অভিনয় ক্যারিয়ারে সালমান শাহ অল্প সংখ্যক টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করলেও চলচ্চিত্রে তার অভিনয় নৈপুণ্যতা আর নিজস্বতা দিয়ে দর্শক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিলেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের হাত ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করার সু্যোগ পান সালমান শাহ।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান আনন্দ মেলা তিনটি হিন্দি সিনেমা ‘সনম বেওয়াফা’, ‘দিল’ ও ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’-এর কপিরাইট নিয়ে সোহানুর রহমান সোহানের কাছে যায়। এই তিনটি সিনেমা থেকে যেকোনো একটি বাংলা ভাষায় পুনর্নির্মাণ করার জন্য বলা হয় এই নির্মাতাকে। কিন্তু তিনি উপযুক্ত নায়ক-নায়িকা খুঁজে না পেয়ে সম্পূর্ণ নতুন মুখ নিয়ে সিনেমা নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
নায়িকা হিসেবে বেছে নেন মৌসুমীকে। কিন্তু নায়ক খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন চিত্রনায়ক আলমগীরের সাবেক স্ত্রী খোশনুরের মাধ্যমে ইমন নামে একটি ছেলের সন্ধান পান এই নির্মাতা।
প্রথম দেখাতেই ইমনকে পছন্দ করে ফেলেন পরিচালক। তারপর সালমান শাহকে নিয়ে সোহানুর রহমান সোহান ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। ইমন নাম পরিবর্তন করে সালমান শাহ নামে চলচ্চিত্রাঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করেন তিনি।
এ সিনেমা মুক্তির পরই জনপ্রিয়তার তুঙ্গে চলে যান সালমান শাহ। তার অভিনীত ২৭টি সিনেমার মধ্যে ১৪টি সিনেমায় জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শাবনূরের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে পর্দায় হাজির হন। সালমান শাহ অভিনীত সিনেমা হলো- ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘তুমি আমার’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘সুজন সখী’, ‘বিক্ষোভ’, ‘স্নেহ’, ‘প্রেম যুদ্ধ’, ‘দেন মোহর’, ‘কন্যাদান’, ‘স্বপ্নের ঠিকানা’,‘আঞ্জুমান’, ‘মহা মিলন’, ‘আশা ভালোবাসা’, ‘বিচার হবে’, ‘এই ঘর এই সংসার’, ‘প্রিয়জন’, ‘তোমাকে চাই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘জীবন সংসার’, ‘মায়ের অধিকার’, ‘চাওয়া থেকে পাওয়া’, ‘প্রেম পিয়াসী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘শুধু তুমি’, ‘আনন্দ অশ্রু’ ও ‘বুকের ভিতর আগুন’।
মৃত্যুর আগে যাকে খুঁজেছিলেন সালমান শাহ
স্বপ্নের নায়ক খ্যাত সালমান শাহর খুব কাছের একজন মানুষ ছিলেন চার দশকের বেশি সময় ধরে মঞ্চ, টেলিভিশন নাটকের জনপ্রিয় অভিনেতা তুষার খান। মৃত্যুর আগের দিন অনেক ব্যাকুল হয়ে তুষারকে খুঁজেছিলেন সালমান। সময়ের বিশেষ আড্ডায় এমনটাই জানান অভিনেতা। ‘বিক্ষোভ’ সিনেমাসহ বেশ কিছু সিনেমাতে সালমান শাহর সঙ্গে কাজ করার সুযোগ ঘটেছিল তুষারের। সেই থেকেই তুষারের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে সালমানের।
সালমানের মৃত্যু প্রসঙ্গে তুষার বলেন, সালমানের যখন মন খারাপ থাকতো তখন প্রায়ই আমার সঙ্গে কথা বলতো। আমাকে টেলিফোনে বলতো, আমার ভালো লাগছে না। আমি তোমার বাসায় আসব। ওর ফোন পেয়ে আমি কোথাও আর বের হতাম না। আমরা একসঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলতাম। এতে অনেকেটাই ও ফ্রেশ অনুভব করতো। পরদিন আবারও ফুরফুরে মেজাজে অভিনয় সেটে দেখতাম ওকে।
তুষার আরও বলেন, সালমান যেদিন মারা যায় তার আগের দিন আমি আমেরিকা থেকে দেশে ফিরি। বিকেলে আমার আর ওর ‘প্রেমপিয়াসী’ সিনেমার ডাবিংয়ের কাজ ছিল। ডাবিংয়ে যাওয়ার আগে আমি আমেরিকা থেকে আনা একটি পার্সেল আমার আত্মীয়ের বাড়িতে দিতে যাই। আমি এত ক্লান্ত অনুভব করি যে, সে আত্মীয়ের বাড়িতে পার্সেল আর শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমিয়ে পড়ায় তারাও আমায় আর ডাকেনি।
মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ার সময় মনে করে তুষার বলেন, আমার ঘুম ভাঙে রাত পৌনে ১১টায়। সেদিন আর ডাবিংয়ে যাইনি। পরদিন সকাল বেলা পরিচালক চাষী নজরুল ইসলামের মেয়ে আন্নি আমাকে ফোন দিয়ে জানায়, সালমান সুইসাইড করেছে। আমি তখন বিষয়টা মেনে নিতেই পারিনি। আন্নিকে আমি আবার বলি, ও কি মারা গেছে। আন্নি জানায়, হ্যাঁ, এখন মেডিকেলে। আমি সাথে সাথে সেখানে চলে যাই।
এরপরই আফসোস করে তুষার বলেন, হাসপাতালে পরিচালক রেজা হাসমত আমাকে দেখে বলেন, কালকে আপনি কই ছিলেন? আমি বললাম কেন? তখন রেজা জানান, গতকাল ডাবিংয়ের সময় সালমান খুব আপসেট ছিল। আপনাকে অনেক খুঁজেছে। ফোন করেছে। ফোনে না পেয়ে আপনার বাসায় লোক পাঠিয়েছে।
এমন কথা শোনার পর আমার প্রায়ই মনে হয়, ও হয়তো অন্যদিনের মতো আমার কাছে কিছু কথা শেয়ার করতে চেয়েছিল। হয়তো আমার সাথে কথা বলার পর ওর মনটা আবার ফ্রেশ হয়ে যেত। এমন দুর্ঘটনা হয়তো ঘটত না। আমার এখন মনে হয়, আমি ওইদিন কেন আত্মীয়ের বাসায় ঘুমিয়ে পড়লাম! এই কষ্টটা আমার সারাজীবন থাকবে। হয়তো আমি সেদিন না ঘুমিয়ে পড়লে আজও আমাদের মাঝে সালমান শাহ থাকতো। এত দর্শকের মন ভেঙে যেত না!