৭ জানুয়ারি ২০২৪-এ অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী ২৯৮ সংসদ সদস্য ১০ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেছেন। ১১ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন। টানা চতুর্থবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার অনন্য গৌরবের ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সদস্যরা শপথ গ্রহণ করলেও মূলত তাদের কার্যকাল শুরু হবে সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে। সংবিধান অনুযায়ী একাদশ জাতীয় সংসদ এখনও বহাল। সংসদের মেয়াদ সম্পর্কে সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭২(৩)-এ উল্লেখ করা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে।’
একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৯ সালের ৩০ জানুয়ারি। সংবিধান অনুযায়ী এ সংসদের মেয়াদ শেষ হবে ২৯ জানুয়ারি। সংসদের মেয়াদপূর্তির আগেই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ বিষয়ে আইনি বৈধতার বিতর্ক নিষ্পত্তি করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।
২০১৯ সালে সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১০২-এর বিধান অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগে রিট পিটিশন নং-৬০৯/২০১৯ [মো. তাহেরুল ইসলাম (তৌহিদ) বনাম স্পিকার, জাতীয় সংসদ ও অন্যান্য] দায়ের করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত ২৯৯ সংসদ সদস্যের শপথ গ্রহণ ও সংসদ সদস্য হিসেবে পদে থাকার বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করেন। ওই রিট পিটিশনে যুক্তি উত্থাপন করা হয়, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং সে কারণে ওই সংসদের মেয়াদ ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত বলবৎ ছিল। কিন্তু একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ওই সংসদের মেয়াদপূর্তির আগেই ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করেছেন। ফলে সে সময় জাতীয় সংসদের সদস্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৬০০ জনে (সংরক্ষিত মহিলা আসন ব্যতীত), যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক; দুটি সংসদের অস্তিত্ব একসঙ্গে থাকতে পারে না।
ওই রিট পিটিশনে আরও যুক্তি উপস্থাপন করা হয়, একই সময়ে ৩০০+৫০ (সংরক্ষিত মহিলা আসনসহ)=৩৫০ সংসদ সদস্যের বেশি সদস্যের অস্তিত্ব সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ (৩), ১৪৮ (৩) ও ৭২ (৩) অনুমোদন করে না। সে কারণে একাদশ সংসদের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অবৈধ এবং ওই পদে থাকার তাদের কোনো আইনগত বৈধতা নেই।
হাইকোর্ট বিভাগ রিট-সংশ্লিষ্ট পক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্য, সংবিধান ও গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) পর্যালোচনা করে রিট পিটিশনটি সরাসরি খারিজ করে দেন। রিট পিটিশনার ওই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে সিভিল পিটিশন ফর লিভ টু আপিল নং-২৪১৯/২০১৯ দায়ের করেন। সম্প্রতি আপিল বিভাগে প্রধান বিচারপতিসহ আট সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয় এবং ২০২৩ সালের ১ আগস্ট প্রদত্ত রায়ে আপিল বিভাগও ওই মামলা খারিজ করে দেন। আপিল বিভাগ রায় দেওয়ার সময় সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ (৩), ১৪৮ (১)(২ক)(৩), ৭২ (৩) এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ পর্যালোচনা করেন।
সংবিধান অনুযায়ী [অনুচ্ছেদ ১২৩ (৩)] দুটি কারণে সংসদ নির্বাচন হতে পারে– প্রথমত, সংসদের মেয়াদ অবসানের কারণে; দ্বিতীয়ত, মেয়াদ অবসান ছাড়াও অন্য কোনো কারণে যদি সংসদ ভেঙে যায়। মেয়াদ অবসানের ক্ষেত্রে সংসদ ভেঙে যাওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে এবং অন্য কারণে সংসদ ভেঙে গেলে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। তবে দৈবদুর্বিপাকের কারণে নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব না হলে মেয়াদের শেষ দিনের পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান রয়েছে [অনুচ্ছেদ ১২৩ (৪)]। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৮ (১)-এ অনুযায়ী সংবিধানের ‘তৃতীয় তপশিলে’ উল্লিখিত যে কোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তির কার্যভার গ্রহণের আগে ওই তপশিল অনুযায়ী অবশ্যই শপথ গ্রহণ ও শপথপত্রে স্বাক্ষর করতে হবে। ‘তৃতীয় তপশিলে’ উল্লিখিত পদগুলো হলো রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য, প্রধান বিচারপতিসহ অন্যান্য বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্ম কমিশনের সদস্য।
অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩) অনুযায়ী সংবিধানের অধীন যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের আগে শপথ গ্রহণ আবশ্যক, সেই ক্ষেত্রে শপথ গ্রহণ ও শপথে স্বাক্ষর করার পরমুহূর্তেই তিনি কার্যভার গ্রহণ করেছেন বলে গণ্য হবে। রিট পিটিশনারের অন্যতম যুক্তি ছিল– শপথ গ্রহণের মাধ্যমে যেহেতু একজন সংসদ সদস্য তাঁর দায়িত্বভার স্বয়ংক্রিয়ভাবে গ্রহণ করে থাকেন, সেহেতু বিদায়ী সংসদের মেয়াদকাল পূর্তির আগে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের আইনগত কোনো ভিত্তি বা বৈধতা নেই।
আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩)-এর বিধান অর্থাৎ সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যভারপ্রাপ্ত হন কিনা– সে আইনগত বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছেন উপরোক্ত মামলায়। এই আইনি বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে গিয়ে আদালত অনুচ্ছেদ ১৪৮(৩)-এ উল্লিখিত ‘শপথ গ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে’ অর্থাৎ ‘ডিমিং ক্লজ’ (গণ্য বা মনে করা) বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন এবং ওই বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আদালত ‘কানুনি/বৈধ কল্পনা (লিগ্যাল ফিকশন)’ শব্দটিও ব্যাখ্যা করেছেন।
এ বিষয়ে দুটি শব্দের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আপিল বিভাগ নিজের ও উপমহাদেশের অন্যান্য সুপ্রিমকোর্টের বিভিন্ন নজির এবং বাংলাদেশের সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের ‘কনস্টিটিউশনাল ল অব বাংলাদেশ’ বইয়ের ওপর নির্ভর করেছেন। ‘ডিমড (গণ্য/মনে করা) শব্দটির আইনি অর্থ হলো (আইন শব্দকোষ; আইন কমিশন কর্তৃক প্রকাশিত) ১. কোনো কিছুকে এই বলে গণ্য করতে হবে যে উহা প্রকৃতপক্ষে অন্য কিছু অর্থাৎ উহার যেন সেই গুণ আছে যাহা উহার নাই; ২. বিধিবদ্ধ কোনো দলিলে কোনো সন্দেহ নিরসন কিংবা সংক্ষেপে মুসাবিদা করার নিমিত্তে কোনো কোনো শব্দ বা বাক্যাংশকে প্রদত্ত এমন একটি ব্যাখ্যা, যা সাধারণত ওইভাবে দেওয়া হতো না। আর ‘লিগ্যাল ফিকশন’-এর (কানুনি/বৈধ কল্পনা) আইনি অর্থ হলো– কোনো বিষয় প্রকৃতপক্ষে সত্য হোক বা না হোক, আইনি সত্য বলে ধরে নেওয়া হয়। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল মাহমুদুল ইসলামের মতে, আইনসভা কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিগ্যাল ফিকশন তৈরি করে, যা ডিমিং ক্লজ হিসেবে বিবেচিত। তাঁর মতে, ‘লিগ্যাল ফিকশন’ হলো সেটাই, যার বাস্তব অস্তিত্ব নাই; কিন্তু আইনসভা ও আদালত তা বাস্তব হিসেবে গ্রহণ করে।
সংসদ সদস্যরা শপথবাক্য পাঠ করেন ‘আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি, ...’ অর্থাৎ একজন সংসদ সদস্য শপথ গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গেই কার্যভার গ্রহণ করছেন না বরং করতে যাচ্ছেন, যা ভবিষ্যতের একটি বিষয়। সংবিধানের তৃতীয় তপশিলে বর্ণিত পদ, যথা– রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রী, বিচারপতিসহ অন্যান্য পদের শপথনামায় ‘কর্তব্যভার গ্রহণ করিতে যাইতেছি’ বাক্যটি অনুপস্থিত। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৮ (৩) অনুযায়ী ওইসব পদে শপথ গ্রহণ ও শপথনামায় স্বাক্ষর করার সঙ্গে সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট পদের ব্যক্তিরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে যান। কিন্তু সংসদ সদস্যদের ক্ষেত্রে যেহেতু সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১২৩ (৩)-এর শর্ত দ্বারা নির্বাচিত ব্যক্তিদের সংসদের মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করা থেকে বারিত করা হয়েছে, সেহেতু নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করলেও তাদের কার্যভার গ্রহণ করার সুযোগ নেই। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৪৮ (২ক) অনুযায়ী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হওয়ার পরবর্তী তিন দিনের মধ্যে নির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যেহেতু গেজেট প্রকাশের পর তিন দিনের মধ্যে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ বাধ্যতামূলক, সেহেতু তিন দিনের অতিরিক্ত সময় বা আগের সংসদের মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত অপেক্ষার সাংবিধানিকভাবে কোনো সুযোগ নেই।
আপিল বিভাগের মতে, নতুন সরকার গঠনের জন্য এই শপথ। কেননা, সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের আস্থাভাজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়ে থাকেন এবং সেভাবেই সরকার গঠিত হয়ে থাকে। সরকারের ধারাবাহিকতা অবশ্যই বজায় রাখতে হবে; সরকারের ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ বা শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে না। সে কারণেই নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অত্যাবশ্যক। বিদ্যমান সংসদের মেয়াদপূর্তির আগেই নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের চূড়ান্ত অভিমত এটাই যে, সংসদের মেয়াদপূর্তির আগে নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণের কারণে তারা সংসদ সদস্য হিসেবে বিবেচিত বা গণ্য হলেও বাস্তবতা ভিন্ন। তাদের কার্যকাল শুরু হবে সংসদের প্রথম অধিবেশনের দিন থেকে। ‘লিগ্যাল ফিকশন’ (কানুনি/বৈধ কল্পনা) এটাই যে, প্রকৃত সত্য যা-ই হোক না কেন নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যরা শপথ গ্রহণ করলেও আইনি সত্য হলো, তারা এখনও কার্যভার গ্রহণ করেননি।
বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন, সংবিধান ও আইন ব্যাখ্যার একমাত্র এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের। এমনকি জাতীয় সংসদেরও আইন বা সংবিধান ব্যাখ্যা করার ক্ষমতা নেই। যদিও সংসদ আইন প্রণয়ন ও সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা রাখে। দেশের সব নাগরিককে স্মরণ রাখতে হবে, সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১১১ অনুযায়ী আপিল বিভাগের রায়, আদেশ ও সিদ্ধান্ত সবার জন্য শিরোধার্য ও বাধ্যকর।
লেখক : বিচারপতি, আপিল বিভাগ, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট এবং চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন