সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিলে এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে নিয়ে আশাবাদী হওয়ার মতো কোনো জায়গা ছিল না। তবুও সবচেয়ে ভালো ফল কিন্তু এবারই করলো বাংলাদেশ মূল পর্বে দুটো জয়, যা আগে কখনও পায়নি!
বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পায় ২০০০ সালে। অধিকাংশ দেশই এর বিরোধিতা করেছিল। ওই পর্যায়ে খেলার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের দৌড়ঝাঁপ এবং তখনকার আইসিসি সভাপতি জগমোহন ডালমিয়ার একান্ত ইচ্ছায়/ফেভারে টেস্ট মর্যাদা পায় বাংলাদেশ। তখন দেখেছি সাদা-কালো ইস্যু টেনে এনে বাংলাদেশের অতিউগ্র অদূরদর্শী অশিষ্ট ‘দেশপ্রেমিকেরা’ নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, দ. আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়াকে গালাগাল করতো।
আজ ২২ বছর পর কোথায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট? কতটুকু এগিয়েছে? টেস্ট ‘মর্যাদা’ রক্ষা হয়েছে, না এর বিপরীতটা ঘটেছে? শ্রীলঙ্কা ১৫ বছরের মাথায় বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়েছিল! আর বাংলাদেশ বিশ্বকাপ তো দূরে থাক, আজ পর্যন্ত কোনো টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি, বয়ে চলছে একটানা সর্বোচ্চ সংখ্যক টেস্ট ম্যাচ হারের রেকর্ড, দ্রুততম ১০০ টেস্ট পরাজয়ের রেকর্ড, আরও কত কী! এই ব্যর্থতা ভুলতে বাঙালি বলে যে নিউজিল্যান্ডও তো প্রথম ২৬ বছর জয় পায়নি! কিন্তু তারা এটা কখনোই ভাবনায় আনতে চায় না যে পাকিস্তান প্রথম বছরেই তাদের দ্বিতীয় টেস্টে জয় পেয়েছিল।
বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশ যখন ক্রিকেট খেলত না তখন দেশের ক্রিকেটভক্তদের সমর্থন দুভাগে ভাগ হয়ে থাকতো—ভারত ও পাকিস্তান। ভারতের সমর্থক মানে সে পাকিস্তানের পরাজয় কামনা করে, উল্টোক্রমও (vice versa) সমান সত্য। সেই ধারা এখনও চলমান। তবে মনে রাখতে হবে এ কথাটি বাংলাদেশের সাথে খেলা হলে খাটে না। বাংলাদেশের সাথে যেকোনো দেশের খেলায় এই সমর্থকেরা হয়ে ওঠে উগ্রজাতীয়তাবাদী বিশেষ করে ভারতের সাথে খেলা হলে উগ্রতা অশ্লীলতা অসহিষ্ণুতা সীমা পেরিয়ে যায়। এর পেছনে দুটো কারণ উল্লেখ্য। একটি, মূলত অর্থের প্রভাবে সবসময় না হলেও আইসিসি ভারতের প্রতি প্রচ্ছন্ন পক্ষপাতমূলক অবস্থান নেয় তা অনস্বীকার্য। ফলে বাংলাদেশের মানুষের মনে একটি ভীতি কাজ করে যে আইসিসি যেকোনো প্রকারেই হোক ভারতকে জয়ী করতে চায়। আম্পায়ারের যেকোনো মানবীয় ভুলও ভারতের কারসাজি হিসেবে পরিগনিত হয়। এটা সবলের প্রতি দুর্বলের চিরন্তন ভীতি (xenophobia)। ভারতের ব্যাটিং কিংবদন্তি সচিন টেন্ডুলকার খেলোয়াড়ী জীবনে বহুবার বিতর্কিত সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছেন। খেলার মাঠে ভারতের এতো নিয়ন্ত্রণ থাকলে এমন হতো না। আরেকটি, বাংলাদেশি মুসলমানদের ধর্মবোধ। শুধু ক্রিকেট নয়, সবক্ষেত্রেই এদেশের ভারতবিরোধী মনোভাবধারীরা মুসলমানিবোধে উদ্বেলিত।
বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে ক্রিকেট খেললেও অবস্থান বরাবরই প্রায় তলানিতে; আশাজাগানিয়া পারফরম্যান্স তেমন নেই। কিন্তু খেলার মাঠে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে না পারলেও দেশের অশিষ্ট সমর্থকেরা বিশ্বব্যাপী প্রচারিত বিভিন্ন পত্রিকার পাঠক মতামত অংশে, গ্রুপ, পেইজ, ফেইসবুকে অকথ্য ভাষার ঝাঁপি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রতিপক্ষের ওপর। উস্কানিমূলক কথা, কটাক্ষ করা, হেয়প্রতিপন্ন করা, আত্মসম্মানে আঘাত করা, বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করা, অসংখ্য ভুলেভরা ইংরেজি লেখা, সবমিলিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বিশ্বে হাসির পাত্র হয়ে উঠেছে। সবখানে বাংলাদেশকে নিয়ে চলে কৌতুক। এই সমর্থকেরা অন্যের কৃতিত্ব স্বীকার করে না। তারা প্রিয় দলের জয়ে আনন্দে উন্মত্ত হয়ে পড়ে ও প্রতিপক্ষকে গালাগাল করে; পরাজয়ে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে পড়ে ও প্রতিপক্ষকে অধিকতর গালাগাল করে। গালাগাল যেন এদের প্রিয় কবিতা! আত্মসমালোচনা আত্মোন্নতি ঘটায় কথাটি খেলা তথা জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। বাঙালি তার ব্যর্থতা আড়াল করতে চায়, শুধরাতে চায় না। পতনোন্মুখ বাঙালি নিচে তাকিয়ে সান্ত্বনা খোঁজে, ওপরে তাকিয়ে লক্ষ্য স্থির করতে চায় না। নিজের পায়ে জুতো না থাকার কষ্ট ভুলে থাকতে চায় খোঁড়াকে দেখে, জুতো কেনার সামর্থ্য অর্জনে ব্রতী হয় না। শ্রেয়তরের সমকক্ষতা অর্জন করতে হলে নিজেকে উন্নীত করতে হয়। কিন্তু বাঙালির তত্ত্ব উল্টো ও ভ্রমাত্মক শ্রেয়কে টেনে নিজের স্তরে নামিয়ে সমকক্ষ হতে চায়।
অশিষ্ট হুজুগে সমর্থকদের কারণে ক্রিকেটবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি অত্যন্ত অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই সমর্থকদের সাথে কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে তাকে বিরুদ্ধাচরণকারী ভাবে। Disagreement is not disrespect কথাটির মর্ম কবে বুঝবে তারা! বাংলাদেশি কোনো নাগরিক যখন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সমালোচনা করেন তিনি তা পুলকিত হয়ে করেন না, বিষন্নতা থেকেই করেন। তিনি অন্য কোনো দেশের চর নন, তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রকৃত মঙ্গলাকাক্সক্ষী। তিনি ভুলগুলো আলোচনা করেন সমালোচনা করেন এজন্য যে, যাতে ভুলের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে সামনে এগোতে পারে দেশ। এ সমালোচনা নিজ দেশকে হেয় করার উদ্দেশ্যে নয়, বিদ্বেষ থেকেও নয়, বরং দেশপ্রেম থেকেই উত্থিত।
বাঙালি আত্মসমালোচনাকে ভাবে দুর্বলতা। মনে রাখতে হবে, শরীরের কোনো অংশে পচন ধরলে জামা খুলে তা চিকিৎসককে দেখালে শরীরের অপমান হয় না, বরং তাতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়। স্বজাতির সমালোচনা করার অধিকার ওই জাতির মানুষের যতোটা আছে ততোটা নেই অন্য কারও। দেশপ্রেমে আপ্লুত হয়ে কেউ বিষোদগার করলে তা দেশদ্রোহিতা নয়, বিরুদ্ধাচারণও নয়, সেটাও দেশপ্রেম। রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতার কয়েকটি পংক্তি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই অতি মূর্খ নারী আমি,/কী বলেছি রোষবশে—ওগো অন্তর্যামী,/সেই সত্য হল? সে যে মিথ্যা কতদূর,/তখনি শুনে কি তুমি বোঝনি ঠাকুর?/শুধু কি মুখের বাক্য শুনেছ দেবতা?/শোননি কি জননীর অন্তরের কথা?
বাবু/জেএম