সোমবার ২৩ জুন ২০২৫ ৯ আষাঢ় ১৪৩২
সোমবার ২৩ জুন ২০২৫
তবুও অমর হোক মে দিবস
ফরিদা আখতার
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২ মে, ২০২৪, ১১:১০ AM
মে দিবসে (১ মে) শ্রমিকের কী অধিকার নিয়ে সংগ্রাম করতে হবে তা হয়ত বেশির ভাগ শ্রমিক এবং ইনফরমাল সেক্টরের শ্রমজীবী মানুষ জানেন না। পহেলা মে পালনের বিষয়টি ট্রেড ইউনিয়ন আয়োজিত অনুষ্ঠানে বেশি প্রকাশিত হয়, অথচ ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে শ্রমিকের সংখ্যা কারখানার বাইরে খুব একটা নেই। কারখানার ভেতরেও ৩০% হবে না।

কিছু গবেষণায় দেখা গেছে মোট শ্রমিকের ৩% ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য হয়ে আছেন। তাহলে শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষ নিজেই কি জানেন তাদের অধিকার কী? পয়লা মে কেন সরকারি ছুটির দিন? কী দাবি তোলা দরকার? আমার বিশ্বাস অনেকেই জানেন না, তবে ক্যালেন্ডারে লাল রংয়ে ছুটির দিন হিসেবে শুক্র, শনি ও রবি তিনদিন বেশ ভালোই হচ্ছে, কারণ এবার ২০১৬ সালের মে মাসের পয়লা তারিখ শুরু হচ্ছে রবি বারে, যা বাংলাদেশে প্রথম সাপ্তাহিক কাজের দিন।

এই লেখার জন্যে আমি আমার চারপাশের কিছু সাধারণ কর্মজীবীদের একটি তালিকা করতে বলেছিলাম, মে দিবসের তাৎপর্য তাদের কাছে কি বোঝার জন্যে। তালিকায় এলো, গরমে শ্রমিকের স্বাস্থ্য সমস্যা হচ্ছে, বেতন ঠিক মতো দেয় না, ৮ ঘণ্টার বেশী কাজ করতে হয়, বাস স্থানে অভাব, ছুটি নাই, চিকিৎসা সেবা নাই, কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি। এই তালিকায় সাধারণভাবে মানুষ যে শ্রমিকের প্রাপ্য অধিকার সম্পর্কে কিছুটা হলেও জানেন তা বোঝা যায়।

সাধারণভাবে আমরা জানি মে দিবস শ্রমিকের অধিকার রক্ষার দিবস। ১৮৮৬ সালে যুক্ত রাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের জন্য ধর্মঘট করেছিলেন, কিন্তু দুঃখজনক ভাবে সেদিন পুলিশ ও শ্রমিকের সংঘর্ষে শ্রমিকদের প্রাণ দিতে হয়েছিল। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এই বিষয়টি ১৮৯০ সালে প্যারিসে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেছিলেন, এবং মে মাসের প্রথম দিনকে শিকাগোর সংগ্রামী শ্রমিকদের স্মরণে নির্ধারণ করে দেন। প্রায় ১২৫ বছর পার হলেও এখনও শ্রমিকের অধিকারের সংগ্রাম খুব বেশী এগিয়েছে বলে মনে হয় না, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তার অবনতি ঘটেছে। এখন শ্রমিকরা ধর্মঘট করার সময় পান না, বা তাদের নিজেদের দাবি আদায়ের জন্যে সংগ্রাম করার ক্ষেত্রে বাধা তৈরি হয় অনেকভাবে। তবে বিশ্বব্যাপী পুঁজির শোষণের বিরুদ্ধে অন্য ধরনের আন্দোলন শুরু হয়েছে। সাম্প্রতিক কালে একটি উদাহরণ হচ্ছে  Occupy Wall Streetনামক আন্দোলন যা কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেকে দেশে ২০১২ সালে শুরু হয়েছিল। দাবি ছিল ধনিদের সাথে বিশাল ব্যবধান ঘুচাতে হবে।

বাংলাদেশে শ্রমিকদের কথা বলতে গেলেই আজকাল শুধুই পোশাক শিল্পের শ্রমিকের কথা বলা হয়। এটা সঠিক চিত্র নয়। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী দেশে সব ধরনের শ্রমজীবী মানুষের সংখ্যা ৭ কোটি ৭৬ লাখের বেশি, এর মধ্যে সবধরনের শ্রমজীবী নারী ও পুরুষ আছেন। কিন্তু যদি মনে করা হয় ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকের পক্ষে কথা বলার বা শ্রমিকের স্বার্থ দেখার প্রতিষ্ঠান তাহলে দুঃখজনকভাবে হলেও সত্যি যে সারাদেশে মাত্র ১৬৯ টি ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সদস্য হচ্ছে ২৩ লক্ষ, যা মোট শ্রমজীবী মানুষের ৩% মাত্র। শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যেও বড় পার্থক্য রয়েছে। যারা নির্দিষ্ট মজুরি কাঠামোতে আছে তাদের মধ্যেও ট্রেড ইউনিয়ন খুব সক্রিয় নয়, মাত্র ২৩% এর সদস্য আছেন। নারী শ্রমিকদের মাত্র ১৫% ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত আছেন কিন্তু নেতৃত্বে আছেন খুব কম তাই তাদের বিশেষ দাবি উপেক্ষিত হয়ে যায়। মজার বিষয় হচ্ছে, সরকারি বড় বড় কারখানাতেই ট্রেড ইউনিয়ন বেশী সক্রিয় যেখানে কারখানাই চলে না বা প্রায় বন্ধ হওয়ার পথে। বর্তমানে খুলনার জুট মিলে এবং নৌপরিবহণ শ্রমিকদের আন্দোলন চলছে। আর বেসরকারি বড় বড় কোম্পানিতে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুবিধা বা অধিকার স্বীকৃত নয়।

বাংলাদেশে বর্তমান ট্রেড ইউনিয়নের দুরাবস্থার মূল কারণ হচ্ছে তারা মালিক বা কর্তৃপক্ষের সাথে নয় তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হয়ে একে অপরের বিরোধিতা করছেন। শ্রমিকের স্বার্থ দেখার চেয়ে নিজ দলের স্বার্থই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশী চোখে পড়ে গার্মেন্ট কারখানায় কিন্তু এখানেও প্রায় ৩৫ লাখ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৬৩,০০০ ইউনিয়ন করার অনুমতি পেয়েছেন, কিন্তু তাও পুরোপুরি ট্রেড ইউনিয়নের নিয়ম মতো নয়। আমরা গত শতকের আশির দশকের শুরুতে স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে শ্রমিক-কর্মচারী ঐক্য পরিষদ বা স্কপের যে তৎপরতা দেখেছিলাম আজ তারা সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখন শ্রমিক দিবসে কথা বলতে গেলে শুধু দেশের ভেতরে যারা কাজ করছেন তাদের কথা নয় আমাদের বলতে হবে দেশের বাইরে প্রবাসী শ্রমিকের কথাও। সরকার যখন দায়িত্ব নিয়ে এই শ্রমিকদের বিদেশে পাঠায় এবং তাদের পাঠানো ডলার-পাউন্ড-রিয়ালে দেশের কোষাগার ভরে যায় তখন যদি কেউ তাদের অধিকারের কথা না বলে কিংবা তাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব না নেয়, এর চেয়ে বড় অন্যায় আর কিছু হতে পারে না।

এবার মে দিবসের আগে আমরা দেখছি বিশেষ পেশার শ্রমজীবীদের আন্দোলন করতে এবং তাদের দাবির প্রতি কোন প্রকার ভ্রূক্ষেপ না করে সরকার দিব্বি বসে আছে। ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গেলে দেখতে পাবেন নার্সদের দুটি সংগঠন তাদের দাবি আদায়ের জন্যে দিনের পর দিন এই গরমের মধ্যে বসে আছেন। তারা আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার C149-Nursing personal Convention এর আওতাভুক্ত।

আমরা জানি বাংলাদেশে ডাক্তারের তুলনায় নার্সের আনুপাতিক হার দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। প্রতি ৭.৭ জন চিকিৎসকের জন্যে মাত্র একজন নার্স রয়েছেন। অথবা বলা যায় নার্সের সংখ্যার তুলনায় চিকিৎসকের সংখ্যা আড়াই গুন বেশী। হওয়ার কথা ছিল নার্সের সংখ্যা বেশী, তাদের ছাড়া কোন হাসপাতাল চালানো সম্ভব নয়। এই বিষয়টি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায়ও উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে এবং ২০০৬ সালের প্রতিবেদনে স্বাস্থ্য জনবলের দিক থেকে যে ৫৮টি দেশকে জনবল সংকটের দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে। জনবলের এই সংকটের সময়ে নার্সদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন প্রকার সমস্যা তৈরি করা কাম্য হতে পারে না। 

বর্তমানে বাংলাদেশের নার্সদের নিয়োগ নিয়ে যে সমস্যা তৈরি হয়েছে তা উদ্বেগজনক এবং তাদের ন্যায্য দাবি দাওয়ার আন্দোলনে পুলিশের লাঠিপেটা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। নার্সদের কাজ খুব কঠিন অথচ তাদেরকে শ্রমজীবী হিসেবে খুব একটা ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিক সংগঠনের আলোচনায় দেখা যায়। এটা যেন স্বাস্থ্য বিভাগের বিষয়। বিশেষ খাতের শ্রমিক হিসেবে তারা আন্তর্জাতিক শ্রম সনদের মধ্যে থাকলেও এখানকার ট্রেড ইউনিয়ন তাদের দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে কোন কর্মসূচি দেয়নি। বরং দেখা গেছে সরকার তাদের আন্দোলনকে বড় নির্দয়ভাবে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। গত ৩০ মার্চ, ২০১৬ নার্সদের দ্বিতীয় দফা প্রতিবাদ আন্দোলন কর্মসূচিতে ঢাকার শাহবাগে নার্সদের ওপর পুলিশ বেধড়ক লাঠি চালায়। এতে অনেকে আহত হন। এমন কি জলকামান ও টিয়ারশেল সাউন্ড গ্রেনেড চালিয়ে ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টির পর তাদের ওপর হামলা চালানো হয়।

যানজট সৃষ্টির কথা বলে তাদের ওপর অমানবিক হামলা চালানো হয়। অথচ রাজনৈতিক দলের কর্মসূচির কারণে, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ভি আই পিরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গেলে যখন যানজট সৃষ্টি হয় তার জন্যে কারো ওপর কোন প্রশ্ন তোলা হয় না। মিডিয়াতেও নার্সদের কর্মসূচির কারণে যানজটের কথা বেশি করেই বলা হয়েছে।

সরকার তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সরকারি হাসপাতালে নির্ধারিত সংখ্যক নার্স অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হবে। কিন্তু সেটা না করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে পরীক্ষা নিয়ে নার্সদের নিয়োগ দেয়া হবে। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিনিয়র স্টাফ নার্সের ৩,৬১৬ পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছে। এই নিয়োগ পরীক্ষার মাধ্যমে হবে। এর অর্থ হচ্ছে বয়সের কারণে অনেক নার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। নার্সদের প্রথম দফা আন্দোলন জানুয়ারি মাসে শুরু হয়েছিল এবং টানা ১০ দিনব্যাপী অব্যাহত ছিল। পরে তাদের আশ্বাস দেয়ায় তারা স্থগিত করেছিল।

আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাংলাদেশ ডিপ্লোমা বেকার নার্সেস অ্যাসোসিয়েশন (বিডিবিএনএ) ও বাংলাদেশ বেসিক গ্র্যাজুয়েট নার্সেস সোসাইটি (বিজিএনএস)। তাদের দাবি পরীক্ষার মাধ্যমে নার্স নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্ত বাতিল করা এবং আগের মতো ৩৬ বছর পর্যন্ত বয়স প্রমার্জনা করে ডিপ্লোমা বেকার নার্সদের ব্যাচ, মেধা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া। এই খবরগুলো পত্র-পত্রিকায় এসেছে, কিন্তু খুব সহানুভূতি পায় নি।

মে দিবসে দুটো বিষয় প্রধানত সামনে আসে। এক, মজুরি, দুই. কাজের ঘণ্টা ও কাজের পরিবেশ। বাংলাদেশ এখনো পৃথিবীতে সস্তা-শ্রমিকের দেশ হিসেবেই পরিচিত। গার্মেন্ট শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি ৭০০০ টাকা দাবি করে ৫১২৮ টাকা লাভ করেছেন, অন্য খাতে তা আরও মাত্র ২৫৫৩ টাকা। আর নারী হলে তো কথাই নাই। একই কাজে একই মজুরির দাবি দীর্ঘ দিনের কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাব মতে ফরমাল সেক্টরে পুরুষদের গড় মজুরি ৩৯০৬ টাকা, নারীর মজুরি ২৭৮১ টাকা, ইনফরমাল সেক্টরে পুরুষদের গড় মজুরি ৩৫৭৩ টাকা, নারীর মজুরি ২৩৭৪ টাকা । নারী-পুরুষের মজুরি বৈষম্য এতো প্রমাণের পরও দূর করা সম্ভব হচ্ছে না। ফরমাল সেক্টরের তুলনায় ইনফরমাল সেক্টরে মজুরি ৮% কম।

মজুরি নির্ধারণ করা হয় দৈনিক ৮ ঘণ্টা, সাপ্তাহিক একদিন বা দুই দিন ছুটি ধরে। সপ্তাহের মোট কাজের ঘণ্টা ৫৬ হওয়ার কথা। এর চেয়ে বেশি হলে তা ওভার টাইম বলে গণ্য হবে। অবশ্য সেই নিয়ম সব ক্ষেত্রে পালন করা হয় না।

মে দিবস অমর হোক। স্মরণ করছি, তাজরীন ও রানা প্লাজার নিহত ও আহত হাজার হাজার শ্রমিককে যারা মাত্র একটি দুর্ঘটনায় শ্রমিকের সংজ্ঞা থেকেই ছিটকে পড়ে গেলেন। তাদের ন্যূনতম মজুরি বা কাজের ঘণ্টা নিয়ে আর কোনো আন্দোলন নেই। তারা এখন কবরে কিংবা ঘরে পঙ্গু হয়ে পড়ে আছেন। আজ তাদের কাছে আমাদের ক্ষমা চাওয়ার দিন। জানি শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি, কিন্তু তবুও এই দিনটিতে কিছুটা হলেও শ্রমিকের অধিকারের প্রশ্ন তুলে ধরা যায়। অমর হোক মে দিবস।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও মানবাধিকারকর্মী

 

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত