দেখতে দেখতে প্রায় শেষ সময়ে চলে এসেছে অমর একুশে বইমেলা। শুরু থেকেই মেলা প্রাঙ্গণ ছিল রাজধানীর বাসিন্দাদের পদচারণায় মুখর। দিন যত গড়িয়েছে মানুষের উপস্থিতিও বেড়েছে। এখন শেষ সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মেলায় আসছেন। তারপরও মেলায় অংশগ্রহকারী স্টলগুলোর কর্মীদের মুখে হাসি নেই।
কারণ একটাই, মেলায় মানুষের উপচেপড়া ভিড় থাকলেও বই কেনার লোক একেবারে হাতেগোনা। যারা আসছেন তাদের বেশিরভাগই ঘুরাফেরা করছেন, মোবাইল ফোনে ছবি তুলছেন বা আড্ডা দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন। স্টলগুলোতে ক্রেতাদের আনাগোনা বেশ কম। অনেক স্টলের কর্মীরা ক্রেতা না থাকায় অলস সময় পার করছেন। এ নিয়ে প্রকাশকরা যেমন হতাশ, তেমনই লোকসানের আশঙ্কাও করছেন তারা।
বুধবার (২১ ফেব্রয়ারি) বিকেলে সরেজমিনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে মেলা প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা গেছে, মেলায় প্রবেশের গেটগুলো নানা বয়সী নারী-পুরুষে ঠাসা। লাইন ধরে হাজার হাজার মানুষ মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করছেন। ফলে প্রবেশ গেটগুলোর সামনে জটলা বেঁধে যাচ্ছে। এমনকি মেলা প্রাঙ্গণ ও প্রবেশ গেটের সামনের রাস্তাতেও মানুষের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। তবে মেলা প্রাঙ্গণের অনেক স্টলে কর্মীদের অলস বসে থাকতে দেখা গেছে।
স্টলগুলোতে থরে থরে বই সাজানো থাকলেও সেদিকে মেলায় আসা মানুষের যেন কোনো নজর নেই। তাদের বেশিরভাগই শুধু মেলায় ঘোরাঘুরি করছেন এবং ছবি তুলছেন। কেউ কেউ বইয়ের স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলছেন। কিন্তু স্টলে থাকা কোনো বই একটু খুলেও দেখছেন না। ঘোরাঘুরি আর আড্ডাতেই ব্যস্ত থাকছেন অনেকে।
মেলায় অংশ নেওয়া বিভিন্ন প্রকাশনা সংস্থার দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, এবারের মেলায় বই বিক্রি বেশ খারাপ। গত বছরের তুলনায় এবার অর্ধেক বিক্রিও হচ্ছে না। অথচ এবার মেলায় মানুষের আনাগোনা গত ৩-৪ বছরের তুলনায় ভালো। কিন্তু মেলায় যারা আসছেন, তারা শুধু ঘোরাঘুরি আর ছবি তুলতেই ব্যস্ত থাকছেন। বই কেনার লোক খুবই কম।
জনপ্রিয় প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ সোলায়মান হোসেন বলেন, আমি ১৮ বছর ধরে বইমেলায় অংশগ্রহণ করছি। গত পাঁচ বছর ধরেই মেলায় লোকসানে আছি। এবারের বিক্রি পরিস্থিতিও ভালো না। গত বছরের তুলনায় এবার বিক্রি অনেক কম হচ্ছে। মেলায় যারা আসছেন, তাদের খুব কম সংখ্যক বই কিনছেন।
তিনি বলেন, বইমেলায় যারা আসছেন, তাদের বেশিভাগ ঘোরাঘুরি করতে আসছেন। ঢাকা শহরে বেড়ানোর জায়গা খুব কম। তাছাড়া বইমেলা ঘোরার জন্য নিরাপদ। বাসায় বইমেলায় যাওয়ার কথা বললে অভিভাবকরা বাধা দেন না। এ সুযোগে অনেকে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বইমেলায় চলে আসছেন।
তিনি আরও বলেন, বইমেলায় এলে বই কিনতে হবে এমন কোনো নিয়ম নেই। কাউকে বই কিনতে বাধ্য করাও যায় না। আবার এটা বাণিজ্যমেলার মতোও না। তাই টিকিট কাটার সিস্টেমও করা যায় না।
মনন প্রকাশ’র তপন কান্তি বলেন, বইমেলায় এবার বিক্রি বেশ কম। মেলায় মানুষ আসছে, ঘোরাঘুরি করে চলে যাচ্ছে। বই খুব একটা কিনছে না। মানুষের মধ্যে এখন যেন বই পড়ার আগ্রহ কম। অনেকে ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করছেন। মেলায় বসে ফেসবুক চালাচ্ছেন। আড্ডা দিয়ে, গল্প করে সময় কাটাচ্ছেন। বই খুলেও দেখছেন না।
অনন্যা প্রকাশনীর এক কর্মী বলেন, মেলায় যারা আসছেন তাদের ৯৫ শতাংশের হাতে দেখেন কোনো বই নেই। মেলায় এতো মানুষ, কিন্তু অনেক স্টলে দেখেন কোনো ক্রেতা নেই। সবাই মেলা প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করছেন, স্টলে গিয়ে কেউ বই খুলে দেখছেন না। শুধু আজ নয়, মেলার প্রতিদিনের চিত্র এটি। প্রতিদিনই মেলায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ আসছেন, কিন্তু বইয়ের ক্রেতা খুব কম।
মিরপুর থেকে মেলায় আসা আফিয়া আক্তার বলেন, আজ ছুটির দিন। তাই বাসায় বলে বইমেলায় এসেছি। এখন একটু ঘোরাঘুরি করছি। বাসায় যাওয়ার আগে পছন্দ মতো বই কিনে নেবো। আপাতত মেলা ঘুরে দেখতে ভালো লাগছে।
কী বই কিনবেন? এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, কী বই কিনবে তা বাসা থেকে ঠিক করে আসিনি। কয়েকটি স্টল ঘুরে দেখবো, যে বই ভালো লাগবে কিনে নেবো। রোমান্টিক উপন্যাস কেনার ইচ্ছা আছে।
বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় এসেছেন যাত্রাবাড়ীর রিফাত হাসান। তিনি বলেন, আমরা বন্ধুরা মিলে মাঝেমধ্যেই বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাই। আজ বইমেলায় চলে এলাম। এখানে ঘুরতে ভালোই লাগছে।
কোনো বই কিনেছেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, কয়েকটি স্টল ঘুরে ঘুরে বই দেখেছি। কিন্তু কোনো বই তেমন একটা পছন্দ হয়নি। আবার বইগুলোর দামও বেশি। তাই কেনা হয়নি।