১৯৯০ সালের ১৮ মার্চ ৮ম শ্রেণি পাস দেখিয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনে (বিএসসি) গাড়ি চালকের পদে চাকরি নেন মো. নূর নবী।ওই সময় দেওয়া কাগজপত্র অনুযায়ী তাঁর জন্মতারিখ ২ মার্চ, ১৯৬৪ ইংরেজি। সে হিসাবে তাঁর অবসরে যাওয়ার কথা ২০২৩ সালের ২৩ মার্চ। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে ঘষামাজা করে নিজের জন্মসাল চার বছর কমিয়ে আরো আরো ৪ বছর চাকরি করতে চান এই গাড়ি চালক। তবে এই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ার পর মন্ত্রণালয় থেকে তাকে প্রথমে চাকুরিচ্যুত করা হয়। তবে মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশ দ্রুত কার্যকর না করে নূর নবীকে উচ্চ আদালত পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ করে দেয় শিপিং কর্পোরেশনেরই একটি চক্র ৷ ইতিপূর্বে মাত্র কয়েক দিনেই নূর নবীকে ভবিষ্যৎ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হয় ১৮ লক্ষ টাকা৷ তবে বাংলাদেশ বুলেটিনের অনুসন্ধান বলছে, নূর নবী শুধু যে বয়সের হেরফের করেছে তা নয়, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়েও তদন্ত হওয়া প্রয়োজন৷ কারণ ৯ম শ্রেণীতে উত্তীর্ণের ট্রান্সফার সার্টিফিকেট দেখিয়ে যিনি সরকারি চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছেন৷ সেই তিনিই এখন বলছেন, "আমি লেখা পড়া জানি না৷"
মো. নূর নবী ১৯৯০ সালের ১৮ মার্চ চাকরিতে যোগদানের সময় যে সব কাগজপত্র জমা করেছিলেন সেসব নথি বলছে, তাঁর জন্মতারিখ ১৯৬৪ সালের ২ মার্চ। বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনে কর্মরত কর্মচারীদের ১৯৯৪, ১৯৯৫, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ২০০১, ২০০২, ২০০৩, ২০০৫, ২০০৬, ২০০৯ এবং ২০১৩ সালের প্রকাশিত তালিকা ঘেঁটে দেখা গেছে নূর নবীর জন্মতারিখ ও সাল ২ মার্চ ১৯৬৪ইং৷ এছাড়া ২০০৯ ও ২০১৩ সালে সিবিএ নির্বাচনের জন্য প্রশাসন বিভাগ থেকে প্রস্তুত করা তালিকায়ও তার জন্ম তারিখ ২ মার্চ ১৯৬৪ দেখা গেছে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত তার বার্ষিক গোপনীয় প্রতিবেদনে (এসিআর) ব্যক্তিগত তথ্যের অংশে জন্ম তারিখ ২ মার্চ ১৯৬৪ লিখে নূর নবী দেখানো স্বাক্ষরও করেছেন। কিন্তু ২০১৫ সাল এসে তার জন্মতারিখ ও সন নিয়ে চতুরতা শুরু করেন নূর নবী। ২০১৫ সাল থেকে পরবর্তী বছরগুলোতে নূর নবী তার জন্মতারিখ লিখতে শুরু করেন ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ ইং।
জন্মসন ১৯৬৪ হিসেবে অবসরের যাওয়ার মাত্র ৫ মাস আগে ২০২২ সালের ২৩ অক্টোবর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ভবিষ্য তহবিল থেকে ১৮ লাখ টাকা গৃহনির্মাণ ঋণ চেয়ে আবেদন করেন গাড়িচালক নূর নবী। সেই আবেদনে নিজের জন্মতারিখ ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ উল্লেখ করা হয় । আবেদনটিতে বিভাগীয় প্রধান হিসেবে সুপারিশ করেন ড. পিযূষ দত্ত । আর তার একদিন পরই অনুমোদন হয়ে যায় নূর নবীর ১৮ লাখ টাকার ঋণ আবেদন। অফিসের একাধিক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই প্রতিবেদককে বলেন, "এরচেয়ে কম অংকের ঋণের আবেদন মঞ্জুর হতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হয়। অথচ নূর নবীর ঋণ তিন দিনেই মঞ্জুর হয়।" ধারণা করা হচ্ছে, চাকরির অবসরের মেয়াদ বাড়াতে আইনি মারপ্যাঁচে ফেলতেই পরিকল্পিতভাবে এই ঋণগ্রহণ করেছিলেন নূর নবী৷ কারণ ঋণের আবেদনে ১৮ লাখ টাকার ঋণ ৩০ মাসের কিস্তিতে (প্রতি মাসের বেতন থেকে ৬০ হাজার টাকা করে) পরিশোধের কথা উল্লেখ আছে৷ অথচ জন্ম তারিখ ১৯৬৪ অনুযায়ী তখন তাঁর আর ৫ মাস চাকুরির মেয়াদ ছিল৷ প্রশ্ন উঠেছে যেখানে মন্ত্রণালয়ের তদন্তে নূর নবীর জন্মসাল ১৯৬৪ প্রমাণ হয়। সেখানে ইতিপূর্বে নূর নবীকে ১৮ লাখ টাকা ঋণ অনুমোদনের সময় কেন সেটি ধরা যায়নি বা ধরা হয়নি৷ এক্ষেত্রে কর্পোরেশনের মানব সম্পদ ও হিসাব শাখার দায়িত্বশীলদের গাফিলতি থাকতে পারে বলে মনে করছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিপিং কর্পোরেশনেরই একাধিক কর্মকর্তা৷
দ্রুততম সময়ে বিরাট অংকের ঋণ অনুমোদনের পর বিষয়টি অফিস জুড়ে আলোচনার জন্ম দেয়৷ তবে অবসরে যাওয়ার সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও নূর নবী অফিসে কর্মকরত থাকায় বিষয়টি খতিয়ে দেখতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নূর নবীর বয়স কমানোর কাণ্ড৷ অবসরের বয়স পূর্ণ হওয়ার পরও কর্মস্থলে বহাল থাকায় নূর নবীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন শ্রমিক-কর্মচারী ইউনিয়ন (সিবিএ) নেতারা ৪ পৃষ্ঠার একটি অভিযোগ বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাঠান। ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ ওই চিঠির অনুলিপি পাঠানো হয় নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ে। অভিযোগটি আমলে নিয়ে ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে একটি চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে গাড়িচালক মো. নূর নবী ৫৯ বছর বয়স পূর্তির পর অবসরে না গিয়ে কীভাবে সংস্থার চাকরিতে বহাল রয়েছেন স্পষ্ট করতে তার যোগদানের সময় আবেদনপত্রে উল্লিখিত বয়স, সপক্ষে দাখিলকৃত সকল প্রমাণপত্র এবং সার্ভিসবুক সহ সংশ্লিষ্ট সকল কাগজপত্র পাঠারোর অনুরোধ করে মন্ত্রণালয়।
এর দুদিন পর ৫ সেপ্টেম্বর মন্ত্রণালয়ের চাওয়া কাগজপত্র পাঠায় বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন। সেখানে গাড়িচালক মো. নূর নবী তার জন্মতারিখ ২ মার্চ ১৯৬৪ এর পরিবর্তে ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৮ দেখান। চাকরিতে বহাল থাকার সপক্ষে বয়স কমিয়ে বিদ্যালয় পরিবর্তনের সার্টিফিকেট, জন্মসনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র দাখিল করেন। তবে জন্মতারিখ পরিবর্তনযোগ্য নয় জানিয়ে ‘২ মার্চ, ১৯৬৪’ জন্মতারিখ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়ে অবসরের ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালককে চিঠি পাঠায় মন্ত্রণালয়। ২০২৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ওই চিঠি পাঠানো হয়।
মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনার পর গাড়িচালক মো. নূর নবীকে অবসরে পাঠানো যায়নি। অভিযোগ উঠেছে মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশ দ্রুত কার্যকর না করে কালক্ষেপণ করা হয়৷ আর সেই সুযোগে বিএসসি'র ব্যবস্থাপনা পরিচালক, মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন), সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং চিঠি ইস্যুকারী উপ-সচিবের বিরুদ্ধে নূর নবী যান শ্রম আদালতে। মন্ত্রণালয় এবং শিপিং কর্পোরেশনের সিদ্ধান্ত ‘বেআইনি’ দাবি করে আদেশের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা চান গাড়িচালক নূর উদ্দীন। তবে আদালত যাবতীয় কাগজপত্র পর্যালোচনা করে তার সেই আবেদন মঞ্জুর করেননি।
এদিকে মন্ত্রণালয় এবং শ্রম আদালতের রায়ের পরেও গাড়িচালক মো. নূর নবীকে অবসরে পাঠানো যায়নি। এই বিষয়ে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আশরাফুল আমিনের সাথে যোগাযোগ করা হয়। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের সচিব হিসেবে কর্মরত আছেন। মোহাম্মদ আশরাফুল আমিন গণ মাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা মন্ত্রণালয়ের আদেশ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের আদেশ আসার পর সেই আদেশকে বেআইনি দাবি করে শ্রম আদালতে মামলা করেন গাড়িচালক মো. নূর নবী। মন্ত্রণালয়ের আদেশের ওপর অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসেন। পরবর্তীতে আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলেও শুনানি চলমান রাখার আদেশ দেন। সেজন্য তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। এর পরপরই গাড়িচালক মো. নূর নবী উচ্চ আদালতে গিয়ে আবারও অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসেন। মামলাটি এখনও চলমান রয়েছে তাই ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হয়নি।’
ছাতার পাইয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের ৯ম শ্রেণীতে উত্তীর্ণের পরিবত্তন সার্টিফিকেট ব্যবহার করে ১৯৯০ সালে সরকারি চাকুরিতে যোগ দেয় নূর নবী৷ ১৯৮৯ সালের ২ জুলাই বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক স্বাক্ষরিত পরিবত্তন সার্টিফিকেটটিতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম, মনোগ্রাম ছাপা নেই৷ সাদা কাগজে শুধুমাত্র একটি গোল সিল মারা একটি পরিবত্তন সার্টিফিকেট নূর নবী জমা দিয়েছিলেন৷ তবে তিনি আদৌ সেই স্কুলে পড়েছিলেন কিনা সেই বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, "অবশ্যই পড়েছি৷ তা না হলে কি সার্টিফিকেট দিতো?" যদি ৮ম শ্রেণি পাসই করেই থাকেন তাহলে শিপিং কর্পোরেশনের লিগ্যাল অ্যাডভাইজার ব্যারিস্টার সাইফুদ্দিন মাহমুদের স্বাক্ষরিত প্রতিবেদনে "লেখাপড়া জানি না তাই অন্য কেউ লিখে দিত৷ আমি শুধু স্বাক্ষর করে দিতাম। লিখতে পারি না পড়তে পারি।" মর্মে আপনার বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল কেন ? এই প্রশ্নের কোন জবাব তিনি আর দিতে পারেনি৷ ছাতার পাইয়া স্কুলটি কোথাই জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে জানান, ফেনীতেই। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে ছাতার পাইয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় নামের একটি স্কুল আছে নোয়াখালি জেলার সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া ইউনিয়নে অবস্থিত৷ এক পর্যায়ে নূর নবী বলেন, "আমার স্কুলের কাগজ আমার বড় ভাই সব রেড়ি করে পাঠিয়েছিলেন৷ আমি তখন চিটাং শহরে হেলপারি করি।"
এই বিষয়ে বিএসসি'র মহা ব্যবস্থাপক কমোডর মাহমুদুল মালেকের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এই বিষয়ে উচ্চ আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা ও মামলাটি এখনও চলমান থাকায় এই মুহূর্তে নূর নবীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না৷ তবে আমি ইতিমধ্যে নূর নবীকে সচিবালয় থেকে পুলে বদলি করেছি৷ আমরা আদালতের পূর্ণাঙ্গ আদেশের অপেক্ষায় আছি। বিষয়টি আমাদের লিগ্যাল টিম দেখছে৷ আশা করছি বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে।" কোন কর্মকর্তা বা কর্মচারীকে তাদের নিজ নিজ বৈধ ও যৌক্তিক প্রাপ্যের বাহিরে কর্পোরেশনের একটি বাড়তি টাকাও নিয়ে যেতে দেয়া হবে না বলে জানান শিপিং কর্পোরেশনের এমডি।