"প্রেমের ক্ষেত্রে আমি সারমেয়র মতো, যে লাথি খেয়েও আবার পিছন পিছন হাঁটে!" বললেন ।
শুধু অভিনয় নয়, স্পষ্ট মতামতের জন্যও শিরোনামে আসেন ঋতাভরী চক্রবর্তী। এ বার পুজায় মুক্তি পাচ্ছে তাঁর ছবি ‘বহুরূপী’। ছবি নিয়ে তাঁর উত্তেজনা স্পষ্ট, কথা বলতে বলতেই তা প্রকাশ পেল।
ঋতাভরী: একদমই তাই। আমার চরিত্র ‘পরী’ তেমনই। সে জীবনের কিছু চড়াই- উতরাই নিয়ে বড় হয়েছে। ওকে দেখে বেশ মিষ্টি মনে হচ্ছে। সবটাই সে রকম নয়। সেটাই চমক। পরীর গোটা জীবন বরকে কেন্দ্র করে। বর ছাড়া ওর এক মুহূর্ত চলে না। কাজের বাইরে বর সময় না দিলে সে রেগে আগুন হয়ে যায়। আজকাল এমন তীব্র ভালবাসা দেখা যায় না। নন্দিতাদি, শিবুদা এই চরিত্রের কথা বললে ভেবেছিলাম এত কঠিন চরিত্র আমার কাছে এল! নিশ্চয়ই ওয়ার্কশপ করতে হবে? কিন্তু শিবুদা, নন্দিতাদি বলে দিলেন, ‘‘তুমি যেমন, তেমন ভাবেই কাজ করো।’’ চরিত্রটা সহজ নয়। দর্শক যদি বুঝতে পারে এই চরিত্রের স্তরগুলি, তা হলে আমার অভিনয় সার্থক।
প্রশ্ন: আপনার ও আবীরের জুটির সঙ্গেই ছবির আরও এক জুটি শিবপ্রসাদ-কৌশানী। দর্শকের নজর কি ভাগ হয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছে?
ঋতাভরী: আমি ভাগাভাগিতে বিশ্বাস করি না। পরিবারে বাবা-মা থাকলে কি ভাগাভাগির বিষয় আসে? সবাই থাকলে বলা হয় একান্নবর্তী পরিবার। এটা আমাদের একান্নবর্তী ছবি (হাসি)। আমি এই ধরনের প্রতিযোগিতায় বিশ্বাস করি না। এর আগেও অনুষ্কা শর্মার সঙ্গে ‘পরী’ তে অভিনয় করেছি। কোয়েলদির সঙ্গে ‘শেষ থেকে শুরু’ ছবিতে কাজ করেছি। আমার এই ধরনের নিরাপত্তাহীনতা নেই। অভিনয় ভাল করাই মূল লক্ষ্য। ছবিতে এক জন নায়িকা না কি পাঁচ জন নায়িকা আছে, সেটা বিষয়ই না। এমন একটা চরিত্রে কাজ করতে পারাই বড় কথা। কৌশানী-শিবুদার জুটিটাও খুব মিষ্টি লাগছে। দুটো জুটি ভিন্ন সামাজিক স্তর থেকে এসেছে। পার্থক্য থাকলেও প্রেমটা সমান। সেটাও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রশ্ন: আপনিই বলেছিলেন, আবীর আপনার ক্রাশ...
ঋতাভরী: আবীরদাকে যখন চিনতাম না, তখন ওঁর উপর ক্রাশ ছিল। এখন আর ওর উপর একবিন্দুও ক্রাশ নেই। ‘ফাটাফাটি’ ছবির সময় থেকেই সেই অনুভূতি উধাও। একটা মানুষকে পর্দায় দেখলে কিছু ধারণা তৈরি হয়। যেমন আবীরদাকে ‘ব্যোমকেশ’-এর মতোই মনে হয়েছিল। পরে বুঝলাম, তিনি ‘ব্যোমকেশ’ নন, আবীর চট্টোপাধ্যায়। তবে সহ-অভিনেতা হিসাবে আবীরদা অসাধারণ। ওঁর সঙ্গে কাজ করতে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।
প্রশ্ন: বেশ কিছু ঘনিষ্ঠ দৃশ্য রয়েছে আপনাদের। কোনও আড়ষ্টতা কাজ করেনি?
ঋতাভরী: আবীরদাও আমার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ। সেই বোঝাপড়া রয়েছে। না হলে আমাদের জুটিটা এতটা এগিয়ে যেত না। আমরা তো উত্তমকুমার-সুচিত্রা সেন অথবা শাহরুখ খান-কাজলের মতো জুটি নই। তাই প্রতি বারই আমাদের রসায়ন তৈরি করতে হয়। রণবীর সিংহ ও দীপিকা পাড়ুকোন যেমন বাস্তবেও যুগল। তাই মানুষের ওঁদের নিয়ে একটা ধারণা রয়েছে। কিন্তু আমাদের সেটা তৈরি করতে হয়। আবীরদার একটা জগৎ আছে স্ত্রী ও পরিবার নিয়ে। আমার একটা অন্য জগৎ রয়েছে। মানুষ হিসাবেও আমরা ভিন্ন। কিন্তু পরস্পরের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল ও স্বচ্ছন্দ। আর ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করতে পেরেছি কারণ আমি বা আবীরদা কেউই কামযন্ত্রণায় ছটফট করি না (হেসে)। তাই এই দৃশ্যগুলিতে পরস্পরের স্পর্শে কখনও অস্বস্তি হয়নি। ‘ফাটাফাটি’-তেও স্বামী-স্ত্রীর রসায়ন ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলাম এই বোঝাপড়া আছে বলে। আমি নিজেও আমাদের জুটিকে দর্শক হিসাবে দেখেছি। এটুকু বলতে পারি, বুম্বাদা-ঋতুদির পরে আমি নিজেদের জুটির মধ্যে সেই রসায়ন খুঁজে পেয়েছি। সত্যিই যেন দুটো মানুষ পরস্পরকে ভীষণ ভাবে চায়।
প্রশ্ন: ‘অযোগ্য’ ছবির শেষে প্রসেনজিৎ-ঋতুপর্ণা জুটির চুম্বনদৃশ্যের জন্য কিন্তু দর্শকেরা অপেক্ষা করেছিলেন...
ঋতাভরী: হ্যাঁ, একদমই তাই। ওঁদের জুটির সেই আকর্ষণ এখনও একই রকম আছে। এমনই রসায়ন যে, ওঁদের জুটিকে দেখিয়ে এখনও ব্যবসা করা যায়। আমি নিজেও তো পরমব্রত, জিৎ, আরও অভিনেতাদের সঙ্গে জুটি বেঁধেছি। কিন্তু আবীরদার সঙ্গে রসায়ন অনেক বেশি শক্তিশালী। দর্শকও আমাদের দু’জনকে দেখতে ভালবাসেন।
প্রশ্ন: আপনাকে সেই ভাবে টলিপাড়ার অনুষ্ঠানে দেখা যায় না। নিয়ম করে প্রতি বছর নির্দিষ্ট সংখ্যায় ছবিও আপনি করেন না। কাজ নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
ঋতাভরী: আমার কখনওই কোনও পরিকল্পনা ছিল না। সব সময় আমি সময় ও জীবনের পরিস্থিতি অনুযায়ী চলি। অনেকের কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে। আমার এমন কিছু ছিল না। ঘটনাচক্রে আমি ‘ওগো বধূ সুন্দরী’-তে অভিনয় করা শুরু করি। ভাল কাজ এলে আমি করেছি। আমি আসলে জীবনটাকে সব দিক থেকে উপভোগ করতে ভালবাসি। শুধু কাজ নয়। প্রেম, পরিবার, সামাজিক কাজ, পড়াশোনা করা অথবা দুনিয়া ঘুরে দেখা সবটাই করতে চাই। ইন্ডাস্ট্রি আমার উপার্জনে তেমন সাহায্য করে না বলে নিজের ব্র্যান্ডিংয়ের কাজটাও মন দিয়ে করি। আমি দেশ- বিদেশে ঘুরতে ভালবাসি। কিছু দামি স্বভাবও আছে। তাই বিজ্ঞাপনের কাজ বা সমাজমাধ্যমের কাজও রয়েছে। আমাকে এগুলো করে দেওয়ার কেউ নেই। আবীরদা যেমন বলল, নিজের ক্রেডিট কার্ড বৌকে দিয়ে দেয় কেনাকাটা করার জন্য। আমার তেমন প্রেমিক নেই। থাকলে আমার কেনাকাটার পাগলামিতে সে শেষ হয়ে যেত । আমি কেনাকাটা করতে খুব ভালবাসি (হাসি)। নিজেকে মানুষ হিসাবেও উন্নত করতে চাই আমি। নিজের এত কাজ থাকে যে ইন্ডাস্ট্রির পার্টিতে যাওয়ার আর সময় পাই না। কাজ থেকে বাদ পড়ার সম্ভাবনা থাকলে অথবা কারও খুব খারাপ লাগলে তবেই আমি কোনও পার্টিতে যাই।
প্রশ্ন: এই ইন্ডাস্ট্রিতে মাথা উঁচু করে থাকা মেয়েদের কাজ পাওয়া বা টিকে থাকা তুলনামূলক ভাবে কঠিন?
ঋতাভরী: একদমই তাই। ইন্ডাস্ট্রিটা ছোট এবং কাজের সংখ্যা কম। বছরের শেষে আমি দেখি, কোন কোন ছবির কাজ আমি পেলে ভাল হত। গত কয়েক বছরে সেই সংখ্যাটা হাতেগোনা, কারণ কাজের গুণমান পড়েছে। সত্যিই দুঃখিত। অন্য অভিনেত্রীদেরও এমন ছবি দেখছি না, যা দেখে মনে হবে, এটা যদি আমি পেতাম। এমন অনেক কাজ আসে, যা আমি অনায়াসে ফিরিয়ে দিই। কিছু দিন আগেই এক বড় প্রযোজনা সংস্থার ছবিতে আমার কাছে ১৯ বছরের মেয়ের মা হওয়ার প্রস্তাব আসে। আমি সটান বলে দিয়েছি, দূর হয়ে যাও এখান থেকে। ছবির গুণমান তো দেখতে হবে। দর্শক আমাকে কী ভাবে মনে রাখছে, সেটা তো আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আবার এখন যদি আমাকে বলা হয় ‘হাউজ়ফুল ১৫’-এ কাজ করলে আমাকে ২০ কোটি টাকা দেওয়া হবে , তা হলে আমি সব ভুলে অভিনয় করতে চলে যাব (হাসি)। কিন্তু সেটাও কেউ বলছে না।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে তো খুব ভাল কাজের ধারা। ওটিটিতে বহু কাজ হচ্ছে...
ঋতাভরী: আসলে ২০২১-এ পর পর দুটো অস্ত্রোপচার হওয়ার পরে কলকাতাতেই বেশি সময় কাটছিল। তাই মুম্বইয়ে বান্দ্রার বাড়িটাও ছেড়ে দিই। তার পরে আবার গত বছর থেকে ফের বাড়িটা নিই এবং নতুন করে কাজের কথাবার্তা শুরু করি। এখন মুম্বইয়ে কাজের পরিস্থিতি আরও ভাল আমার জন্য। বর্তমানে তারকা সন্তানদের থেকে অন্যদের সুযোগ বেশি। ধীর গতিতে হলেও, কাজ আসছে হাতে। কিছু দিন আগেই মালয়ালম ছবিতে কাজ করে এসেছি। ভাল কাজ পেলে অবশ্যই করব। দিনের শেষে কোনও কাজ করে এমন যেন মনে না হয়, এই কাজটা কেন করলাম। অভিনয়, মিনিয়েচার বানানো এবং প্রেম— এই তিনটে বিষয় আমাকে সবচেয়ে আনন্দ দেয়।
প্রশ্ন: প্রেম! তাঁর কী খবর?
ঋতাভরী: (হেসে) কোন তার! সে তো সেতার হয়ে গিয়েছে! সেই ডাক্তারবাবুর সঙ্গে বিয়েটা করছি না। একটা প্রেম আছে জীবনে। তবে এই মুহূর্তে সেটা নিয়ে কথা বলার মতো জায়গায় পৌঁছয়নি। সময় হলে তো আপনারা জানতেই পারবেন। প্রেমের প্রতি আমার অগাধ বিশ্বাস। প্রেমের ক্ষেত্রে আমি ওই সারমেয়র মতো, যে লাথি খেয়েও আবার পিছন পিছন হাঁটে। মজা করছি! প্রেম ভেঙে গেলেও বন্ধুত্ব থাকে। তথাগতের সঙ্গে আমার এখনও বন্ধুত্ব রয়েছে। অসুস্থ হলে কিন্তু ও এখনও খোঁজ নেয়।
প্রশ্ন: অভিনেতাদের কি বিয়ে করা উচিত?
ঋতাভরী: কী করে বলি! শাহরুখ খান আছেন। কিন্তু তিনি তো একটাই। তবে কেরিয়ার ত্যাগ করে কখনওই বিয়ে করা উচিত নয়। আমি তো দেখেছি, যার জন্য মানুষ কাজ ছেড়ে দিল, তাকেই শেষে ভুলে গেল। এই রূপ-যৌবন কত দিন থাকে! ওই জন্যই আমি এখনও বিয়ে করিনি। ভুল মানুষকে বিয়ে করতে চাই না। তবে আমার দিদি ও সম্বিতের বিয়েটা দারুণ। ওরা পরস্পরের সবচেয়ে ভাল বন্ধু। তখন মনে হয় বিয়েটা সুন্দর। ঠিক সময় সংসার করতে চাই ঠিকই, কিন্তু মেয়েদের জন্য কোনটা ঠিক সময়, জানি না। বিয়ের বয়সটা কী হয়, তা-ও জানি না।