যুক্তরাষ্ট্রের আকস্মিক বিমান হামলায় ইরানের গোপন পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর বোমাবর্ষণের ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এক নতুন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই হামলাকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা যেমন বাড়ছে, তেমনি চোখ এখন ইরানের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার দিকে।
শনিবার দিবাগত রাতে মার্কিন বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান থেকে ইরানের ফোর্দো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রসহ আরও অন্তত দুটি উচ্চ সুরক্ষিত স্থাপনায় আঘাত হানা হয়। হামলাগুলো এমন সব স্থাপনায় চালানো হয়েছে, যা পাহাড়ের গভীরে নির্মিত এবং বহির্বিশ্বের নজর এড়িয়ে অনেকটা অদৃশ্য অবস্থানে পারমাণবিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল।
হোয়াইট হাউস দাবি করেছে, এসব স্থাপনায় এমন মাত্রার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কার্যক্রম চলছিল, যা ইরানকে পরমাণু অস্ত্র তৈরির পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক বিবৃতিতে বলেন, “বিশ্বকে একটি ভয়াবহ পরিণতি থেকে রক্ষার জন্যই এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।”
রোববার সকালে টেলিভিশন ভাষণে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই হামলার প্রশংসা করে বলেন, “এই সাহসী সিদ্ধান্ত ইতিহাস বদলে দেবে।”
তিনি জানান, দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রশাসনকে বোঝানোর চেষ্টা করে এসেছেন যে, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি থামাতে হলে কেবল কূটনীতি যথেষ্ট নয়—সামরিক পদক্ষেপই একমাত্র কার্যকর উপায়।
নেতানিয়াহু আরও বলেন, “আজ সেই ইতিহাসের মোড় ঘুরল। যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে ইরানকে এখনই থামানো দরকার।”
গোপনে তৈরি ছিল ‘টার্গেট লিস্ট’
সূত্রগুলো জানায়, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী বহু বছর ধরে ইরানের বিভিন্ন পরমাণু স্থাপনা, সামরিক ঘাঁটি, কমান্ড সেন্টার, বিজ্ঞানী এবং ইরানের সামরিক ও কূটনৈতিক পরিকাঠামোর একটি সুদীর্ঘ টার্গেট তালিকা প্রস্তুত রেখেছিল।
যুক্তরাষ্ট্র এই হামলা না চালালে, ইসরায়েল সেই তালিকা অনুসারে ধারাবাহিকভাবে আঘাত হানার প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
ইরান বলছে, প্রতিশোধ অনিবার্য
হামলার পরপরই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি বলেন, “এই বর্বরোচিত হামলার জবাব অবশ্যই দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রকে এর মূল্য চুকাতে হবে।”
ইরান সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, হামলার আগে তারা গুরুত্বপূর্ণ পারমাণবিক উপকরণ সরিয়ে ফেলেছিল। তবে হামলায় কিছু অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে।
তবে তেহরানের প্রকৃত সামরিক জবাব কী হতে পারে, তা নিয়ে এখনো স্পষ্ট কিছু বলা হয়নি।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ইরান সরাসরি মার্কিন ঘাঁটি বা সামরিক স্থাপনায় আঘাত না হেনে তাদের আঞ্চলিক মিত্রদের ব্যবহার করতে পারে। ইয়েমেন, ইরাক, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে ইরানের ঘনিষ্ঠ সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে হামলা চালিয়ে পরিস্থিতিকে টালমাটাল করে দিতে পারে তারা।
ইতিমধ্যে ইয়েমেনের হুতি গোষ্ঠী ঘোষণা দিয়েছে, “যুদ্ধ শুরু হলে লোহিত সাগরে চলাচলকারী মার্কিন জাহাজ আমাদের বৈধ লক্ষ্যবস্তু হবে।” এ ঘোষণা নতুন করে আন্তর্জাতিক শিপিং রুটগুলো নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
যুক্তরাষ্ট্র: ‘অভিযান শেষ, তবে জবাব দিতে প্রস্তুত’
যুক্তরাষ্ট্র জানিয়েছে, এ মুহূর্তে তাদের কোনো বড় আকারের অভিযান চালানোর পরিকল্পনা নেই। হোয়াইট হাউসের বিবৃতিতে বলা হয়, “আমরা ইরানে সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করছি না। কিন্তু যদি প্রতিশোধমূলক হামলা হয়, তবে তা ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া ডেকে আনবে।”
মার্কিন প্রশাসন জানায়, ওই হামলা ‘একবারের কৌশলগত সিদ্ধান্ত’, যার লক্ষ্য ছিল ইরানকে একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া—পৃথিবী আর পারমাণবিক ছায়া সহ্য করবে না।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইরান হয়তো এবারও ২০২০ সালের কাসেম সোলাইমানি হত্যার ঘটনার মতো সীমিত প্রতিক্রিয়ার পথ বেছে নেবে। সেবারও তারা সরাসরি বড় ধরনের হামলার বদলে ইরাকের মার্কিন ঘাঁটিতে কিছু ক্ষতিসাধনের মাধ্যমে সংকেত পাঠিয়েছিল।
সামনে কী অপেক্ষা করছে?
এই মুহূর্তে গোটা মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের ঘাঁটি, বাণিজ্যিক স্থাপনা ও জাহাজ এখন সম্ভাব্য টার্গেটে পরিণত হয়েছে। তেলের বাজারেও অস্থিরতা তৈরি হয়েছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার মতো আমদানি-নির্ভর অঞ্চলে প্রভাব ফেলতে পারে।
বিশ্বজুড়ে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়েছে যাতে সংঘাত আরও বিস্তৃত না হয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের সম্ভাবনা নিয়েও আলোচনা চলছে।
পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে?
এই হামলা মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সমাপ্তি ডেকে আনল, না কি আরও ভয়াবহ অধ্যায়ের সূচনা—তা নির্ভর করছে ইরানের পরবর্তী সিদ্ধান্তের ওপর। পুরো অঞ্চল এখন এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে।