একসময় শহরে আমাদের চারপাশ অনেক সুন্দর ছিল। খোলা জায়গাতে বিশুদ্ধ বাতাস ছিল; খেলার মাঠে ছিল দুরন্ত শৈশবের উচ্ছলতা। অথচ আজ বেশিরভাগ খোলা জায়গাতেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা। গড়ে উঠেছে নানা ধরনের দোকান-গ্যারেজ-অফিস।
শুধু শহরেই নয়, গ্রামে-গঞ্জেও বেশিরভাগ জায়গায় কমে যাচ্ছে খেলাধুলার জায়গা। সেখানেও একই চিত্র বিরাজ করছে। সবকিছুই আজ স্বপ্নের মতো মনে হয়। মনে হয়, এই তো সেদিন আমাদের চারদিকে কী সুন্দর খোলামেলা জায়গা ছিল; সেখানে খেলাধুলার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা ছিল। মনের আনন্দে শিশুরা সেখানে খেলাধুলা করত। সত্যি কথা বলতে কীÑ আজ আমাদের এতটুকু জায়গার খুবই অভাব, যেখানে আমাদের সন্তানরা মনের আনন্দে খেলাধুলা করতে পারে। আমাদের একটাই প্রশ্নÑ এ কোন বাসযোগ্য পরিবেশ রেখে যাচ্ছি আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য! শুধু ঘরে বন্দি জীবন ছাড়া আর কী-বা দিতে পারছি আমরা আমাদের সন্তানদের!
নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতে, এখন শহরে ফাঁকা জায়গা কমে যাওয়ার মূল কারণ হচ্ছে অপরিকল্পিত নগরায়ন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) এক গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনে বর্তমানে মোট ২৩৫টি খেলার মাঠ রয়েছে। সেগুলোকে ধরণ অনুসারে পাঁচভাগে ভাগ করা হয়েছে। যেমন সরকারি উন্মুক্ত, সরকারি দখলকৃত, প্রাতিষ্ঠানিক, কলোনি এবং ঈদগাহ। এর মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক খেলার মাঠ রয়েছে ৬০ শতাংশ। বিআইপি দাবি করেছে, রাজধানীর মাত্র ৩০ শতাংশ খেলার মাঠে সর্বসাধারণের প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। বাকি ৭০ শতাংশ মাঠই দখলে রয়েছে। সম্প্রতি (৩০ আগস্ট ২০২৩) ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি), সেভ দ্য চিলড্রেন ও নগর উন্নয়ন সাংবাদিক ফোরাম বাংলাদেশ যৌথভাবে এক সংলাপের আয়োজন করে। সেখানে এক নিবন্ধে বলা হয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় সবার প্রবেশাধিকার আছে এমন মাঠের সংখ্যা মাত্র ৪২টি। ঢাকা শহরের মাত্র ১৬ ভাগ এলাকার মানুষ খেলার মাঠের আওতায় মধ্যে বসবাস করে। বাকি ৮৪ ভাগ এলাকার মানুষ খেলার সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ ২০০০ সালে সরকারের খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইনে বলা হয়েছেÑ ‘খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যাবে না।’
আমরা দেখতে পচ্ছি যে, রাজধানী ঢাকায় সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গা ক্রমাগত কমছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বলছে, গত ২৯ বছরে ঢাকায় সবুজ এলাকা ও ফাঁকা জায়গার পরিমাণ কমেছে প্রায় ২৩ বর্গকিলোমিটার। এর ফলে গ্রামের চেয়ে ঢাকায় গড়ে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশি থাকে। ঢাকা শহরের উষ্ণতম স্থান এবং শহরের বাইরের প্রাকৃতিক পরিবেশসমৃদ্ধ এলাকার মধ্যে দিন ও রাতে ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ এবং ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ঢাকা শহরে ২০ শতাংশ সবুজ এলাকার প্রয়োজন থাকলেও রয়েছে সাড়ে ৮ শতাংশের কম। ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার ৭-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের পার্থক্য পৃথিবীর যেকোনো পরিমাপের জন্যই ভয়ঙ্কর। দেখা গেছে, গ্রামের চেয়ে ঢাকা শহরে সাড়ে ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি তাপমাত্রা পরিমাপ করা হচ্ছে। তাপমাত্রার অনুভব তার চেয়েও বেশি। পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে ঢাকায় গরম অনুভূত হয় আরও বেশি। রোদে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় সবকিছু। একটুখানি ছায়াই যেন আমাদের আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। ছায়া ছাড়া ঢাকার প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে আমাদের বাঁচার কোনো উপায় নেই।
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ ২০২২-৩৫) অনুযায়ী, ঢাকার কেন্দ্রীয় অঞ্চলের পরিমাণ ১ হাজার ৫৩৬ বর্গকিলোমিটারের বেশি। এই অঞ্চলের মধ্যে ১৯৯৫ সালে সবুজ ও ফাঁকা জায়গার পরিমাণ ছিল ৫২ দশমিক ৪৮ বর্গকিলোমিটার। ২০২৩ সালে এসে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২৯ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার। ঢাকায় সাড়ে ১২ হাজার মানুষের জন্য ২ একরের সমপরিমাণ খেলার মাঠ এবং ১ একরের সমপরিমাণ পার্ক থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকার বর্তমান জনসংখ্যা বিবেচনায় ৩৭ হাজার ৯০০ জনে ১ একরের সমপরিমাণ খেলার মাঠ বা পার্ক রয়েছে, যা খুবই নগন্য। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশনের ১২৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪১টিতে কোনো খেলার মাঠই নেই। এক পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সারা দেশে গাছ কাটার ফলে ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সময়ে ২ লাখ ১৪ হাজার হেক্টর গাছের ছায়া হারিয়েছে। বিশ্বে ঘূর্ণিঝড়ের প্রকারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। আর সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে বজ্রপাতে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয় বাংলাদেশে। প্রতিদিন একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ৫০০ লিটার অক্সিজেন গ্রহণ করে, যা বিনামূল্যে গাছ থেকে পাওয়া যায়। এটি টাকায় হিসাব করলে প্রতিদিন ২৪ হাজার টাকার অক্সিজেন গ্রহণ করে একজন মানুষ। অথচ আমরা এসব চিন্তা না করেই নির্বিচারে গাছ কেটে চলেছি অনবরত। আবহাওয়ার অশনি সংকেত আমরা প্রায় প্রতিদিনই প্রত্যক্ষ করে চলেছি। অথচ আমরা যদি বৃক্ষরোপণের ক্ষেত্রে সাফল্যজনক দৃষ্টান্ত রাখতে পারি, তাহলে প্রকৃতির এ ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ ক্রমশ অপসারণ হবে এবং আমরাও সুনির্মল আবহাওয়া ও সুন্দর পরিবেশে আনন্দময় জীবনযাপন করতে পারব। আর তাই বৃক্ষরোপণ কর্মসূচিকে একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে হবে।
বিভিন্ন নীতিমালায় শিশুদের কথা ভেবে মাঠের কথা বলা হয়। অথচ বাস্তব ক্ষেত্রে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। খেলার মাঠ ছাড়া শিশুর বিকাশ পূর্ণাঙ্গ হয় না। গত কয়েক বছরে ঢাকা শহরের খেলার মাঠ উন্নয়নের জন্য কিছু প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেসব প্রকল্পে অত্যন্ত ছোট আকারে খেলার মাঠের ডিজাইন করা হয়েছে; মাঠ থেকে গণমানুষকে বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। মাঠে খেলাধুলা করতে না পারায় শিশুরা বিকল্প হিসেবে মোবাইল গেমসে আসক্ত হয়ে পড়ছে। অনেক কিশোর নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ছে। একটি সুস্থ সমাজের জন্য খেলার মাঠের কোনো বিকল্প নেই। মনোবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের শুধু ভালো খাবার আর ভালো স্কুলে পড়ালেই দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। তাদের মানসিক বিকাশে অবশ্যই খেলাধুলা ও শরীরচর্চা অত্যন্ত জরুরী। আর যদি তা না হয়, তাহলে শরীর ও মনের বিকাশ সঠিকভাবে হবে না। শিশুরা খেলার সুযোগ কম পেলে তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়তে থাকে। অবৈধভাবে খেলার মাঠ দখলের মধ্য দিয়ে শিশুদের শৈশব ও কৈশোরকে চুরি করা হচ্ছে। কাজেই একটি ইতিবাচক সমাজ গড়তে খেলার মাঠের ব্যাপারে আমাদের অবশ্যই সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি রাষ্ট্রকে এ ব্যাপারে আরও মনোযোগ বাড়াতে হবে এবং জরুরী পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে অচিরেই ধ্বংস হয়ে যাবে আমাদের সন্তানেরা, ধ্বংস হয়ে যাবে ওদের স্বপ্ন। শিশুদের জন্য এমন সবুজ ও ফাঁকা জায়গা এখন শুধু সময়ের দাবি।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট