সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢু মারলে চোখে পড়ছে সেভেন সিস্টার্স নিয়ে নানা ধরনের মিম, স্লোগান ও মন্তব্য। অনেকের উপস্থাপনার ঢং এমন যেন সবাই সব জান্তা শামসের। যখন কোনও সম্মলিত ন্যারেটিভ বা দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে সৃষ্টি হয় তখনই এর প্রকৃত পরিণতি বুঝা যায়। আঁচ করা যায় ঘটনাটির সঠিক গতিপথ। সেভেন সিস্টার্স নিয়ে প্রচারণা হচ্ছে ঠিক তেমন কৌশলে।
বিষয়টা এমন যে সেভেন সিস্টার্স ভাঙ্গলে বাংলাদেশ অনেক বেশি উপকৃত হবে। এই নিয়ে কিন্তু মূল ধারার গণমাধ্যম ও প্রচারে পিছিয়ে নেই। আসলে আমরা কি এর গ্রাউন্ড জিরো রিয়েলেটি জানি? নাকি অতি উৎসাহী জনতার মতো স্রোতে গা ভাসায়?
বাংলাদেশের সাথে ভারত পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমানা ভাগাভাগি করে আসছে। এর মধ্যে ভারতের সেভেন সিস্টার্স বা সাত রাজ্যের সাথে সীমান্ত আছে প্রায় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিলোমিটার।
আসলে বাংলাদেশের সাথে ভারতের যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ স্থলসীমান্ত রয়েছে তার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই কিন্তু এই সেভেন সিস্টার্সের সঙ্গে যুক্ত। আরও নির্দিষ্ট করে বললে সাতটি রাজ্যের মধ্যে চারটি রাজ্য – আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরামের সাথে সরাসরি সংযুক্ত আছি আমরা।
মূলত ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্যগুলোকে একসাথে বুঝাতে সেভেন সিস্টার্স কথাটি ব্যবহৃত হয়ে আসছে ঐতিহাসিক কাল থেকে। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে অতীতে সেভেন সিস্টার্স-ভুক্ত ভারতের বিভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী ও সশস্ত্র স্বাধীনতাকামীরা এদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে অবাধে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো।
আবার যখন ওই নেতাদের বাংলাদেশ সরকার ভারতের হাতে তুলে দিতো তখনই তাদের সক্রিয়তাতেও দেখা যেতো উল্টো পুরান। তাইতো সুনিশ্চিত ভাবে বলা যায় সেভেন সিস্টার্সের সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল পরিপূরক বাতাবরণের মতো। ভারতের এই অঞ্চলটির সাথে আমাদের রয়েছে স্ট্র্যাটেজিক লিভারেজ বা কৌশলগত ভূমিকা। মজার বিষয় হলো সেভেন সিস্টার্সের সাথে ভারতের সীমানা মাত্র এক শতাংশ তাও শুধু চিকেন নেক বা শিলিগুড়ি করিডোর দিয়ে এবং বাকি ৯৯ শতাংশ চীন, ভুটান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর সাথে।
সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের মণিপুর ও মিয়ানমারের চিন প্রদেশের ঘটনাবলি বৈশ্বিক রাজনৈতিক সমীকরণের হিসাব নিকাশ সব পাল্টে দিচ্ছে মুহূর্তে। অতীতে সেভেন সিস্টার্সের রাজ্যগুলো জাতিগত ও ধর্মীয় মেরুকরণে একে অপরের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত ছিল। এখন যে এসব নেই তাও কিন্তু নয়। বিশেষ করে গত বছর থেকে চলমান মণিপুর দাঙ্গায় হিন্দু মেইতেইদের হাতে খ্রিস্টান কুকিরা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা এবং বিগত বছরগুলোতে ভারত সরকারের বৈষম্য দমন নীতিতে একটি নীরব জাগরণের ঢেউ তৈরি হয়েছে এই জনপদে।
আবার মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চীন প্রদেশের যুদ্ধরত স্বাধীনতা সংগ্রামী গোষ্ঠীর সাথে মিজোদের সহানুভূতির ডালি সৃষ্টি করেছে নানা রহস্যের। ভূরাজনীতিতে ঘুরে ফিরে আসছে পুরনো মডেলের রসায়ন। সামনে আসছে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার সুপ্রাচীন দাবি। আদৌ কি এ অঞ্চলে খ্রিষ্টান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? যুক্তিতর্ক হয়তো অনেকেই নিজেদের মতো করে উপস্থাপন করবে। কিন্তু বাস্তবতা উপলব্ধি করতে প্রয়োজন গভীর অনুসন্ধান।
এই জনপদে খ্রিস্টান রাষ্ট্রের গুঞ্জনটা অবশ্য এমনি এমনি তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে গভীর যুক্তি, জাতিগত ভাবাবেগ ও বহুমাত্রিক পরিসংখ্যান। আন্তর্জাতিক প্রভাবের কথা না হয় বাদই দিলাম। এ গুঞ্জনের ভরকেন্দ্র রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জনপদগুলো। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারের মতো দেশের কিছু ভূরাজনৈতিকভাবে কৌশলগত সুনির্দিষ্ট এলাকা। যেমন মিয়ানমারের প্রান্তিক অঞ্চল দক্ষিণ-পূর্বের কারেন, উত্তরের কাচিন এবং পশ্চিমের চীন অঞ্চল।
এই তিন এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ সবচেয়ে বেশি সুসংগঠিত এবং এই তিন অঞ্চলে খ্রিস্টান ধর্মবিশ্বাসের মানুষও অনেক বেশি। বিশেষ করে চীন এলাকায় ৯৬ শতাংশ মানুষ খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। আবার ভারতের উত্তর–পূর্ব জনপদগুলোর মধ্যে মেঘালয় (৭১ শতাংশ), মিজোরাম (৮৭ শতাংশ) এবং নাগাল্যান্ডে (৮৮ শতাংশ) খ্রিস্টানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।
এর পাশাপাশি মণিপুর ও অরুণাচলে খ্রিস্টান জনসংখ্যা রয়েছে (৪১ ও ৩০ শতাংশ)। ভারতের মিজোরাম ও মিয়ানমারের চীনসংলগ্ন বাংলাদেশের বান্দরবানের সীমান্তবর্তী উপজেলা (রুমা, থানচি, রোয়াংছড়ি) খ্রিষ্টানধর্মালম্বীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি চোখে পড়ে। পরিসংখ্যান বলছে শুধু বান্দরবানে খ্রিষ্টান জনসংখ্যা (১০ শতাংশের) মতো। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রকাশিত জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২-এর প্রাথমিক প্রতিবেদন অন্যুায়ী তিন পার্বত্য জেলা তথা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি এবং বান্দরবান জেলার জনসংখ্যা অবাঙালি/ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা ৯২০২১৭ (৪৯.৯৪ শতাংশ ) জন।
সেভেন সিস্টার্সের সাথে কাছাকাছি থাকা মিয়ানমারের কারেন, কাচিন, সাগাইং ও চীন এলাকার আয়তন প্রায় পৌনে তিন লাখ বর্গকিলোমিটার। আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আয়তন প্রায় তেরো-চৌদ্দ হাজার বর্গকিলোমিটার। সব মিলে তাদের প্রস্তাবিত মানচিত্রে এই পুরো ত্রিদেশীয় জনপদের আয়তন প্রায় পাঁচ লাখ বর্গকিলোমিটারের বেশি। তাহলে বুঝা যাচ্ছে এই চর্চিত জনপদগুলো একসাথে রেখা টানলে কত বিশাল আয়তনের ভূখণ্ডের জন্ম হয়।
বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের কিছু কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করে আসছে জুম্মল্যান্ড নামক একটি পৃথক রাষ্ট্রের। যদিও এর স্বপক্ষে আওয়াজ খুব কম। এটা ভুলে যাওয়া চলবে না যে তাদের কিছু স্বাধীনতাকামী এটাকে কিন্তু এখনও হৃদয়ে ধারণ করে। তাছাড়া আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামে কেএনএফের মতো গেরিলা সংগঠনও কিন্তু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। তাদের সহিংসতা কেমন ছিল তা আমার কিছুদিন আগেই প্রত্যক্ষ করেছি। কারা তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিল? দুইয়ে দুইয়ে চার সমীকরণ মিলালে উত্তরটা ঠিকই পেয়ে যাবেন।
মোদ্দা কথা সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের চলতি গৃহযুদ্ধ, ভারতে কুকি-চিনদের বিদ্রোহ এবং এই জনপদে প্রতিনিয়ত জাতিগত সংঘাত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় খ্রিস্টান রাষ্ট্রের গুঞ্জনে একধরনের উসকানি হিসেবে কাজ করছে বলা যায়। আবার এই জনপদে কিছু এলাকায় খ্রিষ্টধর্মালম্বীদের রয়েছে রাজ্য চালানোর অভিজ্ঞতা ও প্রতক্ষ্য অভিলাষ। তবে এটা ঠিক এই জনপদগুলো আয়তনে অনেক বড় হলে কিন্তু লোকসংখ্যায় কম। সবমিলিয়ে খ্রিস্টান রাষ্ট্র গঠনের দাবি যে অমূলক, তা একেবারে শূন্য উড়িয়ে দেবার মতো নয়। প্রাসঙ্গিকতা রয়েছে সরল সমীকরণে।
প্রাকৃতিক নিয়ম বলুন আর রাজনৈতিক সত্তাগত নিয়ম বলুন পৃথিবীতে নিজেদের প্রয়োজনে বড় বড় রাষ্ট্রগুলো ছোট ছোট টুকরো হয়ে গেছে। ঠিক যেমন রাশিয়া টুকরো টুকরো হয়ে গেছে ভারতও হয়েছে। ভারত যে আর ভাঙবে না এটা কিন্তু হলফ করে বলা যাচ্ছে না এখনই। এটা ঠিক ভারত ভাঙলে আমাদের খুশি লাগে। হওয়ারই কথা। বিগত দিনে অসম কূটনৈতিক শিষ্টাচার, বড় ভাই সুলভ ব্যবহার, কর্তৃত্ববাদী আচরণ ও বাণিজ্য ঘাটতির কারণে এদেশে সাধারণ মানুষের মনে জনরোষ সৃষ্টি হয়েছে। তাই ভারত বিরোধী যে কোনও তথ্যে বা খবরে আমাদের মন খুব আন্দোলিত হয়।
কিন্তু ভুলে যাওয়া চলবে না যে সেভেন সিস্টার্স একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর এলাকা। বিতর্কের জন্য ধরে নিলাম যদি কুকিরা স্বাধীনতা আদায় করে ফেলে তাহলে একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন কুকিদের যে নিজস্ব রাষ্ট্রের মানচিত্র আছে তাতে কিন্তু বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলও যুক্ত রয়েছে। যদি এই সেভেন সিস্টার্স কোন কারণে ভাঙে কিংবা আগুন জ্বলে তাহলে এর রেশ আমাদের দেশেও সরাসরি আছড়ে পড়বে।
কুকিদের দীর্ঘদিনের পুরনো এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যে কোনও মূল্যে চাইবে ভারত থেকে তাদের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিতে। অনেকে পাল্টা প্রশ্ন করতে পারেন কেন কুকি-চিনদের নিশানা বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চল? আবার তর্কের খাতিরে বলতে পারেন যে আমাদের পার্বত্য অঞ্চলে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সংখ্যায় তো খুব নগণ্য। এত কম জনসংখ্যা দিয়ে কি পার্বত্য এলাকা দখল করা সম্ভব।
আসলে সেভেন সিস্টার্স এর পতন শুরু হলে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম কোনোভাবে তা সামাল দিতে পারবে না। অনেকটা নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায় এই নীতির মতন। যদিও এর পেছনে রয়েছে বেশ একাট্টা যুক্তি। যেমন, আমাদের পাহাড় যে খুব শান্ত প্রিয় এটা কিন্তু ঢালাও ভাবে বলা যাবে না। বিগত কোনও সরকারই পাহাড়িদের সুরক্ষায় তেমন লক্ষণীয়ভাবে কোনও কাজ করেনি। বরং জিইয়ে রেখেছে পাহাড়ি বাঙালি সংঘাত। যুগ যুগ ধরে তারা হয়ে এসেছে বৈষম্যের শিকার।
রাষ্ট্রের বাহিনী দিয়ে তাদেরকে করা হয়েছে প্রতিঘাত। তাদের আন্দোলনকে চেষ্টা করা হয়েছে বারবার দমিয়ে রাখার। পাহাড়ীরা যে এটাকে খুব ভালো চোখে দেখছে তা কিন্তু নয়। পাহাড়ে অসন্তোষ যেমন আছে আবার ইন্ধন ও আছে। কৌশলে না এগোলে বড় ধরনের খেসারত দিতে হবে আমাদেরকে। এখন আমাদের কি উচিত কুকিদের স্বাধীনতার সমর্থন দেওয়া? নিজেদের পার্বত্য অঞ্চল অশান্ত করে কি অন্যের যাত্রাভঙ্গ করা আদৌ মোক্ষম কাজ হবে আমাদের?
সময় এসেছে এই বিষয়গুলো নিয়ে গভীরভাবে ভাববার। খুব দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার সহিত আমাদের অমীমাংসিত বিষয়গুলো সুরাহা করতে হবে। যদি ব্যর্থ হয় তাহলে অন্তর্ঘাতে পড়তে হবে রাষ্ট্রকে।
লেখক : গণমাধ্যম শিক্ষক ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক