বাংলাদেশ নির্বাচনোত্তর একটা সময়ে এসে পৌঁছেছে। নতুন সরকার গঠন করা হয়েছে। সরকারের সামনে একটা গুরু দায়িত্ব আছে। সরকারের মেয়াদকালের প্রথম দিক থেকে সার্বিকভাবে উন্নয়ন নীতি এবং কৌশল বিষয়ে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে এই নিবন্ধে আমি মোটাদাগে কতগুলো বিষয়ে দৃষ্টিপাত করব। আমার মনে হয়, সরকারের প্রথম দিকেই রাজনৈতিক অন্যান্য নীতি-কৌশল ছাড়াও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রথম ১০০ দিনের মধ্যে কতগুলো পরিকল্পনা ও নীতির ব্যাপারে ধারণা দিতে হবে। হয়তো বাস্তবায়নে সময় লাগবে। প্রথমত, আমাদের চারটি বিষয়ের ওপর নজর দিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। রাজনৈতিক সরকার এসেছে। তারা দেশ পরিচালনা করবে। কিভাবে সরকার চালাবে, কিভাবে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করবে, অভ্যন্তরীণ সমস্যা কিভাবে দূর করবে—এ ব্যাপারে বাস্তবসম্মত ধারণা জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের উন্নয়ন নীতি ও কৌশল সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখানে চারটি জিনিস উল্লেখযোগ্য। এক. উন্নয়ন নীতি কী হবে। দুই. কী কী কৌশল নেবে। তিন. বাস্তবায়নে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কী করবে। চার. রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এই চারটি ছাড়া কোনো নীতি ও কৌশল যথাযথ বাস্তবায়িত হবে না।
উন্নয়ন নীতি এবং কৌশল সম্পর্কে কথাএত দিনের যে চ্যালেঞ্জগুলো ছিল, সেগুলো এখনো রয়েছে। আমাদের সমস্যাগুলোর কিছু অভ্যন্তরীণ, কিছু বহির্বিশ্বের সমস্যা। আমাদের নীতি ও কৌশলে সীমাবদ্ধতা ছিল। এটিকে আমরা অনেক সময় বলি পলিসি-লিগ্যাসি। তার মানে পলিসি যদি ঠিকভাবে না হয়, সেটি বাস্তবায়ন করতে চাইলেও বাস্তবায়ন করা যাবে না। আরেকটি জিনিস হলো, পলিসি ঠিক নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সেগুলোর বাস্তবায়ন সঠিক হচ্ছে না। অতএব সঠিক নীতি নিতে হবে এবং কৌশলগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে। কৌশলের ব্যাপারে অনেকগুলো ভিশনের ওপর আমাদের কাজ করতে হবে। প্রথমত, সরকারের বিভিন্ন অর্গান বা অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হবে।
দ্বিতীয়ত হলো প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকরিতা। প্রতিষ্ঠান বলতে আমি বলি অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান। যেমন—বাংলাদেশ ব্যাংক, সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, বিআরটিএ এবং অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠান, যেগুলোকে নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বলি। এদিকে কতগুলো আছে উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠানÑ এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো আছে, বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটি (বিডা) আছে, এক্সপোর্ট প্রসেস জোন অথরিটি আছে। অতএব এদের যে আমরা দেখতে পাচ্ছি, এগুলোর কার্যকারিতার সীমাবদ্ধতা আছে। অনেক সময় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থাকে। সঠিক স্থানে সঠিক লোককে নিয়োগ করা এবং তাদের কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া, এর সঙ্গে সঙ্গে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা হয়ে ওঠে না।
তৃতীয়ত, রাজনীতিতে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন সঠিকভাবে হয় না। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা রাজনৈতিক প্রতিনিধিরা সংসদে জনগণের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরবেন।
এখানে কতগুলো জিনিসে আমি দৃষ্টিপাত করি, প্রথমত, উন্নয়নের নীতি ও কৌশলগুলো বদলাতে হবে। তার মানে আমরা এত দিন পর্যন্ত শুধু দেখছি, গ্রোথ বাড়বে, মানে অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বাড়বে, কিন্তু সেটির বণ্টন এবং এই জিনিসগুলোর প্রতি যথেষ্ট দৃষ্টি দেওয়া হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে শুধু অর্থনীতির উন্নয়ন বলতে আমরা বলছি, জিডিপি বাড়ল, দেশের উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ল, জনগণের মাথাপিছু আয় বাড়ল, কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, জনগণের অংশগ্রহণ, জনগণের কথা বলার অধিকার, জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলনÑ এগুলোর দিকে দৃষ্টি দেওয়া হয়নি।
জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এখন দ্রুত উন্নয়ন নীতি ও কৌশল বদলাতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, জাতীয় সংসদে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে। জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার যথাযথ বাস্তবে রূপ দিতে হবে।
দ্বিতীয়ত, মানবসম্পদ উন্নয়নে দৃষ্টি দিতে হবে। ১৭ কোটি মানুষের শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতার যদি উন্নয়ন না করি, তারা কিন্তু বিদেশে শুধু নয়, দেশেও সুষ্ঠু, সুন্দরভাবে ভালো কিছু করতে পারবে না। শিক্ষা, প্রশিক্ষণ বা ওরিয়েন্টেশন, যা-ই বলি না কেন, এটির দরকার। কৃষকদের স্কুলে আনতে হবে, প্রশিক্ষণ দিতে হবে তা নয়, এক্সটেনশন ওয়ার্কাররা তো গ্রামে-গঞ্জে গিয়েই কৃষি এবং লাইফস্টাইল স্কিলের অনেক উন্নতি করেছে। এর সঙ্গে আরো এক্সটেনশন ওয়ার্ক করা দরকার। কৃষক ও খামারিদের উন্নয়ন বলতে আমি বলছি, আরো প্রশিক্ষণ দরকার। অতিরিক্ত ফিন্যান্স বা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া দরকার। জাপানে শ্রমিকের প্রডাক্টিভিটি অনেক বেশি। কারণ তারা ফরমাল এডুকেশন—আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছাড়াও ব্যাবহারিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষায় অনেক এগিয়ে।
তৃতীয়ত, এটির সঙ্গে সংযুক্ত আছে শিক্ষা ও প্রযুক্তির যথাযথ প্রয়োগ। এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি সংযুক্ত। চতুর্থত, আমাদের শিল্প উন্নয়ন। শিল্প বলতে আমরা কিন্তু বেশির ভাগই মনে করছি, বড় বড় শিল্প। স্টিল ইন্ডাস্ট্রি, সিমেন্ট, ফার্মাসি ইন্ডাস্ট্রিÑ এগুলোর দরকার আছে। কিন্তু এগুলো যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের মতো একটি বিশাল জনসংখ্যার দেশে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের কিন্তু যথেষ্ট উন্নত হয়নি। সরকার কথাবার্তা বলছে, সরকারি সংস্থাগুলো কিন্তু অর্থায়ন করার ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য কিছু করছে না। উদাহরণস্বরূপ, জাপান, মালয়েশিয়া, কোরিয়ায় এই ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্পের কন্ট্রিবিউশন জিডিপিতে অনেক বেশি। প্রথম পর্যায়েই তাদের উন্নয়ন ছিল, এখনো কিন্তু অনেক বেশি। আমাদের ২০ থেকে ২৫ শতাংশের বেশি বোধ হয় নেই।
আমি মনে করি, বাংলাদেশে শিল্পায়নের কোনো বিকল্প নেই। কৃষি উন্নয়ন তো থাকবেই। কারণ আমাদের মূলই তো কৃষি। তবে শিল্পায়ন যদি না করি, তাহলে আমরা কেবলই আমদানি করতে থাকব। শিল্পায়ন হয়নি বলে রপ্তানি বহুমুখীকরণে আমরা খুব বেশি ফল পাইনি। প্রধানত রপ্তানি বহুমুখীকরণ না হওয়ায় শুধু আরএমজির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। জাপানে গাড়ি তৈরি হয়, সব কিছু কিন্তু বড় ইন্ডাস্ট্রিতে করা হয় না। গাড়ির যে পার্টস, সিট কাভার ইত্যাদি আছে, এগুলো ছোট ছোট কম্পানি তৈরি করে বড় কম্পানিতে সাপ্লাই করে। কোরিয়ায়ও এটি হয়েছে। ভারতেও শিল্পায়ন হয়েছে। তারা অনেক বড় বড় শিল্প করেছে, কিন্তু ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প করেনি। ফলে যে দেশগুলোর উদাহরণ দিলাম, তাদের তুলনায় কিন্তু ভারত তেমন এগিয়ে যায়নি। আমাদের অবস্থাও এ রকম হয়েছে।
সর্বশেষ হলো রপ্তানি বহুমুখীকরণ। এখানে নীতি, সরকারি নীতি, প্রণোদনা নীতি বা ব্যাংক ক্রেডিট দেওয়া—এগুলোর ব্যাপারে যথেষ্ট কিছু করা হয়নি। যেমন—আরএমজি উন্নতি করেছে কেন? আশির দশকে বন্ডেড ওয়্যারহাউস, ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় কিন্তু এত দূর এগিয়ে আসছে। প্রণোদনা কিছুটা মিসইউজ হয়েছে। কিছুটা নষ্ট হয়েছে। সরকারি দিক থেকে অনেক ব্যয় বহন করতে হয়েছে। এ জন্য আরএমজি এই পর্যায়ে এগিয়ে আসছে। এখন সময় এসেছে, অন্যান্য শিল্প; যেমন—প্লাস্টিক, সিরামিকস, চামড়া, ইলেকট্রনিক এবং অনুরূপ অন্য যেসব আছেÑ এগুলোর ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। এগুলোতে বহুমুখীকরণ না করলে চলবে না। দেশে ডলারের মূল্য বেড়ে যাচ্ছে, রিজার্ভ কমে যাচ্ছেÑ রপ্তানি বহুমুখী করলে বিরাট একটা আয় আমাদের কাছে চলে আসবে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। মূল্যস্ফীতি রোধে তারা কিছু ব্যবস্থা নিয়েছে, কিন্তু ডলার সংকট কাটছে না। এফডিআই বাড়ছে না। বাইরে থেকে রেমিট্যান্স কম আসছে। অন্যদিকে হুন্ডি হচ্ছে। মানি লন্ডারিং হচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের অবস্থার অবনতি হয়েছে। আমরা ক্যাশলেস সোসাইটি করতে চাইছি। ক্যাশলেস সোসাইটি মানে যত ক্যাশ কম হ্যান্ডেল করব, তত করাপশনটা কম হবে। অতএব উন্নত প্রযুক্তির মধ্য দিয়ে আমাদের ক্যাশলেস সোসাইটি গঠন করতে হবে। সেটা করতে হবে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে উন্নয়ন এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়িয়ে।
আরেকটা জিনিস, এখন পুঁজিবাজারে লোকজন যাচ্ছে না। বড় শিল্পগুলো এখনো ব্যাংকের ওপর নির্ভর করে। কিন্তু পশ্চিমা জগতে বড় শিল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নিতে হলে পুঁজিবাজারে যেতে হয়। কিন্তু আমরা সবাই ব্যাংকের ওপর নির্ভর করি। ব্যাংকেরও কিন্তু সীমাবদ্ধতা আছে। অনেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করে না। এতে আমানতকারীর টাকা হুমকির মুখে পড়ে। ফলে ব্যাংকের অবস্থা বিপর্যস্ত হয়।
এদিকে পুঁজিবাজারে গেলে তাদের ঝুঁকি নিতে হবে। কারণ তারা তো ইকুইটি হোল্ডার। তারা ইনভেস্ট করবে, শেয়ারহোল্ডার থেকে টাকা ওঠাবে। শেয়ারহোল্ডারের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। অতএব সেটা করলে কিছুটা হয়তো ফিন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট ভালো হবে।
সর্বশেষ বিষয় হলো প্রবৃদ্ধি। অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি কমবে। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক সে রকমই বলছে। সেদিক থেকে বাংলাদেশেও প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী হবে। কাজেই প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক মুদ্রানীতিতে ধরা হয়েছে ৬.৫ প্রবৃদ্ধি হবে। মূল্যস্ফীতি ৭.৫। আমার মনে হয়, তারা মোটামুটি একটা যুক্তিসংগত হিসাব করেছে। কিন্তু দেখতে হবে প্রবৃদ্ধি কমলেও প্রবৃদ্ধি কোন সেক্টর থেকে আসে। গুণগত দিকটা দেখতে হবে। প্রবৃদ্ধি যদি সার্ভিস সেক্টর থেকে আসে, প্রবৃদ্ধি যদি কাগজে-কলমে অঙ্কের হিসাবে বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠান থেকে আসে, সেই প্রবৃদ্ধি আমাদের জন্য তেমন অর্থবহুল নয়।
আমাদের প্রবৃদ্ধি আসতে হবে কৃষি, শিল্প, বাণিজ্যÑ মানে প্রডাক্টিভ সেক্টর থেকে। এবং যেখানে মানুষের কর্মসংস্থান বেশি হয়। যদি সেই দিক থেকে প্রবৃদ্ধি আসে, তবে মানুষের আয়ের সংস্থান হবে। কর্মসংস্থান হবে। সার্বিকভাবে মানুষের উপকার হবে। এবং এই পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয়, এখন সার্বিকভাবে যাচাই করে আমাদের পুরনো যে ধারণা, পুরনো যে নীতি-কৌশল, সেগুলো আমাদের পরিবর্তন করতে হবে। পরিমার্জন করতে হবে।
লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়