বৃহস্পতিবার ৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বৃহস্পতিবার ৪ ডিসেম্বর ২০২৫
এআই: নতুন প্রযুক্তি-বিপ্লবের সুযোগ, সংকট ও সমাধান
মো: মশিউর রহমান (প্রান্ত)
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫, ৭:৫৩ PM

সৃষ্টির আদিম প্রভাত থেকে আজ অব্দি মানুষ নিরবচ্ছিন্ন গতিতে এগিয়ে চলেছে। মানবসভ্যতার প্রতিটি শিল্পবিপ্লবের মতোই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই আমাদের নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। শিক্ষা, শিল্প, গণমাধ্যম, গবেষণা ও বিনোদনে এর ব্যবহার যেমন নতুন সুযোগ তৈরি করছে, তেমনি এর নৈতিকতা, নিরাপত্তা ও অপব্যবহার নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগও বাড়ছে।

২০২৫ সালের শুরুতে আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বের ৭০ শতাংশের বেশি সৃজনশীল প্রতিষ্ঠান কোনো না কোনোভাবে এআই-নির্ভর ওয়ার্কফ্লো ব্যবহার করছে। এর স্পষ্ট বার্তা হলো এআই এখন ভবিষ্যৎ নয়, বর্তমান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে স্নাতক এবং দেশীয় সংগীত ও প্রযুক্তি নিয়ে মিশেল এক ক্যানভাসের মতো তৈরি করার চেষ্টা নিজেকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবস্থা থেকেই একুশে টেলিভিশন, সিএসবি, দুই টাকার জনপ্রিয় দৈনিক পত্রিকা আমাদের সময়, রেডিও আমার ৮৮.৪ এফএম তে কাজ করি। নতুন নতুন এই মাধ্যমগুলো ২০০১-২০১০ পযর্ন্ত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। একই সাথে তরুণ প্রজন্মের মাঝে তোলপাড় সৃষ্টি করে। বিশেষ করে এফএম রেডিওর কথা না বলেলেই নয়। এরপর বৈশাখী টেলিভিশন, গাজী টেলিভিশন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টেলিভিশন, ইউটিউব চ্যানেল ঠিকানা, নেক্সাস টেলিভিশন এবং বিডি ক্লিন-এর অ্যাওয়ারনেস ভিডিও নির্মাতা, দেশে বিদেশে ৪৯টি চ্যানেলের গ্রাফিক্স মোশন ব্রান্ডিংয়ের কাজের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমানে দীপ্ত টিভির গ্রাফিক্স ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব পালন— এই দীর্ঘযাত্রায় আমি বুঝেছি একটি বিষয়: প্রযুক্তি তখনই শক্তিশালী হয়, যখন তাতে সৃজনশীলতার সঙ্গে দায়িত্ববোধ যুক্ত হয়।

কনটেন্ট নির্মাণে এআই আমাকে নতুন মাত্রায় কাজ করার সুযোগ দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে আমার যে গানটি ভাইরাল হয়েছিল, তার মূল থিম ছিল— বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকের মধ্যেই যেন নিজস্ব একটা আলো থাকে। কারো প্রলোভনে, লোভে পড়ে যেন সেই আলো নিভে না যায়। তাহলে সমস্ত প্রাণহীন ভাস্কর্যগুলোও জেগে উঠবে তোমাদের ঘুম ভাঙ্গাতে। এই কনসেপ্টে গানটি লিখেছিলাম। পরবর্তীতে ‘টাকা’ নিয়ে আমার লেখা “কাগজের দানব” গানটি ভাইরাল হয়।  সেই গানে আমি তুলে ধরেছি— একটি প্রাণহীন কাগজের নোটের পেছনে কীভাবে পৃথিবীর মানুষ পাগলের মতো ছুটে বেড়ায়। টাকাকে কখনো “কাগজের দানব”, কখনো “নীরব শয়তান” হিসেবে উপমা দিয়েছি; কারণ পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া বেশিরভাগ অন্যায়ের কেন্দ্রবিন্দুতেই থাকে টাকা। এমনকি টাকার কারণে খুন পর্যন্ত হলেও খুনির শাস্তি হয়, কিন্তু টাকার কি কখনো কোনো শাস্তি হয়?— এই প্রশ্নটিও গানে তুলে ধরেছি। গানটিতে আমি নন–পলিটিকাল, পুরনো টাকার নোটগুলো নিয়েও কাজ করেছি— যেসব নোট দেখলে আমাদের শৈশবের স্মৃতিগুলো নতুন করে ফিরে আসে।
চলচ্চিত্র ও টিভি ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে এআই (AI)

চলচ্চিত্র ও টিভি ইন্ডাস্ট্রিতে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে এআই (AI)

টিভি–সিনেমায় এআই: সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত
নোবেল ও মৌ— একসময় বাংলাদেশের ব্যস্ততম ও জনপ্রিয় মডেল। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে তারা অনেকটাই আড়ালে চলে গেছেন। বিশেষ করে নোবেল, যিনি ৯০–এর দশকে ‘বাংলাদেশি মডেল’ বললেই প্রথম সারিতে উঠে আসতেন— বর্তমানে তাকে প্রায় কোনো কাজেই দেখা যায় না। প্রশ্ন জাগে, এমন একটি প্রতিভা কেন হারিয়ে যাবে? সামান্য সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, ইতিবাচক উপস্থাপন ও আধুনিক প্রযুক্তির সুযোগ কাজে লাগালে তাকে আবারও ২০২৫ সালের নোবেল হিসেবে সামনে আনা সম্ভব।

এআই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো— এটি পুরোনো সময়ের তারকাকেও নতুন প্রেক্ষাপটে তুলে ধরার সুযোগ তৈরি করে। আমাদের অতীতের নায়ক ওয়াসিম, জসীম, মান্না কিংবা জনপ্রিয় ভিলেন চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতাদের মুখ ব্যবহার করে আধুনিক গল্পে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা সম্ভব। যাদের অনেকেই ভিলেন রোলের কারণে দর্শকের কাছে ভুলভাবে ‘নেতিবাচক’ হিসেবে পরিচিত হলেও ব্যক্তিজীবনে তারা ছিলেন অত্যন্ত সদালাপী ও মানবিক। এই ভুল ধারণা দূর করে তাদের শিল্পীসত্তাকে সম্মান জানাতেও এআই একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। টিভি ও সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে এআই এর একটি সুস্থ ও কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তুললে কাজের গতি যেমন বাড়বে, তেমনি প্রয়োজনীয় অনেক পরিশ্রমও কমে আসবে। যখন প্রযুক্তি আমাদের সহজ সমাধান দিচ্ছে, তখন কেন অপ্রয়োজনীয় জটিলতায় সময় নষ্ট করব? বাংলাদেশের বিনোদন শিল্প এআই এর ব্যবহারে এক নতুন যুগে প্রবেশ করতে পারে— যেখানে পুরোনো তারকারাও ফিরে আসবেন নতুন আঙ্গিকে, আর নতুনরা পাবেন দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার এক শক্তিশালী হাতিয়ার।

সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞাপন শিল্পে এআই-নির্ভর পুনর্গঠিত মুখাবয়ব ব্যবহারের আলোচনা বাড়ছে। যারা বেঁচে নেই কিংবা বয়স হয়ে গিয়েছে, তাদের ফেস ব্যবহার করে বিজ্ঞাপনের স্ক্রিপ্ট রেডি করে যদি তাদের পরিবারের কাছ থেকে অনুমতি নেয়া যায়, এবং চুক্তিতে উল্লেখ থাকে যে স্ক্রিপ্টের বাইরে তাদেরকে ব্যবহার করা হবে না, তাহলে এই ধরনের যাত্রা শুরু করলে অনেক ভালো কাজ করা সম্ভব। যারা বেঁচে নেই তাদের ফেস ব্যবহারের অনুমতি নিয়ে কাজ করলে তাদের পরিবারও উপকৃত হবে কপিরাইটের টাকা পেয়ে। আমি মিডিয়া কমের ক্রিয়েটিভ হেড সাগর ভাইকে বিষয়টি শেয়ার করেছিলাম গতো মাসে, তিনি বেশ আগ্রহ প্রকাশ করেছেন এবং তাকে একটি ডেমো বানিয়ে দেখাব।

এআই যারা ব্যবহার না করেছেন তারা ছাড়া অন্য কেউ বুঝবেন না যে এটা কতো বড় সহযোগী কিংবা এসিস্ট্যান্ট। কতো কিছু যে করা সম্ভব! কিন্তু যারা এআই দিয়ে খারাপ কনটেন্ট বানিয়ে সমাজকে ঝুঁকির মুখে ফেলছেন, তাদের কারণে অনেকেই এআই সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তাই প্রত্যেকটা দেশের সাইবার ক্রাইম আইনে, যারা এসব কনটেন্ট তৈরি করেন তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত। তাহলে জিনিসটা ভালোভাবে ফিল্টারিং হবে।

আমাদের দেশে এআই-ভিত্তিক তথাকথিত "দ্রুত ধনী হওয়ার প্রশিক্ষণ" এখন নতুন বিভ্রান্তি। কয়েক ঘণ্টার কোর্সে কোটি টাকা আয়ের স্বপ্ন দেখানো তরুণদের জন্য বিপজ্জনক। অথচ বাস্তবতা হলো— স্ক্রিপ্ট, ডিজাইন, প্রোডাকশন, ভয়েস, বিশ্লেষণ— সবমিলিয়ে এআই কনটেন্ট একটি পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা, যা সময় ও মনোযোগ দাবি করে। তাই প্রয়োজন সত্যিকারের প্রশিক্ষণ— গভীরভাবে শেখানোর, ধাপে ধাপে এগিয়ে নেওয়ার, আর নৈতিকতা ও দায়িত্ববোধকে সবার আগে রাখার। সমাজে নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য অভিভাবকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিশু-কিশোররা খুব দ্রুত প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত হয়, কিন্তু ব্যবহারবিধি বুঝে ওঠে না। অভিভাবকদের উচিত এআই সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণা রাখা, যাতে তারা সন্তানদের ভুল কনটেন্ট বা অপব্যবহার থেকে রক্ষা করতে পারেন।

এআই ভবিষ্যতের প্রতিভাকে শক্তিশালী করবে— যদি আমরা প্রযুক্তির সঙ্গে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও মানবিক বোধকে সমান গুরুত্ব দিই। সৃজনশীল মানুষের হাতে এআই এক আশীর্বাদই হতে পারে; প্রয়োজন শুধু সঠিক দিকনির্দেশনা, স্বচ্ছ নীতি ও নিরাপদ ব্যবহারের নিশ্চয়তা। আমার স্বপ্ন ভালো একজন নির্মাতা হবার, বেশ কিছু ভালো ভালো কাজ ও করেছি গত কয়েক বছরে। কিন্তু আমরা বাজেটের জন্য অনেকে ভালো কাজ করতে পারি না। ভালো প্রডিউসারের অপেক্ষা করতে হয়। অথচ এআইএর  মাধ্যমে আমরা অনেক ক্ষুধা মেটাতে পারি নির্মাণের। অনেক গল্প বলতে পারি, বলাতে পারি, মানুষকে আনন্দ, দুঃখও দিতে পারি। আমি নিজে এআই দিয়ে ৬টা ক্যাটাগরি নিয়ে কাজ করছি। 

মো: মশিউর রহমান (প্রান্ত )
এআই কনটেন্ট ক্রিয়েটর, বিশ্লেষক ও গ্রাফিক্স ম্যানেজার


আরও সংবাদ   বিষয়:  এআই   প্রযুক্তি বিপ্লব   এআই প্রযুক্তি   কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা  







  সর্বশেষ সংবাদ  
  সর্বাধিক পঠিত  
এই ক্যাটেগরির আরো সংবাদ
সম্পাদক ও প্রকাশক:
মো. আশরাফ আলী
কর্তৃক এইচবি টাওয়ার (লেভেল ৫), রোড-২৩, গুলশান-১, ঢাকা-১২১২।
মোবাইল : ০১৮৪১০১১৯৪৭, ০১৪০৪-৪০৮০৫৫, ই-মেইল : thebdbulletin@gmail.com.
কপিরাইট © বাংলাদেশ বুলেটিন সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত