কোটাসংস্কার আন্দোলন চলাকালে মাদরাসা পড়ুয়া ভাইকে আনতে গিয়ে ঢাকার আজমপুরে গুলিবিদ্ধ হয়ে গত ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার নিহত হন রায়পুরার বাসিন্দা চিকিৎসক সজিব সরকার(৩০)।
ওইদিন রাতেই উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে স্বজনরা নিহতের লাশ উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসে। পরদিন তাঁর মরদেহ নিজ এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ঘটনার সপ্তাহ পেরোলেও থামেনি স্বজনদের শোক-আহাজারি। উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন সজিবের মৃত্যুতে এখন অথৈ সাগরে ভাসছে পুরো পরিবার।
নিহত সজিব নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলার মির্জানগর ইউনিয়নের মেঝেরকান্দি গ্রামের মো হালিম সরকারের ছেলে। তিনি ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের প্রভাষক ছিলেন। বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে রোগীদের সেবা দিতেন। তিনি তিন ভাই এক বোনের মাঝে সবার বড় ছিলেন।
নরসিংদীর ভাড়া বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ছেলেকে হারিয়ে মা ঝর্ণা বেগম(৫৬) এখন পাগলপ্রায়, অসুস্থ হয়ে অক্সিজেন নিচ্ছে। ছেলের স্মৃতিচারণ করে বিলাপ করে মুরছা যাচ্ছেন।
অশ্রুশীক্ত নয়নে পানি ঝরছে। তিনি বলছেন, দীর্ঘদিন যাবত অসুস্থ। সজিব সবসময় আমাকে ছোট্ট সন্তানের মত আগলে রাখতো। আমি সহ সকলের খরচ যোগাতো। ১৮ জুলাই, ওই দিন ১১ টায় বাসা থেকে ছোট ছেলেকে আনতে বের হন। বেলা সাড়ে ৪টা থেকে ৫ টার মধ্যে আজমপুর পৌঁছে ফোনে কথা হয়। রাত ১ টা পর্যন্ত ছেলের অপেক্ষায় বসে ছিলাম। আমাদের যা ছিলো সব ছেলেকে ডাক্তার বানাতে ব্যয় হয়েছে। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব।
আমার ছেলে হত্যার বিচার কিভাবে পাবো সেটাই চাইবো। সবাই যাতে জানে সজিব ডাক্তার নির্দোষ হয়ে মারা গেছে। সজিব যেন আজীবন সবার মাঝে বেঁচে থাকে এমন কিছু একটা নামকরণ করা হউক।
শিক্ষার্থী বোন সুমাইয়া সরকার সর্ণা বলেন, গত ১৮ জুলাই দুপুরে ঢাকার উত্তরার রাজলক্ষ্মীর একটি কওমি মাদ্রাসা পড়ুয়া ছোট ভাই আব্দুল্লাহকে আনতে নরসিংদীর বাসা থেকে বের হন। তুমুল আন্দোলনের সময় আজিমপুরে গিয়ে বাস থামে। বিকেল ৫-৬ মধ্যে আজমপুর বাস থেকে নেমে রাজলক্ষ্মী মাদ্রাসায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে থাকে। এ সময় পুলিশের ছুঁড়া গুলিতে নিহত হন।
সন্ধ্যা ৭ টায় ভাইয়ের বন্ধুর মাধ্যমে ভাই নিখোঁজের খবর পাই। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশ খুঁজে পেয়ে বাড়িতে নিয়ে আসি। জানতে পারি বিকেলে আজমপুরের রাস্তায় পুলিশের ছুঁড়া গুলিবিদ্ধ হন। কয়েকজন লোক গুলিবিদ্ধ ভাইকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত ঘোষণা করেন। সবি ভাইয়ের উপার্জনে চলতো, এখন কী করে চলবে সংসার?
ভাই আব্দুল্লাহ বলেন, এর আগের সপ্তাহে ভাই মাদরাসায় এসে সর্বশেষ দেখা হয়। আর বলে যায় ১৮ তারিখ বৃহস্পতিবার মাদরাসা ছুটি হলে আমাকে নিতে আসবে।কয়েক বছর ধরে মাদ্রাসায় থাকলেও বাড়ি আসা যাওয়ায় একা বের হতাম না। ভাই আনা নেয়া করতো। ওই দিন বিকেলে তিন বার ভাইকে ফোন দিয়ে না পেয়ে ব্যাগ নিয়ে ভাইয়ের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষায় বসে থাকি।
রাত নয়টায় পরিচিতজন মাদ্রাসায় এসে বলল, তোমার ভাই হাসপাতালে অসুস্থ। এসে ভাইয়ের লাশ দেখতে পাই। ভাইকে রাতেই উত্তরার একটি মসজিদে গোসল করাতে গিয়ে কাপড় সরাতেই দেখি ভাইয়ের বুকের সামনের অংশে গুলির বড় গর্ত হয়ে পিছন দিক দিয়ে বের হয়েছে। দুই পাশ দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। বুকের নিচে দুই তিনটা রাইফেলের ক্ষত ছোট গর্ত, ভিতরে নীল জমাটবদ্ধ রক্ত। ভাইয়ের উপার্জনে ভাই বোনের পড়াশোনা, মায়ের চিকিৎসা ও পরিবারের খরচ চলতো। ভাই আমাদের প্রাণ ছিলো। এখন কি করে চলবে?
চিকিৎসকের বাবা মো হালিম সরকার(৫৮) বলেন, ছেলেকে খুব কষ্ট করে ঢাকার উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল এন্ড কলেজে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ পর্যন্ত পড়াশোনা করাই। গত ২০২০ সালে টঙ্গীর বেসরকারি তাইরুন্নেছা মেমোরিয়াল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসক হন। তাকে চিকিৎসক বানাতে গিয়ে দিতে হয়েছে সর্বত্র, ঋণে জর্জরিত।
ইদানীং সে ঋণগ্রস্ত পরিবারের হাল ধরেন। তার উপার্জনে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসা ও ভাই বোনের পড়াশোনা এবং সংসার চলতো দেয়া হতো ঋণ। সকলে তাকে ঘিরে কতইনা স্বপ্ন বুনেছিলাম। তার কি অপরাধ ছিল যে সে গুলিতে নিহত হলো। কার কাছে চাইব বিচার? কে করবে বিচার, কে দিবে ক্ষতিপূরণ? যা সহায় সম্বল কামাই ছিলো সব ছেলে ডাক্তার বানাতে ব্যয় করেছি। ছেলে আমার ছায়া ছিলো, এখন আমার সব শেষ।
আমি আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। ছেলে খুব ধার্মিক ছিলেন। খুব কষ্ট করে ছেলেকে চিকিৎসক হিসেবে দেশের সেবক বানিয়েছি। রাষ্ট্র আমাকে দিল লাশ। ছেলেকে ত আর ফিরে পাবোনা, রাষ্ট্র যদি তদন্ত করে ছেলে হত্যার বিচারটা করে, তাইলেই তার আত্মা ও আমরা শান্তি পাবো।'
স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বলেন, সজিব ডাক্তার হয়ে সময় পেলেই এলাকায় এসে বিনামূল্যে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিতেন। তার মৃত্যু মেনে নেয়ার নয়। খুব ভালো মনের পরহেজগার মানুষ ছিলেন।
ব্রাহ্মণ্যবাড়িয়া মেডিকেল কলেজের সচিব আতিকুর রহমান বলেন, উনি প্রায় এক বছর ল্যাকচারার ছিলেন। তিনি খুব ভালো মানুষ ছিলেন। শুনেছি সে মারা গেছেন।