শিক্ষা যে জাতীয় উন্নয়নের মূল চাবিকাঠি তথা জাতির মেরুদণ্ড, সে কথা সুবিদিত। বস্তুত একটি জাতির সমৃদ্ধি ও অগ্রগতি নির্মিত হয় এই শিক্ষার আলোকে। একটি সমাজ স্বাস্থ্য, অবকাঠামো এবং অর্থ বিষয়ে কাজ করতে পারে, কিন্তু শিক্ষার মাধ্যমে সেখানে মানবিক পুঁজির উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে ‘সকলই গড়ল ভেল’—মনে হবে যেন সেগুন কাঠের মাচার ওপর বহুতল বিশিষ্ট এক দালান দাঁড়িয়ে আছে।
আবার বেদনাদায়ক যদিও, সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থায় ধনী-গরিব কিংবা শহর-গ্রাম বিভাজন উন্নয়নকে উপহাস করে। যে উন্নয়ন বিভাজন লালন করে, সে উন্নয়ন প্রকৃত উন্নয়ন নয় বলে মনে করেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্টের (বিআইজিএম) পরিচালক ড. মোহাম্মদ তারেক ও গবেষণা সহযোগী তাসফিয়া তাসনীম আহমেদ ‘ক্রমবর্ধমান গ্রামীণ-শহুরে শিক্ষা বিভাজন বাংলাদেশের ভবিষ্যেক ক্ষতিগ্রস্ত করছে’ শিরোনামে একটি গবেষণালব্ধ, প্রণিধানযোগ্য প্রবন্ধ পেশ করেছেন। অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং অনুধাবনীয় এই নিবন্ধটি থেকে নীতিনির্ধারক তথা দেশ, সমাজ চিন্তকরা চিন্তার খোরাক পাবেন।
দুই.
দুই গবেষক শিক্ষায় গ্রাম-শহর বিভাজন অনুসন্ধান করতে গিয়ে লক্ষ করেছেন যে ২০২৩ সালের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষায় যে ৪৮টি স্কুলে পাসের হার শূন্য শতাংশ, সেগুলোর বেশির ভাগ গ্রামাঞ্চলে অবস্থিত। এমনকি এক কালে শিক্ষার মানের জন্য সুপরিচিত জিলা স্কুলগুলোও দিন দিন তাদের গৌরব হারাচ্ছে বাদশাহ বাহাদুর শাহর বংশধরদের মতো। কিন্তু আমাদের ধারণা, গ্রামীণ বা শহরের বাইরের শিক্ষার্থীরাও কম মেধাবী নয়, তাহলে তাদের দীপ্তিময় হয়ে উঠতে বাধা কোথায়? নাকি শেকসপিয়ারের ওই কথা, ‘প্রিয় ব্রুটাস দোষ আমাদের নক্ষত্রে নিহিত নয়, দোষ আমাদের মাঝেই, আমরা যে অন্যের অধীন।’
তিন.
বাংলাদেশ এডুকেশন ফ্যাক্ট শিট ২০২০ মতে, দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ এমন শিশুদের বেশির ভাগ গ্রামীণ এলাকায় বাস করে এবং তাদের মধ্যে চার-পঞ্চমাংশ সংখ্যাগত দক্ষতা এবং প্রায় সমানুপাত পড়ার দক্ষতা অর্জন করতে অপারগ। অন্যদিকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলের শিশুদের চার-পঞ্চমাংশ বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে এবং তিন-চতুর্থাংশ পুনরাবৃত্তিকারী অর্থাৎ পুনরায় একই ক্লাসে পড়তে হয়। অধিকন্তু যারা প্রাথমিক বা মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করে না, সেই শিশুদের ৮০ শতাংশ গ্রামীণ এলাকায় বাস করে।
দুঃখজনক এই গল্পের এখানেই শেষ নয়। এই বিভাজনের বলয়ে টারশিয়ারি বা তৃতীয় স্তরের শিক্ষার জন্যও কোনো সুসংবাদ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং পলিটেকনিক থেকে স্নাতকদের বেশ কিছু ট্রেসার স্টাডিতে দেখা গেছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতি ১০০ জনে ৬৬ জন মেট্রোপলিটন, শহুরে ও আধাশহুরে এবং মাত্র ৩৩ জন গ্রামীণ এলাকা থেকে আসা। ‘যেহেতু আমাদের স্কুলে পড়া জনসংখ্যার প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রামীণ এলাকা থেকে আসে, এই তথ্য স্পষ্টভাবে দেখায় যে বেশির ভাগ গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় কড়া নাড়তে অক্ষম। আর বিব্রতকর সংবাদ এই যে চাকরির সঙ্গে সংযুক্ত কারিগরি এবং উচ্চশিক্ষার রাস্তাটির বেশির ভাগই গ্রামীণ শিক্ষার্থী পর্যন্ত পৌঁছায় না।’
চার.
গবেষক ড. মোহাম্মদ তারেক ও তাসফিয়া তাসনীম আহমেদ বলছেন, গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মূল্যবান জীবন বৈষম্যের নিষ্ফলা মরুভূমিতে ম্রিয়মাণ হয়ে যাচ্ছে। তার চেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গ্রাম-শহর শিক্ষা বিভাজন বৈষম্যকে স্থায়ী করতে পারে এবং একটি দেশ বা অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। উন্নয়নের প্রথম দিকে অর্থনৈতিক বৈষম্য অনিবার্য, যেমনটি বলে থাকেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদরা, কিন্তু এই বিভাজন উন্নয়নের জন্য নেতিবাচক ফল বয়ে বেড়ায়। বাংলাদেশ শিক্ষা পরিসংখ্যান ২০২২ অনুযায়ী, প্রায় ৮০ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পল্লী অঞ্চলে অবস্থিত বিধায় ওখানকার শিক্ষার্থী ও প্রতিষ্ঠানের মান নিশ্চিত করতে না পারলে সামগ্রিক শিক্ষার মান ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অর্জনের স্বপ্ন অপূর্ণ, এমনকি অধরা থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
গবেষকদ্বয়ের ধারণা, শিক্ষায় বৈষম্যের পেছনের চালকগুলো বুঝতে হলে প্রথমেই শিক্ষকের গুণমানের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসম্মত শিক্ষা প্রদানের জন্য শ্রেণিকক্ষে উঁচু গুণসম্পন্ন শিক্ষকের উপস্থিতি অপরিহার্য, যেমনটি ইদানীংকালের গবেষণা নিশ্চিত করে। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে যোগ্য ও প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অভাব সত্যিকারভাবেই একটি জাতীয় সমস্যা। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে ভুটান, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ডে মোট প্রশিক্ষিত শিক্ষকের অনুপাত শতভাগ, নেপাল ও মিয়ানমারে ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশ এবং ভারতে ৮৯ শতাংশ। অথচ এর বিপরীতে বাংলাদেশে সেই অনুপাত মাত্র ৭৪ শতাংশ, যেখানে আবার গুণমান প্রশ্নবিদ্ধ। বলা বাহুল্য, গ্রামাঞ্চলে এই পরিস্থিতি আরো জটিল। সুতরাং গ্রামীণ পরিবেশে দক্ষ শিক্ষকদের আকৃষ্ট করা এবং ধরে রাখা, যা শিক্ষার মানকে প্রভাবিত করে, অতীতের মতো আগামী দিনেও কঠিন থাকছে বলে মনে হওয়ার যথেষ্ট যুক্তি থাকতেই পারে।
অন্যদিকে এবং অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওর (মান্থলি পে অর্ডার) আওতায় আনার ব্যবস্থা যেন ছদ্মবেশে অভিশাপ হয়ে উঠছে। এটি গ্রামীণ বা স্থানীয় স্কুলগুলোতে শ্রেষ্ঠত্বের সন্ধান এবং তাদের কৃতিত্ব উন্নত করার মানসিকতার কবর খুঁড়ছে। পল্লী অঞ্চলের অনেক বিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রায়ই অনুপস্থিতিতে প্রমাদ গোনে। এবং গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো স্কুল কমিটির রাজনৈতিকীকরণ এবং স্থানীয় মালিকানার অনুপস্থিতি পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে ধাবিত করছে। আর এসবের প্রভাব ডেকে আনছে ভয়াবহ পরিণতি; যেমন—গ্রাম্য দলাদলি এবং বিদ্যালয়ের দুর্বল ব্যবস্থাপনা, যা শিক্ষাসূচক পরিবেশের মানকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
পাঁচ.
অন্য অনেক খাতের মতো আমরা মনে হয় শিক্ষা খাতের উন্নয়নকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের ফিতায় পরিমাপ করছি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গুণ নয়, বরং সংখ্যায় তুষ্ট থাকছি। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে এটি অবকাঠামো বা শিক্ষক বা শিক্ষার্থীদের সংখ্যা সম্পর্কে নয়—অনেক জায়গায় স্কুল আছে, যেখানে একেবারেই ভর্তি নেই। এমনতর উন্নয়ন একেবারেই কোনো উদ্দেশ্য সাধন করে না। মোটকথা, উন্নয়নের সূচক হিসাবে স্কুল গণনা বন্ধ করতে হবে এবং উচ্চমানের শিক্ষা নিশ্চিত করার দিকে আমাদের মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হবে।
সন্দেহ নেই যে বাংলাদেশ ক্রমান্বয়ে ডিজিটাল রূপ ধারণ করছে। তবে তত্ত্বাবধানহীন ডিজিটাল মিডিয়া এবং প্রযুক্তির অত্যধিক ব্যবহার গ্রামীণ শিক্ষার্থীদের মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এটি শহুরে ছাত্রদেরও প্রভাবিত করে, কিন্তু শহুরে অভিভাবকদের তত্ত্বাবধানের ক্ষমতা এবং সচেতনতায় প্রযুক্তির দুর্বল ব্যবহারের ক্ষতিকারক প্রভাবগুলো কিছুটা হলেও হ্রাস পায়, অথচ গ্রামের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সেটি হয় না। উল্লেখ করতেই হয় যে উদ্বেগজনক এই পরিস্থিতির কারণে অনেক শিক্ষার্থী পড়ালেখা থেকে ছিটকে যাচ্ছে।
ছয়.
নিঃসন্দেহে আমাদের মেয়েরা ক্রমাগতভাবে ভালো ফল করছে, কিন্তু এখনো বাল্যবিবাহের কারণে ঝরে পড়ার হার বেশি। বাংলাদেশে প্রায় ৬০ শতাংশ নারীর ১৮ বছর বয়সের আগে বিয়ে হয়েছে এবং গ্রামীণ এলাকায় বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি, যা মাতৃ ও শিশুমৃত্যুসহ বিরূপ ফলাফলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাল্যবিবাহের জন্য প্রায়ই তাড়াতাড়ি সন্তান ধারণ মেয়েদের শিক্ষার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং সে কারণেই কেবল তাদের স্কুল ছেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। অথচ এসব মেয়ের উচ্চ সম্ভাবনা সুপ্ত থাকে এবং তারা কর্মশক্তিতে একটি বড়মাপের অবদান রাখতে পারে। কিন্তু আমরা দেখছি, বাল্যবিবাহের জন্য শিক্ষার আলো থেকে তারা হারিয়ে যাচ্ছে অতল গহ্বরে।
সাত.
আরো একটি সমস্যা স্কুল পাঠ্যক্রমের দ্রুত পরিবর্তন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অনেক আন্তরিক শিক্ষক তাঁদের অভিজ্ঞতা ও পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষার উপকরণ তৈরি করেছিলেন, যা এখন অবলুপ্তির পথে। বোঝাই যাচ্ছে যে ভিত্তি মানের পার্থক্যের কারণে গ্রামীণ শিক্ষকরা আরো সমস্যায় পড়বেন। সুতরাং নীতিসংক্রান্ত উপদেশ হচ্ছে নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার জন্য তাঁদের ব্যাপক সহায়তা এবং ক্রমাগত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা।
তাছাড়া সন্দেহাতীতভাবে মৌলিক সমস্যা হলো গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থা এই বিভাজনকে গভীর থেকে গভীরতর করে। বাড়িতে পরের বেলার খাবার না থাকলে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া কঠিন। দারিদ্র্য বোধগত জ্ঞানের উন্নয়নে বাধা দেয়। অনিশ্চয়তা এবং উদ্বেগের অনুভূতি দারিদ্র্য থেকে উদ্ভূত হয় বিধায় দরিদ্র পরিবারের শিশুদের চেষ্টা ব্যাহত হয়। ফলে গ্রামাঞ্চলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী স্কুল ছেড়ে দেয় এবং যারা ঝরে পড়ে না, তারাও যে আক্রান্ত হয়, তা বলাই বাহুল্য। বিদ্যমান অন্ধকারের অন্য এক দিক হচ্ছে অনেকেই শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ এডুকেশন ফ্যাক্ট শিট ২০২০ অনুযায়ী, শিশুশ্রমের হার গ্রামীণ এলাকায় বেশি। এমনকি যদি শিক্ষার্থীরা স্কুলে থাকে বা শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িত না থাকে, তবু তারা শিক্ষাগত সম্পদের সুযোগের অভাবের কারণে ভোগে।
আট.
নতুন পাঠ্যক্রম ব্যাবহারিকভিত্তিক এবং সৃজনশীল হওয়ার কারণে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে—এমন আশা থাকা সত্ত্বেও এটি বিদ্যমান বিভাজনকে আরো বাড়িয়ে তুলতে পারে, এমন সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। শিক্ষার উপকরণ এবং সরবরাহের জন্য পাঠ্যক্রমের চাহিদা অসংখ্য দরিদ্র গ্রামীণ পরিবারের আর্থিক সামর্থ্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়ার হার বা একাডেমিক চ্যালেঞ্জের দিকে নিয়ে যেতে পারে।
এমতাবস্থায় গ্রাম-শহর শিক্ষাবৈষম্য কমাতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য। নীতিনির্ধারক, শিক্ষাবিদ, সম্প্রদায়ের নেতা এবং স্টেকহোল্ডারদের এমন সমাধান বাস্তবায়নে আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করতে হবে, যা এই ব্যবধান পূরণ করবে এবং আগামী প্রজন্মের জন্য আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যতের পথ প্রশস্ত করবে।
লেখক :অর্থনীতিবিদ ও সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়