বুধবার ২৫ জুন ২০২৫ ১১ আষাঢ় ১৪৩২
বুধবার ২৫ জুন ২০২৫
উন্নয়নের প্রধান শর্ত মানসম্মত রাজনীতি
মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৪ এপ্রিল, ২০২৪, ১০:৪৩ AM
জীবনানন্দ দাশের মা কুসুমকুমারী দাশের লেখা ‘আদর্শ ছেলে’ কবিতাটি একসময় খুবই উচ্চারিত হতো। কবিতাটির বক্তব্য এখনো প্রাসঙ্গিকতা স্মরণ করিয়ে দেয়। 

কবিতার প্রথম দুটি পঙক্তি ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে/কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে?’ দেশের রাজনীতিতে বড়-ছোট সব দলের নেতারা প্রতিদিন নিজেকে কথায় বড় বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন। কিন্তু কাজে কে কতটা বড় হবেন, তার উদাহরণ খুব কম রাজনীতিবিদই এ পর্যন্ত দেখাতে সক্ষম হয়েছেন বললে অত্যুক্তি করা হবে না।

শুধু রাজনীতির ক্ষেত্রেই আমি এটিকে সীমাবদ্ধ করতে চাই না। দেশের যত সব পেশা রয়েছে তার দিকে যদি নজর দেওয়া হয়, সেখানেও এটি একইভাবে প্রযোজ্য—এমনটি স্বীকার করতে দ্বিধা নেই। রাজনীতিকে দেখানোর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে দেশটিকে পরিচালনার দায়িত্ব রাজনীতিবিদদেরই—অন্য কারো নয়। অন্যরা যার যার ক্ষেত্রে ভূমিকা কিংবা অবদান রাখবেন, রাষ্ট্রের নীতি-কৌশল বাস্তবায়ন করবেন।

রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের আদর্শ, নীতি-কৌশল, আইন তৈরি করেন। চারদিকে তাকালে বড়-ছোট রাজনৈতিক দলের সংখ্যার যেমন কোনো সঠিক তথ্য নেই আবার রাজনীতিবিদদেরও কোনো অভাব দেশে দেখি না। সবাই নিজেকে কোনো না কোনো দলের নেতা পরিচয়ে কথা বলেন। তাঁদের উচ্চারিত কথার মধ্যে একে অপরকে ঘায়েল করা, অভিযুক্ত করা, দোষারোপ করার প্রবণতা যত বেশি দেখা যাচ্ছে, দেশের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ চিন্তা-ভাবনায়য় তাঁদের কথায় এবং কাজে মিল খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্টের বিষয়।

উন্নয়নের প্রধান শর্ত মানসম্মত রাজনীতিপরিসংখ্যান বলছে দেশে ১৭ কোটি মানুষ। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের দেশ। অন্য মহাদেশে হলে এত মানুষের মুখে তিন-চার বেলা আহার দেওয়ার সক্ষমতা আমাদের থাকত কি না বলা মুশকিল। উর্বর পলি মাটির দেশ হওয়ায় মোগল আমলে বাংলাকে স্বর্গরাজ্য বলা হতো। অ্যাডাম স্মিথ তাঁর বিখ্যাত 'Wealth of Nations ' (১৭৭৬) (১৭৭৬) গ্রন্থে চীন, বাংলা ও মিসরের মাটিকে পৃথিবীর সবচেয়ে উর্বর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন।

বাংলার মাটি শস্য উৎপাদনে বিখ্যাত ছিল, গোলা ভরা ধান—গোয়াল ভরা গরুর প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। কিন্তু সেই বাংলায় ইংরেজ বেনিয়াদের শোষণের কারণে ১৭৭০ (বাংলা ১১৭৬), ১৮৭৬-১৮৭৮ এবং ১৯৪৩ (বাংলা ১৩৫০) মন্বন্তরে লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ১৯৪৯ সাল থেকে হাভাতের দৃশ্য প্রতিবছরই দুইবার করে আমাদের দেখতে হতো। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে ১৯৭৪ সালে প্রায় ২৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ১৯৭৭ থেকে কয়েক বছরই হাভাতের দৃশ্য নিয়মিত দেখতে হয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মঙ্গা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারলেও ১৭ কোটি মানুষের চাহিদা পূরণের মতো কৃষিজ পণ্য উৎপাদনের জমি আমাদের অবশিষ্ট নেই বলে বিদেশ থেকে অনেক কিছুই আমদানি করতে হয়। এই আমদানির জন্য বিরাট অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের বিদেশে চলে যায়।

আমাদের প্রায় এক কোটির অধিক মানুষ প্রবাসে থাকেন। তাঁরা রেমিট্যান্স পাঠান। কিন্তু এই এক কোটির অধিক মানুষের বেশির ভাগই অদক্ষ রেমিট্যান্স যোদ্ধা নামে আমাদের কাছে পরিচিত। একসময় হয়তো অদক্ষ জনশক্তি প্রেরণ করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু এত দিনেও আমরা দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠাতে মোটেও সফল হওয়ার দাবি করতে পারছি না। যদি তা করা যেত, তাহলে বর্তমানের চেয়ে ১৫ গুণ বেশি রেমিট্যান্স এ দেশে অনায়াসেই প্রবেশ করত।

অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে বেশ কিছু উন্নত প্রযুক্তির শিল্প-কারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য কয়েক লাখ বিদেশি দক্ষ বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা আমাদের দেশে কাজ করছেন। এখান থেকে বিরাট অঙ্কের অর্থ তাঁদের দেশে প্রেরণ করছেন। আমাদের দেশে এসব প্রতিষ্ঠানের সেই মানের দক্ষ বিশেষজ্ঞ আজও আমরা তৈরি করতে পারলাম না, তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। অথচ দেশে ‘শিক্ষিত’ লাখ লাখ যুবক হয় বেকার নতুবা অদক্ষ জনগোষ্ঠী হিসেবে কম বেতনের কিছু একটা করে জীবনধারণ করছে।

দেশে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো অভাব নেই, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তথাকথিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হচ্ছে, যেগুলোতে ডেকে ডেকে ছাত্র এনে ভর্তি করানো হচ্ছে, কিন্তু শিক্ষার নামে যা কিছু দেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে উপযুক্ত ও দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা যাচ্ছে না। সম্প্রতি প্রকাশিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফল দেখেও কি কারো বোধোদয় হবে না যে আমাদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের শিক্ষার পাটাতন একেবারেই ভঙ্গুর। এ দিয়ে শিক্ষিত জনশক্তির সম্ভাবনা দেখার আশা করা একেবারেই নিরর্থক। আমরা দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশ্বমানের শিক্ষা লাভের সুযোগ সৃষ্টির চেয়ে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতিকে অধিক গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করি।

১৯৬২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে শরিফ শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন ছাত্র প্রাণ দিয়েছিলেন। সদ্যঃস্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু কুদরাত-এ-খুদা কমিশনের ভিত্তিতে একটি শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশে যাঁরাই ক্ষমতায় এসেছিলেন, তাঁরাই কমপক্ষে একটি করে শিক্ষা কমিশনের বিড়ালের ছানা দেখিয়ে জাতিকে প্রবোধ দিতে চেষ্টা করেছেন। অন্যদিকে শিক্ষার নামে যত্রতত্র শিক্ষা নামধারী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। সেগুলোর বেশির ভাগই কোনো শিক্ষা দর্শনকে ধারণ করার জন্য নয়, বরং বাণিজ্য এবং নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। ফলে দেশে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষা সনদ নিয়ে বের হলেও খুব সামান্যই কর্মক্ষেত্রে কৃতি, দক্ষ, আধুনিক জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে কাক্সিক্ষত মান অর্জন করতে পারছে।

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় দীর্ঘদিন থেকে যা চলে এসেছে, তা দিয়ে ১৮ কোটি মানুষের দেশটিকে জ্ঞাননির্ভর, দুর্নীতিমুক্ত, নীতি-আদর্শবান, দেশপ্রেমিক দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা সম্ভব নয়, সেটি বুঝতে যত দেরি করব, ততই আমাদের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। দেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যুগের চাহিদা পূরণের কোনো তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক শিক্ষা আছে বলে দাবি করা বেশ দুষ্কর হয়ে পড়বে। ছাত্র-ছাত্রীদের একটি বিরাট অংশ ছাত্ররাজনীতিতে সময় ব্যয় করে, কিন্তু লেখাপড়ায় তাদের অবস্থান নামমাত্র। তারাই দেশের রাজনীতিতে যুক্ত হয়, যাদের বেশির ভাগই বুদ্ধিবৃত্তিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক, আদর্শিক ও নীতি-নৈতিক শিক্ষার ব্যাপক অভাবে রাজনীতির মাঠে স্লোগান, গলাবাজি এবং পরস্পর পরস্পরের বিরুদ্ধে লেগে আছে।

রাজনীতিকে মানের সংকটে নিমজ্জিত করে রেখেছে। তাদের বক্তৃতায় নিজ দেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক সমস্যার কোনো বিজ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ নেই, নেই কোনো ভবিষ্যৎ কর্মসূচি পরিকল্পনা, যা বাংলাদেশকে ২০৩০, ২০৪১ সালে উন্নত রাষ্ট্রের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তুতির জন্য অপরিহার্য।

যাঁরা নিজেদের রাজনীতিবিদ হিসেবে দাবি করেন, তাঁদের বক্তৃতা শুনে আকৃষ্ট হওয়ার চেয়ে হতাশ হতে হয় বেশি। ইতিহাস নিয়ে তাঁদের টানাটানি করার দৃশ্য দেখে মনে হয়, তাঁরা যেন দড়ি টানাটানির খেলায় শক্তি প্রয়োগ করছেন।

আজকের বিশ্বে মস্তিকের চেয়ে দেহ এবং অস্ত্র শক্তির প্রয়োজনীয়তা কতটুকু আছে, তা যদি তাঁরা বুঝতেন, তাহলে প্রতিদিন অর্থহীন, যুক্তিহীন, তথ্যহীন, জ্ঞানহীন এবং ইতিহাস বিযুক্ত তর্ক করে সময় নষ্ট করতেন না। আসলে আমাদের জাতীয় জীবনে প্রচুর সম্ভাবনা ছিল, মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমও ছিল, সেটি উজ্জীবন ঘটিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুলের মতো অসংখ্য ত্যাগী নেতা। কিন্তু তাঁদের অনুসরণ করার পরিবর্তে তাঁদের বিরুদ্ধে নানা বিষোদগারে লিপ্ত হয়েছিল যেসব ছাত্রনেতা, উগ্র হঠকারী রাজনীতির কোকিলরা—তারা দেশের রাজনীতিটাকেই হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো নিক্ষেপ করেছে দুর্নীতি, ভণ্ডামি এবং গলাবাজির এক খরস্রোতা নদীতে, যেখান থেকে ফিরে আসা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে।

গত দেড় দশকে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে ঈর্ষণীয় উন্নতি করেছে, কিন্তু সেই উন্নতি মোটেও স্থায়ী বা টেকসই হবে না, যদি আমরা সামনে থাকা বড় চ্যালেঞ্জগুলো মেধা, প্রজ্ঞা ও দেশপ্রেম দিয়ে মোকাবেলা করতে না পারি। যদি আমাদের সন্মুখে দক্ষ, শিক্ষিত, সৎ, আদর্শবান জনশক্তি তৈরি করার প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ব্যর্থ হই, যদি যার যার রাজনৈতিক দলকে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক রাজনীতির আদর্শের পাঠশালায় রূপান্তর করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনের রাজনীতি আরো মানহীন, শিক্ষাবিহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শের অপশক্তির খপ্পরে পড়ে যেতে পারে, এমনটাই আমাদের আশঙ্কা। সেই আশঙ্কা থেকেই বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ উন্নত দুনিয়ায় শিক্ষালাভ এবং কর্মসংস্থানের জন্য চলে যাচ্ছে। এটি রোধ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে দেশে মানসম্মত শিক্ষা, সুশাসন, দক্ষ ও মেধাবীদের উপযুক্ত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। এতেই উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ হতে পারে।

লেখক : ইউজিসি বঙ্গবন্ধু ফেলো এবং সাবেক অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত