মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫ ২৪ আষাঢ় ১৪৩২
মঙ্গলবার ৮ জুলাই ২০২৫
নাজমির হাতে এস আলমের চেরাগ: ২ কোটির রেস্টুরেন্টে ১৫১ কোটি টাকা ঋণ
কামরুজ্জামান রনি, চট্টগ্রাম
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪, ৭:২২ PM
চট্টগ্রাম নগরীর লা এরিস্টোক্রেসি, ফিউশন ইটস নামের দুটি রেস্টুরেন্টের মালিক নাজমি নওরোজ। এই দুটি রেস্টুরেন্টের মধ্যে লা এরিস্টোক্রেসি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে। এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় সর্ব সাকুল্যে দুই থেকে আড়াই কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছিলেন নাজমি। তবে এস আলম গ্রুপের যাদুর কাঠির ছোঁয়ায় সেই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা দেখিয়ে নাজমি ব্যাংক থেকে ১৫১ কোটি টাকা ঋণ নিয়েছেন। দেড়শত কোটি টাকা ঋণ নিলেও সেসব শোধ না করায় সুদে-আসলে সেই ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩৪ কোটি টাকা। এখন রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী নাজমি নওরোজ নিজের নামে নেয়া এসব ঋণের দায়ভার চাপিয়েছেন এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল আলম মাসুদ ওপর। গণমাধ্যমের কাছে নাজমি দাবি করেছেন, এস আলমের বদৌলতে তিনি এই বিপুল অংকের ঋণ পেরেছিলেন। তবে সেই টাকা গিয়েছে এস আলম গ্রুপের ঘরেই ফলে ঋণ শোধও করবে এস আলম। যদিও ইতিমধ্যে এই বিপুল অংকের ঋণ আদায়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নাজমি'র বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছে।

ব্যাংক ও বিভিন্ন সূত্রে অনুসন্ধানে জানা যায়, নওরোজ এন্টারপ্রাইজ নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে একজন উদ্যোক্তা হিসেবে নাজমি ২০১৫ সাল থেকে একাধিক ধাপে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম নগরীর ৩টি শাখা থেকে ১৫১ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন। ঋণের বিপরীতে জামানত দেখিয়েছিলেন ৪০ কোটি টাকার সম্পদ। তবে একটি সূত্র বলছে সেই ৪০ কোটি টাকার সম্পদের প্রকৃত বাজার মূল্য অনেক কম। অর্থাৎ নাম মাত্র জামানত দেখিয়ে দুটি রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী (যার মধ্যে একটি বন্ধ) একটি ব্যাংক থেকে ঋণ তুলেছেন ১৫১ কোটি টাকা। আর এসব ঋণ পেতে এস আলম গ্রুপ প্রত্যক্ষ ভাবে সহযোগীতা পেয়েছেন নাজমি৷ পুরো ঘটনার সমন্বয়কের ভূমিকায় ছিলেন এস আলম গ্রুপের মালিক মাসুদ সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিন। নাজমি নওরোজের দাবি, ঋণের টাকা উত্তোলন করে সেই টাকা তুলে দিয়েছিলেন আকিজ উদ্দিনেরই হাতে।
 
ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, নাজমি নওরোজের নগরীর সাইফুদ্দিন খালেদ সড়ক (আসকার দিঘীর পাড়) লা এরিস্টোক্রেসি নামের একটি রেস্টুরেন্ট ছিল। প্রায় দুই কোটি টাকা বিনিয়োগের সেই রেস্টুরেন্টটির বিপরীতে নাজমি নওরোজ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের আসকার দিঘীর পাড় শাখা প্রথম বারেই ঋণ পেয়ে যান ৭০ কোটি টাকা। সেই ঋণ গ্রহণের পর কোনও টাকা পরিশোধ না করায় বর্তমানে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৭ কোটি টাকা। ঋণের অর্থ পরিশোধ না করলেও নতুন করে একই প্রতিষ্ঠানের নামে একই ব্যাংকের প্রবর্তক মোড় শাখা থেকে নাজমি ঋণ নেন ৫৪ কোটি টাকা, যা সুদে-আসলে বর্তমান পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯০ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এরপর নাজমি সেই একই ব্যাংকের চকবাজার শাখা থেকেও ঋণ তুলেছেন ২৭ কোটি টাকা। শুধুমাত্র রেস্টুরেন্ট ব্যবসা দেখিয়ে নাজমি নওরোজ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম শহর এলাকার তিনটি শাখা থেকে সর্বমোট ১৫১ কোটি টাকা ঋণ নিলেও এর বিপরীতে জামানত দেখিয়েছিলেন মাত্র ৪০ কোটি টাকার সম্পদ। অন্যদিকে এসবের মধ্যেই নাজমি তার মালিকানাধীন লা এরিস্টোক্রেসি রেস্টুরেন্টটি সাইফুদ্দিন খালেদ সড়ক থেকে আগ্রাবাদ এলাকায় স্থানান্তর করেন। তবে সেখানে উদ্বোধনের পর দীর্ঘদিন লোকসান হওয়ায় সেটি তিনি বর্তমান বন্ধ করে দেন। 

নাজমি নওরোজ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের যেসব শাখা থেকে ঋণ নিয়েছেন, সেসব শাখায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কেউ বক্তব্য জানাতে রাজি হননি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা বাংলাদেশ বুলেটিনকে বলেন,"আমরা হিসেব করে দেখেছি জামানত হিসেবে যে পরিমান সম্পদ দেখানো হয়েছে বাজার দরে সেই সম্পদের পরিমাণ ততটুকু হওয়ার কথা নয়।” ঋণ অনুমোদনের আগে এসব কতটুকু যাচাই বাছাই করা হয়েছিলো জানতে চাইলে সেই কর্মকর্তা বলেন, “যেখানে কর্তার ইচ্ছাটাই কর্ম সেখানে এসব কোন বিষয়ই না।” এই কর্মকর্তার কথাতেই বুঝা যাচ্ছে নাজমি নওরোজের ঋণ মূলত এস আলম গ্রুপেরই একটি কৌশল। ইতিমধ্যে এই গ্রুপটির বিরুদ্ধে এই ধরণের বহু প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। 

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের থেকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, বর্তমানে সুদে-আসলে নাজমি নওরোজের ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৩৪ কোটি টাকা। ২০২২ সাল পর্যন্ত নাজমি নওরোজ ঋণ শোধ করেছেন মাত্র ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। 

এ বিষয়ে নাজমি নাজমি নওরোজ গণমাধ্যমের কাছে এই বিপুল অংকের ঋণ গ্রহণ এবং এসব যথাযথ সময়ে পরিশোধ না করার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে তিনি নিজেই বলছেন, "আমি ৪০ কোটি টাকার সম্পদ জামানত দিয়ে শত কোটি টাকা ঋণ পাওয়ার কথা নয়। যা কিছু হয়েছে সবই এস আলম গ্রুপের মালিক মাসুদ সাহেবের ইচ্ছায়। আমি ঋণ উত্তোলনের পর সব টাকা এস আলমের মালিক মাসুদ সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনকে দিয়ে দিয়েছি। সেই প্রমাণ আমার কাছে আছে।” তার নামের ব্যাংকের সকল ঋণের অর্থ এস আলমের মাসুদ সাহেবই শোধ করবেন বলেও জানান তিনি। এমনকি, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সাথেও বৈঠকে এই কথা জানানো হয়েছে বলে নাজমি দাবি করেন। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা জানান, নাজমি নওরোজ মূলত এস আলমের ঘনিষ্ঠ আর এস আলম গ্রুপই তৎকালিন সময়ে  ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক ছিল। এস আলমের মালিক সাইফুল আলম মাসুদ ও তার পিএস আকিজ উদ্দিনের নির্দেশনাতেই নাজমি নওরোজকে বিপুল অংকের ঋণ দেওয়া হয়। বছরের পর বছর এতো বিপুল অংকের ঋণ পরিশোধ না করলেও নাজমিকে কখনো ঋণ-খেলাপি দেখানো হয়নি, আর এসবই হয়েছে এস আলম গ্রুপ তথা সামসুল আলম মাসুদ এবং তার ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনের সরাসরি নির্দেশেই। 

দেশে ৫ আগস্টের বিপ্লবের পর একে একে বের হতে থাকে এস আলম গ্রুপের ব্যাংক ক্যালেংকারির ঘটনা। বর্তমানে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হওয়ার পর নাজমি নওরোজের কাছ থেকে ঋণের টাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। 

এসকল ঘটনার সত্যতা জানতে এস আলমের গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুলকে মুঠোফোনে কল করলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও, তার ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দিনের সঙ্গেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। একাধিক সূত্র বলছে, দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা জারির অনেক আগেই দেশ ত্যাগ করেছেন এস আলম গ্রুপের সামসুল আলম মাসুদ। আগস্টের পর আত্মগোপনে চলে যান এস আলম গ্রুপের প্রভাবশালী কর্মকর্তা আকিজ উদ্দিন।

এই বিষয়ে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রাম উত্তর বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মো. হাফিজুর রহমান গণ মাধ্যমকে বলেন, নাজমি নওরোজের কাছ থেকে ঋণের টাকা উদ্ধারের জন্য ব্যাংক নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে তাকে ডেকে এই ঋণ পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয় । পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলাও দায়ের করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অন্যান্য পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ প্রক্রিয়াধীন।

« পূর্ববর্তী সংবাদপরবর্তী সংবাদ »







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৪০৪-৪০৮০৫২, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত