একটি দলের দাবি, ‘আগে রাষ্ট্র মেরামতের বন্দোবস্ত করতে হবে, তার পর নির্বাচন’।

বর্তমান সরকারের সামনে এমন কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়নি তারা বিরোধী দলের আবদার মেনে পদত্যাগ করে দেশকে একটি সাংবিধানিক সংকটে ফেলবে। অথবা দেশের সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দিয়ে নির্বাচনের সুযোগ করে দেবে। বিরোধী দলের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে দেশের কিছু স্বার্থান্বেষী সুশীল গোষ্ঠী ও অন্তত একটি বিদেশি পরাশক্তি অত্যন্ত অশোভনভাবে শেখ হাসিনার ওপর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করেছিল। একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হচ্ছিল তিনি নির্বাচনবিরোধীদের একজন বড়মাপের পৃষ্ঠপোষক। তাদের এই চাপ অনেকটা দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি হস্তক্ষেপ। শেখ হাসিনার দূরদর্শিতা ও সাহসের কারণে সব অপচেষ্টা আপাতত ভেস্তে গেছে। তবে ষড়যন্ত্র থেমে নেই।

বিএনপি বা তার মিত্ররা নির্বাচনে না এলেও নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি ৩০০ আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য ক্রিয়াশীল দল অংশ নিচ্ছে। এরই মধ্যে বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতা দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নতুন দলের নিবন্ধন নিয়ে তাতে যোগ দিয়ে নির্বাচনের ট্রেনে উঠে পড়েছে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, আসন্ন নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবার জন্য নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসবে। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বিএনপি যদি না আসে তাদের অবস্থা একসময়ের দাপুটে মুসলিম লীগের মতো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। নির্বাচনে কমিশনের সামনে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সাংবিধানিকভাবে তাদের দেয় ক্ষমতাবলে আসন্ন নির্বাচনকে সব ধরনের সমালোচনার ঊর্ধ্বে রেখে অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, যা করার সক্ষমতা তাদের আছে। তবে নির্বাচন কমিশন যাতে তাদের এই দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের।

আওয়ামী লীগের জন্য সবসময় সমস্যা সৃষ্টি করেছে তার নিজস্ব দলীয় নেতাকর্মীরা, যাদের অধিকাংশই দলে অনুপ্রবেশকারী, রাজনীতির মাঠে বিরোধী পক্ষ নয়। রাজনীতির মাঠে আওয়ামী লীগকে টেক্কা দিতে পারে তেমন দল এখনও বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। তা যদি হতো ১০০ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে জনগণের সমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ফিরে আসার রেকর্ড বিশ্বে একমাত্র আওয়ামী লীগের থাকত না। আওয়ামী লীগের বড় শক্তি তার ব্র্যান্ড জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর দলের নেতৃত্বে একজন শেখ হাসিনা। গত ১৫ বছর তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণে দলে হাইব্রিড, ধান্ধাবাজ, দূর্নীতিবাজ আর তৃণমূল থেকে বিচ্ছিন্ন অনেকেই আওয়ামী লীগে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদপদবিতে আছেন, বেশকিছু অযোগ্য মানুষ সংসদ সদস্য হয়েছেন। এই সুবাধে কিছু অযোগ্য ব্যক্তি মন্ত্রিপরিষদে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। এদের কারণে সরকার বিভিন্ন সময় সমালোচিত হয়েছে। বিব্রত হয়েছেন শেখ হাসিনা। বর্তমান সরকারের আকাশচুম্বী অনেক সফলতা আছে, তা সরকারের বড় শত্রুও স্বীকার করবে।

এসব অর্জন ম্লান হয়ে যায় যখন বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে একশ্রেণির টাউট ব্যবসায়ী নিত্যপণ্য দ্রব্যের বাজারকে জিম্মি করেছে তার বিপক্ষে গিয়ে তিনি কিছু করতে পারবেন না । মুদ্রাস্ফীতি নিয়ে যখন আর এক মন্ত্রী বলেন ‘এসব কথা যারা বলেন তারা অর্থনীতি বুঝেন না’। তখন তা মানুষের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। স্কুলের পাঠ্যসূচি নিয়ে যখন অভিভাবকরা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন, তখন তা নিয়ে প্রশ্ন তো উঠতেই পারে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা যখন বলেন, এসবের পেছনে কোচিং সেন্টারগুলো, তখন সবাই বিশ্বাস করতে পারে না কারণ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্কুল পড়ুয়াদের কোচিং সেন্টারের সঙ্গে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। বড়জোর তাদের সন্তানরা কোনো একটি স্কুলের শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে পারে।

একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য জানতে চাইলেন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য প্যানেলের ফাইলটা তারা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে তিন বছর আগে পাঠিয়েছিলেন। যথাসময়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন তা অনুমোদন করে মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেয়। তিন বছর পর তা মন্ত্রণালয়ে বাক্সবন্দি রেখে নতুন প্যানেল প্রস্তাব করে পুনরায় পাঠানোর অনুরোধ করা হয়েছে। ভদ্রলোক এর কারণ কী জানতে চাইলে তাকে আমার অজ্ঞতার কথা বলে বলি, হয়তো কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ওই প্রস্তাবে খুশি ছিলেন না। এমনউদাহরণ আরও আছে। বলা হয়েছে, এবার মনোনয়নের সময় এমন সব বিতর্কের জন্ম দেওয়া প্রার্থীদের বাদ দেওয়া হবে। দেশের মানুষ তাই দেখতে চায়। প্রায় অভিযোগ শোনা যায় দীর্ঘদিন ধরে দলের পরীক্ষিত নেতাকর্মীরা দলে অবহেলিত। এমনটি হতে থাকলে দল দুর্বল হয়। মৌসুমি পাখিরা মৌসুম শেষ হলে উড়ে যায় এই কথাটি মনে রেখে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী নির্বাচন করেছে, তা দেশের মানুষ দেখতে চায়।

১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে তার ক্ষমতাবলে বঙ্গবন্ধু দেশটাকে স্বাধীন করেছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ কখনও পাওয়া যায়নি। কেউ কখনও বলেনি কোনো অতি উৎসাহী কর্মী ব্যালট পেপারে সিল মেরে তা বাক্সে ঢুকিয়েছে, যা সম্প্রতি কোনো কোনো উপনির্বাচনে দেখা গেছে, যার কোনো প্রয়োজন ছিল না। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে এমন অপকর্ম যেন না হয়, এ জন্য নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ব্যবস্থা নিতেই হবে, তবে এ বিষয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে ক্ষমতাসীন দলের। দলের হাইকমান্ড থেকে এ ব্যাপারে দলের নেতাকর্মীদের প্রতি কঠোর নির্দেশ থাকতে হবে। অন্যদিকে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এই কাজটি বিরোধী পক্ষও করতে পারে, সেই ব্যাপারে দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীকে সজাগ থাকতে হবে। বর্তমানে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে যে অবস্থায় আছে, তাদের নির্বাচন নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। চিন্তা করতে হবে দলের ভেতরের উইপোকাদের নিয়ে।

নির্বাচনে কত শতাংশ ভোটার উপস্থিত হবে, তা নিয়ে নানা ধরনের হিসাব-নিকাশ চলছে, যদিও কোনো নির্বাচনের বৈধতা ভোটার উপস্থিতির সংখ্যা দিয়ে নির্ধারণ করা হয় না। যুক্তরাষ্ট্র বলি বা যুক্তরাজ্য সেই সব দেশের অনেক নির্বাচনে ২৫ শতাংশ ভোটারের বেশি মানুষ ভোটে অংশ নেন না। তবে বাংলাদেশে মনে করা হয় কোনো নির্বাচনে বেশি সংখ্যায় ভোটার অংশ নিলে তার গুণগত মান আর নির্বাচলে জৌলস বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে ভোট সবসময় একটি বড় উৎসব। আওয়ামী লীগের পাড়ামহল্লা হতে শুরু করে দলে যতগুলো অঙ্গসংগঠন আছে, তাদের পরিবারের সংখ্যা কম করে হলেও সাড়ে চার কোটি। এদের মধ্যে যারা ভোটার আছেন, তাদের ভোটকেন্দ্রে হাজির করতে পারলে ভোটার শতাংশ নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আওয়ামী লীগের পাশাপাশি অন্য দলের ভোটারা তো আছেই।

এ মূহূর্তে এটা বলা যেতে পারে বিএনপি ও তাদের মিত্ররা যা করতে চেয়েছিল তা করতে ব্যর্থ হয়েছে। সামনের নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশ না নেয় ধরে নিতে হবে রাজনীতিতে তাদের চলার পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে গেল। একেবারে বিএনপির প্রতি অন্ধ আনুগত্য না থাকলে এই বাস্তবতা স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে, বর্তমানের অপরিণামদর্শী নেতৃত্ব দিয়ে বিএনপি খুব বেশি দূর যেতে পারবে না। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর জিয়ার হরেক রকমের অনিয়মের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা বিএনপি নামক দলটি তারই সন্তান তারেক রহমানের হাতেই মৃত্যু হচ্ছে। তবে তারেক রহমানের তাতে কোনো ক্ষতি নেই, কারণ তিনি লণ্ডনে আরাম-আয়েশে বসবাস করার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে রেখেছেন।

৭ জানুয়ারির আগে দেশে জনমানুষের বিশেষ করে যারা প্রার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতে হবে। বিএনপি ও তাদের মিত্রদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তারা যেকোনো হঠকারী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করবে না। তারা জড়িয়ে যেতে পারে নানা রকমের অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে, যার কিছু আলামত ইতোমধ্যেই দেখা গেছে। দুর্বৃত্তদের কঠোর হস্তে দমন করার দায়িত্ব সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর।

লেখক : শিক্ষাবিদ, বিশ্লেষক ও গবেষক


« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত